উত্তর কোরিয়া–চীন সম্পর্ক

চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক (চীনাঃ中朝关系, জংছাও গুয়ানশি; কোরিয়ানঃ조중 관계, জজুং গুয়াংগ্যে) হল পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) এবং ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া (ডিপিআরকে বা উত্তর কোরিয়া) এর মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।

চীন-উত্তর কোরিয়া মৈত্রী।

উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং এ চীনের একটি দূতাবাস ও ছংজিনে একটি কনস্যুলেট জেনারেলের অধিদপ্তর রয়েছে। চীনে বেইজিং এর ছাওইয়াং জেলায় উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস ও শেনইয়াংয়ে একটি কনস্যুলেট জেনারেল (বাণিজ্যিক দূতাবাস) অবস্থিত।

অতীতে চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মাঝে গভীর কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল। যদিও, গত কয়েক বছর যাবত চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে। চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের এই অবনতি প্রাথমিকভাবে উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন কার্যক্রম, যেমন দেশটি চীনের জেলে নৌকা বাজেয়াপ্ত করা এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ এর পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি প্রভৃতি বিষয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে ঘটেছে।

উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীনের জনগণের পছন্দশীল দৃষ্টিভঙ্গিরও দিনদিন অবনমন ঘটছে। ২০১৪ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস পোল অনুসারে, চীনের জনগোষ্ঠীর ২০শতাংশ উত্তর কোরিয়ার প্রভাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে আর ৪৬শতাংশ এতে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে।

ইতিহাস সম্পাদনা

প্রাক ইতিহাস এবং কোরিয়ান যুদ্ধ সম্পাদনা

আরও দেখুনঃ চীন-কোরিয়া সম্পর্কের ইতিহাস

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া ১৯৪৯ সালের ৬ অক্টোবর পরস্পর কূটনৈতিক স্বীকৃতি বিনিময় করে।

১৯৫০ সালের মে মাসে, কিম ইল-সুং, মাও যেদং ও চীনা নেতৃস্থানীয়দের তার যুদ্ধনীতি সম্বন্ধে অবগত করতে গোপনে বেইজিং ভ্রমণ করেন। কোরিয়ান গণসেনা অর্থাৎ পিপলস আর্মির বিপত্তির মুখে ও জাতিসংঘ কমান্ডের ৩৮নং সমান্তরালরেখা অতিক্রমণ পরবর্তী সময়ে, ১৯৫০ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে চীন কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নেয়। কোরিয়ার অভ্যন্তরে জাতিসংঘ কমান্ডের বিপক্ষে চীনা গণ স্বেচ্ছাসেবী অর্থাৎ পিপলস ভলানটিয়ারস এর সদস্যদের রক্ত ঝরানো ছাড়াও চীন কোরিয়ান উদ্বাস্তু এবং শিক্ষার্থীদের অধিগ্রহণ করে আর যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধবিরতি সাক্ষরের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন পূর্ব ব্লকের সদস্যদের সহযোগিতায় চীন উত্তর কোরিয়ার পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পিয়ংইয়ং এ ব্যাপক আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

১৯৫৬ এর আগস্ট দলবিরোধের ঘটনা সম্পাদনা

১৯৫৬ সালে, চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ইয়ান'আন উপদল নামে পরিচিত অগ্রজ চীনা-অভিমুখী ব্যক্তিত্বগণ তৃতীয় কেন্দ্রীয় কমটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কিম ইল-সুংকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালায়। এই ঘটনা আগস্ট দলবিরোধ ঘটনা নামে পরিচিতি পায় এবং চীনের হস্তক্ষেপ এর প্রতি উত্তর কোরিয়ার ভীতির ঐতহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।

১৯৬০ এর পতন সম্পাদনা

১৯৬০ এর দশককে চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের "বিতর্কিত" অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি "সংস্কৃতি বিপ্লব" এর নিন্দা জ্ঞাপন করে আর মাও যেদংকে "মানসিক বিকারগ্রস্থ একজন বয়স্ক নির্বোধ" হিসেবে অভিহিত করে। ১৯৬৬ এর অক্টোবরে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, পিয়ংইয়ং থেকে তার রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠায় এবং রেড গার্ড দংফাংহং পত্রিকায় উত্তর কোরিয়াকে "সংশোধনবাদী" বলে নিন্দা জানায়।

