এল নিনো

বায়ুমন্ডলীয় এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর মাঝে একটি পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন

এল নিনো হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগটি পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন। এটির সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যেতে পারে, যখন তাহিতি এবং ডারউইনে অস্ট্রেলিয়ার বায়ুমণ্ডলে চাপের পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখন এবং যখন পেরুইকুয়েডর এর পশ্চিম উপকূল থেকে অস্বাভাবিক গরম অথবা ঠান্ডা সামুদ্রিবস্থা বিরাজ করে তখন। এল নিনো হচ্ছে পর্যায়বৃত্তের উষ্ণ পর্যায়, আর লা নিনা হচ্ছে শীতল পর্যায়। পর্যায়বৃত্ত এই পরিবর্তনের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে প্রতি 2 থেকে ৮ বছরের মাঝে দেখা যায়। এই পর্যাবৃত্ত কার্যপ্রণালী এখনও একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। এটি “এল নিনো দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন” নামেই বেশি পরিচিত।

নাসার টোপেক্স/পোসেইডন উপগ্রহের মাধ্যমে গৃহীত ১৯৯৭ সালের এল নিনোর চিত্র। সাদা অংশটি দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপকূলে প্রবাহিত উষ্ণ স্রোতকে নির্দেশ করছে।[১]

“এল নিনো” হচ্ছে একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার মানে “বালক” এবং নির্দেশ করা হয় “যীশুর ছেলে” বলে, কারণ এই পর্যাবৃত্ত উষ্ণ সামুদ্রিক জলস্রোতের পরিবর্তন সাধারণত উত্তর আমেরিকার ক্রিসমাসের সময়ই দেখা যায়। আর “লা নিনা” স্প্যানিশের মানে হচ্ছে little “বালিকা”।

এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। উন্নয়নশীল যেসব দেশ কৃ্ষিকাজ এবং মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল, তারাই এল নিনো দ্বারা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

সংজ্ঞা সম্পাদনা

এল নিনো হচ্ছে সমুদ্রের উপরিভাগের জলের তাপমাত্রার গড় মানের সাথে তুলনামুলক নীরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, পূর্ব-কেন্দ্রীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শান্ত সমুদ্রের পানির গড়পড়তা তাপমাত্রা যখন কমপক্ষে ০.৫°সেলসিয়াস (০.৯°ফারেনহাইট) হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে তখন। যখন এটি পাঁচ মাসের কম সময় ধরে সংঘটিত হয়, তখন এ্টি এল নিনো অথবা লা নিনোর শর্ত পূরণ করে, যদি এই ব্যতিক্রম পাঁচ মাস বা তারও অধিক সময় ধরে চলতে থাকে তখন এটিকে এল নিনো অথবা লা নিনো নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত এটি ২-৭ বছরের যে কোন সময়ে এবং ৯ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। এল নিনোর প্রথম লক্ষণগুলো হচ্ছে:

  • ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার উপরিভাগের জলের চাপের পরিবর্তন
     
    এল নিনো
  • তাহিতি এবং বাকি মধ্য-পূর্ব শান্ত সমুদ্রের বায়ুচাপের হ্রাস
  • বিষুবরেখা বরাবর বাণিজ্যিক বায়ু যখন উত্তর শান্ত সমুদ্রে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা পুর্বে চলতে থাকে
  • পেরুতে গরম বাতাসের উদয় হয় এবং উত্তর পেরুভিয়ান মরুভূমিতে বৃষ্টির সূত্রপাত ঘটায়
  • দক্ষিণ এবং ভারতীয় সমুদ্র থেকে উত্তর শান্ত সমুদ্রে উষ্ণ জলের বিস্তার ঘটে। এটি বৃষ্টির জল সাথে নিয়ে চলে এবং দক্ষিণ শান্ত সমুদ্রে অনাবৃষ্টি আর সাধারণত শুষ্ক উত্তর শান্ত সমুদ্রে বৃষ্টিপাত ঘটায়।

এল নিনোর উষ্ণ অপুষ্টিকর বিষুবীয় জলস্রোত ঠান্ডা পুষ্টিসমৃদ্ধ বিষুবীয় “হাবল্ট জলস্রোতের” সাথে অদল-বদল ঘটে। যখন এল নিনোর এসব অবস্থা সমুদ্রে কয়েক মাস যাবৎ বিরাজ করে, তখন অত্যধিক গরম সামুদ্রিক জলরাশি দেখা যায় এবং স্থানীয় মাছ ধরার ব্যবসার উপর বড় একটি প্রভাব দেখা দিতে পারে।

এল নিনোর প্রাথমিক ধাপ এবং বৈশিষ্ট্যসমূহঃ এল নিনো হওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনও গবেষণা চলছে। এল নিনোর ঘটনা শুরু হয় যখন বাণিজ্যিক বায়ু, ওয়াকার সঞ্চালন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনেক মাস ধরে বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকে। অনেকগুলো কেলভিন তরজ্ঙ্গ মিলে কয়েক সেন্টিমিটার উঁচু এবং কয়েকশ কিলোমিটার প্রশস্ত তুলনামূলক গরম জলের সৃষ্টি হয় এবং উত্তর আমেরিকার কাছে একটি গরম ডোবার সৃষ্টি করে, যেখানে সাগরের তাপমাত্রা সাধারণত শীতল থাকে নিচ থেকে জলের উর্ধগমনের জন্য।শান্ত সমুদ্র তাপ সংরক্ষণ করে রাখে যা বৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তন করে এবং ফলশ্রুতিতে এর তাপমাত্রার পরিবর্তন বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। ব্রষ্টিপ্রবাহ দক্ষিণ শান্ত সমুদ্র থেকে আমেরিকার দিকে পরিবর্তিত হয় যখন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারত শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে জ্যাকব জার্কনেস এল নিনো বোঝার জন্য প্রস্তাব করেন যে- উত্তর শান্ত সমুদ্রে একটি ব্যতিক্রমি উষ্ণ বিন্দু উত্তর-দক্ষিণের তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটাতে পারে বাণিজ্যিক বায়ুকে এলোমেলো করে দিয়ে, যা কিনা উষ্ণ স্রোতকে দক্ষিণে ঠেলে দেয়। ফলশ্রুতিতে পূর্বে ক্রমাগতভাবে গরম পানির আবির্ভাব হতে থাকে। বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছে যার মাধ্যমে ইকুয়াটোরিয়াল শান্ত সমুদ্রে কীভাবে গরম জল আরও বাড়তে থাকে এবং নিম্ন গভীরতায় এল নিনোর প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাদবাকি ঠাণ্ডা এলাকাগুলো আরেকটি এল নিনো ঘটানোর জন্য কয়েক বছর ধরে উষ্ণতা ধরে রেখে পুনরায় শক্তি জোগাড়ড় করতে থাকে।

দক্ষিণস্থ পর্যাবৃত্ত চক্র/সাউদার্ন অসিলেশন সম্পাদনা

দক্ষিণস্থ পর্যাবৃত্ত চক্র হচ্ছে এল নিনোর বায়ুমন্ডলীয় অবস্থার ঠিক বিপরীত অবস্থা। উষ্ণমন্ডলীয় উত্তর এবং উষ্ণমন্ডলীয় দক্ষিণ শান্ত সমুদ্রের মধ্যে এটি একটি পর্যাবৃত্ত চক্র।দক্ষিণস্থ পর্যাবৃত্ত চক্র বা ইংরেজিতে সাউদার্ন অসিলেশনের শক্তিমাত্রাকে সাউদার্ন অসিলেশন ইন্ডেক্স হিসেবে পরিমাপ করা হয়। এই সাউদার্ন অসিলেশন ইন্ডেক্স তাহিতি এবং ডারউইন, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার উপরিভাগের বায়ুচাপের পার্থক্য থেকে গনণা করা হয়ে থাকে। এল নিনোর ঘটনা প্রবাহ সাউদার্ন অসিলেশন ইন্ডেক্সের ঋণাত্তক বা নেগেটিভ মান সূচিত করে, যার মানে দাঁড়ায়- ডারউইন থেকে তাহিতিতে বায়ুচাপ তুলনামূলকভাবে কম। এল নিনোর উষ্ণ স্রোতের প্রভাবঃ

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন সম্পাদনা

বেশির ভাগ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোনই অয়নান্তবৃত্তের পাহাড়ী ঢাল থেকে উৎপন্ন হয়ে ইকুয়েডরের নিকটবর্তী হয়, তারপর ওয়েস্টারলাইজের প্রধান বলয়ে বেঁকে যাওয়ার পূর্বে পলেওয়ার্ডের অক্ষ অতিক্রম করে। সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে এসব সাইক্লোন জাপান এবং কোরিয়াতে আঘাত হানে। এছাড়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আটলান্টিক সাগর এল নিনোর বছরগুলোতে উল্লম্বভাবে আনত শক্তিশালী বাতাসের কারণে সাগর উত্তাল থাকে। এল নিনোর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীঃ

ঐতিহাসিক তথ্য সম্পাদনা

আঠারোশো শতকে মাঝারি ধরনের সব মিলিয়ে ৩২টি এল নিনো শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৪০-১৯৪১, ১৯৫৭-১৯৫৮ এবং ১৯৭২-১৯৭৩ সালের এল নিনোকে শক্তিশালী এবং ১৮৯১, ১৯২৫-১৯২৬ ও ১৯৮২-১৯৮৩ সালের ঘটনাসমূহকে খুবই শক্তিশালী ধরা হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং এল নিনোঃ

প্রতিক্রিয়া সম্পাদনা

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং এল নিনো- দুটি ঘটনাই পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এল নিনোকে প্রভাবিত করতে পারে-যদিও এখন পর্যন্ত এটি একটি তত্ত্ব মাত্র। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, গত ২৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলছেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আরও শক্তিশালী এল নিনোর উদ্ভব হবে। আবার কিছু কম্পিউটার মডেল এটাও প্রদর্শন করেছে যে, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এল নিনো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। যাই হোক, এ নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন পড়বে যে, সত্যিই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এল নিনোর উপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা