উত্তর রাখাইন সংঘাতের সময় ধর্ষণ

২০১৬ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের উত্তরাংশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনীর সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার সৈন্যরা স্থানীয় রোহিঙ্গা জনসাধারণের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন আরম্ভ করে। এসময় অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমার সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার হন। রোহিঙ্গাদের 'জাতিগত নিধনে'র উদ্দেশ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে।

পটভূমি সম্পাদনা

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে (প্রাক্তন আরাকান প্রদেশ) বসবাসকারী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি সম্প্রদায়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন প্রদেশের আদিবাসী বলে স্বীকার করে না এবং তাদেরকে 'বাঙালি' অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য অনুসারে, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর সশস্ত্র রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইন প্রদেশের বেশ কয়েকটি সীমান্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন পুলিশকে হত্যা করে[১] এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে[২]। এক সপ্তাহ পর হারাকাহ আল-ইয়াকিন নামক একটি নবগঠিত রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দল হামলার দায় স্বীকার করে[৩][৪][৫]। ২০১৭ সালেও মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে[৪][৫]

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার ঘোষণা করে যে, রাখাইন প্রদেশজুড়ে ২৪টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৫৫২তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ঘাঁটিতে ১৫০ জনেরও বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী আক্রমণ চালিয়েছে এবং এর ফলে ৭১ জন (১ জন সৈন্য, ১ জন অভিবাসন কর্মকর্তা, ১০ জন পুলিশ এবং ৫৯ জন বিদ্রোহী) নিহত হয়েছে[৬][৭][৮]

নারী নির্যাতনের ঘটনাবলি সম্পাদনা

মিয়ানমার সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমণের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশের উত্তরাংশে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ওপর বড় ধরনের হামলা শুরু করে। এসময় মিয়ানমার সৈন্যরা বহু রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করে[৯][১০][১১]। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়[১২]

মিয়ানমার থেকে পালানো রোহিঙ্গারা জানান যে, রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করা হয়েছে, রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং রোহিঙ্গা শিশুদের জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে[১৩][১৪][১৫]। উত্তর রাখাইনের উদাং গ্রাম থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা হাবিবা নাম্নী ২০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা তরুণী জানান, মিয়ানমার সৈন্যরা তাকে এবং তার ১৮ বছর বয়সী বোন সামিরাকে বিছানার সঙ্গে বেঁধে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল[১৩]। আরেকজন ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা নারী জানান, তাকে মিয়ানমার সৈন্যরা ৪৫ দিন আটকে রেখে বারবার গণধর্ষণ করেছিল[১৬]। বহু রোহিঙ্গা নারীর স্বামী-সন্তান বা পিতামাতাকে হত্যা করার পর তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়[১৭]স্কাই নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ৫২ জন রোহিঙ্গা নারীর মধ্যে ২৯ জনই জানান যে, তারা মিয়ানমার সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন এবং তাদের একজন বাদে সবাই গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন[১৭]

আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের প্রতিবেদন সম্পাদনা

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমার সরকার ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে[১৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Myanmar says nine police killed by insurgents on Bangladesh border"The Guardian। ১০ অক্টোবর ২০১৬। 
  2. "Rakhine border raids kill nine police officers"। Myanmar Times। ১০ অক্টোবর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১০ জানুয়ারি ২০১৭ 
  3. "Islamist fears rise in Rohingya-linked violence"Bangkok Post। Post Publishing PCL। সংগ্রহের তারিখ ৫ নভেম্বর ২০১৬ 
  4. McDonald, Taylor (২২ জুন ২০১৭)। "Rohingya 'insurgent' camp raided - Asean Economist"Asean Economist। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৭ 
  5. "Myanmar forces kill 3 in raid on 'terrorist training camps': State media - Times of India"The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৭ 
  6. "Myanmar tensions: Dozens dead in Rakhine militant attack"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৭ 
  7. Htusan, Esther (২৫ আগস্ট ২০১৭)। "Myanmar: 71 die in militant attacks on police, border posts"। Associated Press। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৭ 
  8. Lone, Wa; Slodkowski, Antoni (২৪ আগস্ট ২০১৭)। "At least 12 dead in Muslim insurgent attacks in northwest Myanmar"Reuters। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৭ 
  9. "Myanmar: Security Forces Target Rohingya During Vicious Rakhine Scorched-Earth Campaign"Amnesty International। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬। 
  10. Joshua Berlinger (১৬ নভেম্বর ২০১৬)। "'Shoot first, ask questions later': Violence intensifies in Rakhine State"। CNN। 
  11. Matt Broomfield (১০ ডিসেম্বর ২০১৬)। "UN calls on Burma's Aung San Suu Kyi to halt 'ethnic cleansing' of Rohingya Muslims"The Independent। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  12. "21,000 Rohingya Muslims flee to Bangladesh to escape persecution in Myanmar"International Business Times। ৬ ডিসেম্বর ২০১৬। 
  13. "'They raped us one by one', says Rohingya woman who fled Myanmar"The News International। ২৫ নভেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  14. "UN calls on Suu Kyi to visit crisis-hit Rakhine"The Daily Star। ৯ ডিসেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  15. "Kofi Annan, in Myanmar, Voices Concern Over Reported Abuses of Rohingya"The New York Times। ৬ ডিসেম্বর ২০১৬। 
  16. "Rohingya women gang-raped by Myanmar army" 
  17. "Myanmar troops accused of gang-raping Rohingya women and girls"Sky News। ১৬ নভেম্বর ২০১৭। 
  18. "Darkness of Humans: Investigating Mass Rapes in Burma"