চীন-উত্তর কোরিয়া পারস্পরিক সাহায্য ও বন্ধুতাপূর্ণ সহায়তা চুক্তি সম্পাদনা

১৯৬১ সালে, দুই দেশের মাঝে চীন-উত্তর কোরিয়া পারস্পরিক সাহায্য ও বন্ধুতাপূর্ণ সহায়তা চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যেখানে চীন তার মিত্রের উপর যেকোন ধরনের বাহ্যিক আক্রমণের বিরুদ্ধে যেকোন উপায়ে তাৎক্ষণিক সামরিক ও অন্যান্য সকল প্রকার সহায়তা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। পরবর্তীতে, ১৯৮১ ও ২০০১ সালে দুইবার এই চুক্তি সম্প্রসারিত করা হয়, যার মেয়াদকাল ২০২১ সাল পর্যন্ত।

ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী যুগ সম্পাদনা

২০০৯ এর ১ জানুয়ারি, চীনের শীর্ষ নেতা হু চিনতাও এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল-সুং পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন আর দুই দেশের ৬০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ হিসেবে ২০০৯ সালকে "চীন-কোরিয়ার সম্প্রীতির বছর" হিসেবে ঘোষণা করেন।

২০১২ এর আগস্টে, কিম জং-উন এর খালু জাং সং-থ্যাক, বেইজিংয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হু চিনতাও এর সাথে সাক্ষাত করেন। সেই থেকেই ব্যাপকভাবে প্রতিবেদিত হয় যে, তাদের বৈঠককালীন সময়ে জাং, হু চিনতাও এর কাছে বড় ভাই কিম জং-নামকে কিম জং-উন এর স্থলাভিষিক্ত করতে চেয়ে অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। এ বৈঠক কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ও আইন বিষয়ক কমিশনের তৎকালীন সম্পাদক, চৌ ইয়ংখাং কর্তৃক অভিযুক্ত হিসেবে রেকর্ড করা হয়, যে কিম জং-উনকে এই চক্রান্ত সম্বন্ধে অবহিত করে। ২০১৩ এর ডিসেম্বরে, বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে জাংকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়, একই সাথে ২০১৪ এর জুলাইয়ে জনসমক্ষে চৌ-কে দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তদন্তের আওতায় আনা হয়, এবং ডিসেম্বর ২০১৪তে তাকে গ্রেফতার করা হয়। যেহেতু তারা কিমকে তার শাসনের বিরুদ্ধে করা চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত করতে ব্যর্থ হয়, সেই সাথে চীন তাদের বিশ্বস্ত সমঝোতাকারীর শাস্তি প্রদানের জন্য কিমের উপর অসন্তুষ্ট হয় আর এসব ঘটনাপ্রবাহকে তাই চীনের প্রতি কিম জং-উন এর অবিশ্বাসের সূচনা বলে ধরা হয়।

চীনের এক সরকারি কর্মকর্তার মতে, ২০১৩ সালের ৫ মে, চীনের জেলে নৌকা বাজেয়াপ্ত করার ধারাবাহিকতায়, উত্তর কোরিয়া আরও একটি চীনা জেলে নৌকা "দখল" করে নেয়। ১৬ জন নাবিকসহ এর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া ৬ মিলিয়ন য়্যুয়েন (৯৭,৬০০ মার্কিন ডলার) দাবি করে। ২০১৪ এর ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

২০১৬ এর মার্চে, প্রাদেশিক পত্রিকা পিপলস ডেইলির বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে চীন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এর মিসাইল কারখানা প্রদর্শনে তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে আর একই প্রতিবেদনে উন্মোচিত হয় যে উত্তর কোরিয়ার রাজনীতি, কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং এটি সিরিয়ার অবস্থার সাথে তুলনীয়।

যে কারণে, ২০১৭ সালে চীনের শীর্ষ নেতা সি চিনপিং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এর সাথে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান আর তিনিই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র সাধারণ সম্পাদক যিনি এই সাক্ষাতকারে অনীহা প্রকাশ করেন। এপ্রিল-মে তে উপদ্বীপ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হবার বিষয়টি যদিও দেশটিতে সি চিনপিং এর পরিদর্শনের আয়োজক লি সিয়াওলিনের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করে।

পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্পাদনা

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, পিআরসি ২০০৩ সাল থেকে "ছয়-সদস্য আলোচনা" অংশগ্রহণ করে আসছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইয়াং চিয়েছি বলেন, চীন "অটলভাবে" উত্তর কোরিয়া কর্তৃক অনুষ্ঠিত ২০১৩ পারমাণবিক পরীক্ষার বিরোধিতা জানায়। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে, ইয়াং চিয়েছি এক সাক্ষাতকারে চীনে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, জি জায় র‍্যংকে ব্যক্তিগতভাবে চীনের এই অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেন। ২০১৬ সালে, জানুয়ারিতে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পরপরই চীন এবং উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের তিক্ততা অারও বৃদ্ধি পায়,চীনা মুখপাত্র হুয়া ছ্যুনইং এর বরাতে চীন তখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে, "আমরা দৃঢ়ভাবে উত্তর কোরিয়াকে তার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের সংকল্পে প্রতিশ্রুত থাকার আহ্বান জানাই আর তাদের এমন কোন কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেই যা অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়।" ২০১৬ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উত্তর কোরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে নতুন কিছু চুক্তি আরোপ করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের স্বাধীনতা উদযাপনের এক বিশেষ নৈশভোজের অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব বরিস জনসন মত প্রকাশ করেন যএএ, উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যের ৮০% চীনের নিয়ন্ত্রণে এবং ঐ অঞ্চলের শিথিলতা বজায় রাখতে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিম জং-উনকে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও চীন সরকারের হাতে।

২০১৭ সম্পর্কের অবনতি সম্পাদনা

কোরিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধের প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে, বিরূপ সম্পর্ক তৈরি হয়

২০১৮ সম্পাদনা

ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে, কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সংবাদসংস্থা (কেসিএনএ) পুনরায় চীনের গণমাধ্যমের সমালোচনা করে। কেসিএনএ এর মতে, চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন "পৃথক বিশেষজ্ঞগণের বক্তব্যের উপর পূর্ব নির্ধারিত মন্তব্য প্রকাশ করে আয়োজনের পরিবেশ নষ্ট করে" আর গ্লোবাল টাইমস "পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণে, বাড়া ভাতে ছাই ফেলার মত ঘটনায়" ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পাদনা

চীনের বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় অর্ধেকই হল উত্তর কোরিয়ার প্রতি তার আর্থিক সহায়তা।

ব্যাংকিং সম্পাদনা

২০১৩ সালের ৭মে, চীনের সর্ববৃহৎ বৈদেশিক বিনিময় ব্যাংক, 'ব্যাংক অব চায়না' এবং অন্যান্য চীনা ব্যাংক উত্তর কোরিয়ার প্রধাণ বৈদেশিক বিনিময় ব্যাংকের হিসাব বন্ধ করে দেয়।

বিনিয়োগসমূহ সম্পাদনা

২০১২ তে, চীনের হাইছাং সিইয়াং গ্রুপ কর্তৃক একটি আকরিক লোহার চূর্ণ পরিশোধনাগারে বিনিয়োগকৃত ৪৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ব্যর্থ হয়, চীন একে "একটি দুঃস্বপ্ন" বলে অভিহিত করে। ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কোন প্রকার মিডিয়ার প্রচারণা ছাড়াই চীন নীরবে উত্তর কোরিয়ার প্রতি সব ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রত্যাহার করে। প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে, দুদেশের সরকারের মধ্যবর্তী সম্পর্ক অবনমনই হয়তো এর প্রধান কারণ।

আরও দেখুন সম্পাদনা

চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক উত্তর কোরিয়ার বৈদেশিক সম্পর্ক

তথ্যসূত্র সম্পাদনা