কন্যায় পরিণত ইঁদুর

কন্যায় পরিণত ইঁদুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত একটি প্রাচীন কল্পকাহিনী। কল্পকাহিনীটি মধ্যযুগে পশ্চিমদিকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং দূর প্রাচ্যেও এর অস্তিত্ব ছিল। গল্পটি আর্নে-থম্পসন নির্বাচিত ক্রমবর্ধমান গল্পের তালিকায় টাইপ ২০৩১সি-তে রয়েছে।[১] এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আরেকটি কল্পকাহিনী হল ইঁদুর কন্যার স্বামী। এ গল্পে আরও শক্তিশালী শক্তিসম্পন্ন একজন সঙ্গীর সন্ধান করা হয়। কিন্তু সমান শক্তিসম্পন্ন একজনকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে গল্পটি শেষ হয়।

উতাগাওয়া কুনিয়োশির "ক্যাট ড্রেসড অ্যাজ এ ওম্যান" (একটি কাবুকি দৃশ্যের চিত্র)

উপকথার ধ্রুপদী অনুরূপ একটি রূপ হল ঈশপের "প্রেমদেবী এবং বিড়াল "-এর উপকথা। যেখানে একজন পুরুষ তার বিড়ালকে নারীতে পরিবর্তন করার জন্য দেবী ভেনাসের কাছে প্রার্থনা করেন। এই কল্পকাহিনীতে অসম্পূর্ণ রূপান্তরের বিষয়বস্তু এবং চরিত্র পরিবর্তনের অসম্ভবতা রয়েছে। এটি সাহিত্য, লোককাহিনী এবং শিল্পকলায় বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছে।

কন্যায় পরিণত ইঁদুর সম্পাদনা

পঞ্চতন্ত্রে পাওয়া গল্পটি বর্ণনা করে যে কীভাবে একটি ইঁদুর একটি শিকারী পাখির ঠোঁট থেকে একজন ধার্মিক লোকের হাতে পড়ে, তিনি এটিকে একটি মেয়েতে পরিণত করেন এবং তাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন। অবশেষে তিনি তার বিবাহের জন্য একজন শক্তিশালী পাত্রের খোঁজ করেন। কিন্তু প্রতিবার আবিষ্কার করেন যে আরও শক্তিশালী পাত্র রয়েছে। যেমন- মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিতে পারে, বাতাস মেঘকে উড়িয়ে দেয় কিন্তু পর্বত বাতাসকে প্রতিরোধ করতে পারে। পাহাড়ে আবার ইঁদুর অনুপ্রবেশ করতে পারে। মেয়েটি এই ক্ষেত্রে তার স্বজাতি ইদুরকে পছন্দ করে। সে তার আসল রূপে ফিরে আসে এবং তার স্বামীর সাথে তার গর্তে থাকতে যায়।[২] বাংলার লোক-কাহিনীতে এই গল্পের একটি রূপ দেখা যায় "অফিমের উৎপত্তি" নামে। সেখানে একজন ব্যক্তি একটি ইঁদুরের ইচ্ছা পূরণ করে। ইঁদুরটি নিজের থেকে বেশি কিছু হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। সে সুশ্রী নারীতে পরিণত হয় ও একজন রাজার নজর কাড়তে সক্ষম হয়। একটি দুর্ঘটনার পর যখন সে মারা যায় তখন তার সমাধিস্থল থেকে মনের ভাব পরিবর্তনকারী একটি আফিম গাছের সৃষ্টি হয়।

প্রাচীন ভারতীয় উপকথাটি শেষ পর্যন্ত পহলভি ভাষায় এবং তারপরে আরবি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাজের যেকোন একটি সংস্করণ ইউরোপে পৌঁছানোর আগে এই উপকথাটি মেরি ডি ফ্রান্সের ইসোপেটে একটি সতর্কতামূলক গল্প হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল এখানে সাবধান করা হয়েছিল একজনের সামাজিক অবস্থানের ওপরে গিয়ে বিয়ে করার বিরুদ্ধে।[৩] এই গল্পের প্রাণীটি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইঁদুর, যে তার মেয়ের জন্য সূর্যের পাণিপ্রার্থনা করে। তাকে একটি মেঘ, বাতাস, একটি পাহাড় এবং তারপরে ইঁদুরের কাছে পাঠানো হয়। ফলে সে সমশক্তিসম্পন্ন একজনকে বিয়ে করে।[৪]

নিজের সমপর্যায়ে থাকার বিষয়টি একটি রোমান লোক রূপকথায় পুনরায় আবির্ভূত হয় যেখানে একটি ইঁদুর ঈশ্বরের দর্শন পেতে বের হয়। সে দিকনির্দেশের জন্য সূর্য এবং মেঘের কাছে সাহায্য চায় কিন্তু তারা এই ছোট্ট প্রাণীকে উত্তর দেয় না। তারপর সে বাতাসকে জিজ্ঞাসা করে। বাতাস তাকে তুলে নিয়ে পিঁপড়ার স্তূপে ছুড়ে ফেলে। 'এবং সেখানে সে তার সমপর্যায়ের সঙ্গীদের খুঁজে পেয়েছে' -বলে গল্পটি শেষ হয়। জাপানি এবং কোরিয়ান ধরণে একটি কম কঠোর চিত্র প্রদর্শিত হয় যেখানে পিতা তার মেয়ের জন্য একটি শক্তিশালী সঙ্গী খুঁজছে এবং সূর্য, মেঘ ও বাতাসের চরিত্রগুলির বর্ণনা করা হয়। শেষ পর্যন্ত সেও ক্ষমতার সিঁড়িতে তার স্থান লাভ করে। এগুলি সবই হল প্রাণীর কল্পকাহিনী যেগুলোতে রূপান্তরের বিষয়টি অনুপস্থিত। জাপানি গল্পে একটি ইঁদুর নিয়ে গল্পটি বর্ণিত এবং কোরিয়ান ক্ষেত্রে একটি ছুঁচো নিয়ে গল্পটি বর্ণিত হয়।[৫]

লা ফন্টেইনের কল্পকাহিনীর পরবর্তী সংস্করণ,"দ্য মাউস মেটামরফোজড ইন এ মেইড" (৯.৭)-এ গল্পটির ভারতীয় উৎসকে স্বীকার করা হয়েছিল, একটি চরিত্র ছিল একজন ব্রাহ্মণের, যে ইঁদুরকে লালন-পালন করে এবং তাকে আগের জন্মের দেহ ফিরিয়ে দেয়। লা ফন্টেইন এই সমস্ত কিছু দেখে হতবাক হয়ে যান এবং গল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে খুঁজে পান যেখানে মেয়েটি কেবল গর্ত করা ইঁদুরের নাম উল্লেখ করার সাথে সাথে তার প্রেমে পড়ে। পূর্বের কল্পবাদীদের বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করার একটি যুক্তি নিচে দেয়া হল:

সব দিক দিয়ে তুলনা করে এবং ওজন করে,
মানুষের আত্মা এবং ইঁদুরের আত্মা
ভিন্নভাবে তৈরি করা হয় -
আকার ও আকৃতিতে তারা ভিন্ন হয়।
একটি আরেকটির সাথে মানানসই এবং তার নির্ধারিত অংশ সম্পন্ন করে
স্বর্গ যা দেয় তা সর্বদাই ভাল;
ডাইনি, শয়তান বা জাদু শিল্প কোনোকিছুই ভাগ্যের লিখন খণ্ডাতে পারে না।[৬]

রূপকথার দার্শনিক বিষয়বস্তু আমেরিকান কবি মারিয়ান মুরকে তার লা ফন্টেইন (১৯৫৪) এর সংস্করণে একটি বৈচিত্রপূর্ণ বিনোদনের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল:

আমরা জন্মের সময় যা ছিলাম, আমরা তাই, এবং তার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। যা
পৃথিবীর এবং স্বর্গের যুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ:
শয়তানের সাহায্য নিয়ে বা কালো জাদু অবলম্বন করে কোনোভাবেই স্বর্গের পূর্বনির্ধারিত থেকে কেউ বিচ্যুত হতে পারে না।[৭]

১৯৯২ সালে ব্রিটিশ সুরকার আলেকজাণ্ডার গোয়েহর সঙ্গীহীন সোপ্রানোর জন্য এই গল্পটি মঞ্চস্থ করেন (ওপাস ৫৪)।[৮]

প্রেমদেবী এবং বিড়াল সম্পাদনা

ভারতীয় উপকথার পাশ্চাত্য ধরণটি হল "প্রেমদেবী (বা অ্যাফ্রোডাইট) এবং বিড়াল" এর গল্প। গল্পটি চিরায়ত সাহিত্যের সময়ে ফিরে যায়। এ গল্প থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে প্রকৃতি প্রতিপালনের চেয়ে শক্তিশালী। এটি পেরি ইনডেক্সে ৫০ নম্বর হিসাবে পরিসংখ্যান করে। এর বিভিন্ন সংস্করণে একটি বিড়ালকে দেখানো হয়েছে। বিড়ালটিকে দেবী একজন মহিলাতে পরিণত করেন যিনি বিয়ের রাতে বাসর ঘরে একটি ইঁদুরের পরিচয় দিয়ে তাকে পরীক্ষা করেন।[৯] বাব্রিউসের গ্রীক সংস্করণ অনুযায়ী একটি বেজি (গ্রিক: γαλῆ) একজন পুরুষের প্রেমে পড়ে এবং আফ্রোডাইটকে তাকে একজন মানুষে পরিণত করার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু তারপর বিয়ের ভোজের মাঝখানে একটি ইঁদুরের পিছনে তাড়া করে।[১০] প্রাচীনকালে এটি মনে করা হত যে গ্রীক প্রবাদ 'একটি জাফরানী বর্ণের (বিয়ের) পোষাক কোনো বেজিকে শোভা পায় না' উপকথার সাথে যুক্ত ছিল। এর শিক্ষা অনেকটাই একই অর্থ বহন করে যে একজনের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত হয় না।[১১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. D. L. Ashliman, "The Mouse Who Was to Marry the Sun: fables of Aarne-Thompson type 2031C"
  2. Arthur W. Ryder, The Panchatantra of Vishnu Sharma, University of Chicago 1925, pp. 353-7
  3. Poésies de Marie de France, Paris 1820, Fable LXIV, Vol.2, pp.274-80
  4. Charles Brucker, “The fables of Marie de France and the Mirror of Princes” in A Companion to Marie de France, Brill 2011, p.210
  5. See the selection of tales of this type at Fables of Aarne-Thompson-Uther type 2031C (as above)
  6. The Fables of La Fontaine, University of Adelaide e-book
  7. YQuotes
  8. "Veery Books"। ১ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২৪ 
  9. Aesopica
  10. Fable 32
  11. G. J. Van Dijk, Ainoi, Logoi, Mythoi: Fables in Archaic, Classical, and Hellenistic Greek, Brill 1997, pp.225-6

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা