উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকী

উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকী হল এক ধরনের পাক্ষিক প্রকাশনা, যেখানে নির্দিষ্ট শিক্ষা বিষয়ক পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকীগুলি স্থায়ী ও স্বচ্ছ ফোরাম হিসেবে বিভিন্ন গবেষণা উপস্থাপনা, নিরীক্ষণ ও আলোচনা করে থাকে। এদের বেশিরভাগই অভিজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচিত ও একাধিক গবেষণায় উল্লেখিত।[] বিষয়বস্তুগুলো সাধারণত এমন নিবন্ধের আকৃতি ধারণ করে, যা মৌলিক গবেষণা, নিবন্ধ পর্যালোচনা বা বই পর্যালোচনা উপস্থাপন করে। ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশন্স অব দ্য রয়্যাল সোসাইটির প্রথম সম্পাদক হেনরি ওল্ডেনবার্গের মতে, উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকীর উদ্দেশ্য হল গবেষকদের এমন একটি স্থান দেওয়া যেখানে তারা "একে অপরের সাথে নিরপেক্ষভাবে জ্ঞান আদান-প্রদান করতে পারে, এবং নিজেদের স্বাভাবিক জ্ঞানের বিস্তৃত কৌশলে অবদান রাখতে পারে এবং সকল দার্শনিক কলা ও বিজ্ঞানকে নিখুঁত করতে পারে।"[]

কয়েকটি পর্যালোচিত উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকী, ছবির সাময়িকীগুলি অর্থনীতি সম্পর্কিত

"উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকী" শব্দগুচ্ছ সকল শাখার পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; এই নিবন্ধগুলিতে যেসকল বিষয় আলোচনা করা হয় তা সকল উচ্চশিক্ষায়তনিক শাখার সাময়িকীতে আলোচিত হয়। বৈজ্ঞানিক সাময়িকীগুলি, পরিমাণগত সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা সাময়িকীগুলি এবং মানবিক শাখা ও গুণগত সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষনা সাময়িকীগুলি আকার ও কার্যাবলি অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে; তাদের নির্দিষ্ট দিকগুলি পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের ইতিহাসের সর্বপ্রথম উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকী ছিল ফ্রান্সে প্রকাশিত জুর্নাল দে সাভঁ ("পণ্ডিতদের গবেষণা সাময়িকী"; জানুয়ারি ১৬৬৫), এর কিছু পরে ইংল্যান্ডে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশন্স অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি (মার্চ ১৬৬৫) ও মেমোয়ার দ্য লাকাদেমি দ্য সিয়ঁস (১৬৬৬) প্রকাশিত হয়। প্রথম পূর্ণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচিত গবেষণা সাময়িকী ছিল মেডিক্যাল এসেস অ্যান্ড অবজারভেশন্স (১৭৭৩)।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশন্স-এর ১৬৬৫ সালের একটি নিবন্ধ থেকে আদ্রিয়েন ওজু'র "A TABLE of the Apertures of Object-Glasses"

ফ্রঁসোয়া ওদ দ্য মেজেরাই ১৬৬৩ সালে পণ্ডিতদের সভায় কি ঘটছে তা জানানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশিত সাময়িকীর ধারণা প্রথম নিয়ে আসেন। এই উদ্দেশ্যে জুর্নাল লিতেরের জেনেরাল প্রকাশিত হয়, কিন্তু উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। মানবতাবাদী পণ্ডিত দ্যনি দ্য সালো ("সিওর দ্য হেদুভিল" ছদ্মনামে) ও মুদ্রক জঁ ক্যুসোঁ মাজেরাইয়ের ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং জুর্নাল দে সাভঁ প্রতিষ্ঠা করতে ১৬৬৪ সালের ৮ই আগস্ট রাজা চতুর্দশ লুইয়ের নিকট থেকে রাজকীয় সুবিধা গ্রহণ করেন। এই সাময়িকীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত ১৬৬৫ সালের ৫ই জানুয়ারি। এর লক্ষ্য ছিল পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ এবং এর প্রধান চারটি উদ্দেশ্য ছিল:[]

  1. নতুন প্রকাশিত প্রধান ইউরোপীয় বইগুলো পর্যালোচনা করা,
  2. বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করা,
  3. শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের প্রতিবেদন প্রকাশ করা, এবং
  4. ধর্মনিরপেক্ষ ও গির্জা সম্পর্কিত আদালতের এবং ফ্রান্স ও এর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যপদ্ধতি ও আপত্তিপত্রের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এর কিছুদিন পরই রয়্যাল সোসাইটি ১৬৬৫ সালের মার্চ মাসে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশন্স অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি এবং আকাদেমি দে সিয়ঁস ১৬৬৬ সালে মেমোয়ার দ্য লাকাদেমি দে সিয়ঁস প্রতিষ্ঠা করে, যা বৈজ্ঞানিক যোগাযোগের দিকে আরও দৃষ্টি দেয়।[] অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রায় ৫০০ এমন সাময়িকী প্রকাশিত হয়,[] যার অধিকাংশ প্রকাশিত হয় জার্মানি (৩০৪টি), ফ্রান্স (৫৩টি) ও ইংল্যান্ড (৩৪টি) থেকে। এইরকম কয়েকটি প্রকাশনা, বিশেষ করে জার্মান সাময়িকী, স্বল্পকাল স্থায়ী হয় (পাঁচ বছরেরও কম সময়)। এ.জে. মিডোস ধারণা করেন ১৯৫০ সালের মধ্যে সাময়িকীর বিস্তার ১০,০০০ এ এবং ১৯৮৭ সালে ৭১,০০০ এ পৌঁছায়। যাই হোক, মাইকেল মেব বলেন এই ধারণা পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রকাশনার সংজ্ঞা অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এই বৃদ্ধি সময়ের ব্যবধানে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে, ১৮০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গড় বৃদ্ধি ছিল ৩.৪৬%।[]

১৭৩৩ সালে মেডিক্যাল সোসাইটি অব এডিনবরা মেডিক্যাল এসেস অ্যান্ড অবজারভেশন্স চালু করে, যেটি ছিল প্রথম অভিজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচিত সাময়িকী।[] অভিজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা শুরু হয় সাময়িকীর গুণগত মান ও কোথাও পেশ করার প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধির জন্য।[] উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকীর ইতিহাসে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নেচার (১৮৬৯) ও সায়েন্স (১৮৮০) সাময়িকী চালু, ১৯৯০ সালে প্রথম অনলাইন সাময়িকী পোস্টমডার্ন কালচার চালু, একটি সাময়িকীতে প্রকাশনার পূর্বে প্রাকমুদ্রণের বিতরণের জন্য ১৯৯১ সালে আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা, এবং ২০০৬ সালে প্রথম মেগাসাময়িকী পিএলওএস ওয়ান চালু।[]

পাণ্ডিত্যপূর্ণ নিবন্ধ

সম্পাদনা

শিক্ষা সংক্রান্ত দুই ধরনের নিবন্ধ বা রচনা রয়েছে - অনুরোধমূলক ও অযাচিত। অনুরোধমূলক নিবন্ধের ক্ষেত্রে কাউকে সরাসরি যোগাযোগ বা সাধারণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তার কাজ নিবেদন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়, অন্যদিকে অযাচিত নিবন্ধের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি সম্ভাব্য কোন রচনা সরাসরি অনুরোধ ব্যতীতই নিবেদন করে থাকেন।[১০] নিবন্ধ নিবেদনের পর সম্পাদক তা প্রত্যাখ্যান করবেন নাকি অভিজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা করবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সম্পাদক ভিন্ন অন্যান্য পণ্ডিতদের নিকট পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়, যাদের তথ্য গোপন রাখা হয়। প্রত্যেকটি সাময়িকীর সম্পাদকীয় নীতি অনুসারে অভিজ্ঞ পর্যালোচকদের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত দুইয়ের কম নয় এবং তিন বা তারও অধিক হতে পারে। নিবন্ধের বিষয়ের উপর অভিজ্ঞগণ সাময়িকীর সূচিপত্র, ধরন, ও অন্যান্য উপাদানের উপর প্রতিবেদন তৈরি করেন, যা সম্পাদকের প্রকাশনার সিদ্ধান্তে ভূমিকা পালন করে। যদিও এই প্রতিবেদনসমূহ সাধারণত গোপনীয় থাকে, কয়েকটি সাময়িকী ও প্রকাশক জনসমর্থিত পর্যালোচনাও গ্রহণ করে থাকে। প্রকাশক হয় নিবন্ধটি প্রত্যাখ্যান করেন, নয়ত পুনর্পাঠ বা পুনর্নিবেদনের আহ্বান জানান, অথবা নিবন্ধটি প্রকাশের জন্য তা গ্রহণ করেন। গৃহীত নিবন্ধও প্রায়ই মুদ্রণের পূর্বে সাময়িকীর সম্পাদকীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পুনঃসম্পাদনা হয়ে থাকে। অভিজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লাগতে পারে।[১১]

উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকীর তালিকা

সম্পাদনা

সাময়িকী সংক্রান্ত বিশদ তথ্য প্রদানকারী বৃহত্তম তথ্যমালা হল উলরিখস গ্লোবাল সিরিয়ালস ডিরেকটরি। সাময়িকী সংক্রান্ত বিশদ তথ্য প্রদানকারী অন্যান্য তথ্যমালাসমূহ হল মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাসোসিয়েশন ডিরেকটরি অব পিরিয়ডিক্যালস ও জিনেমিক্‌স জার্নালসিক। সাময়িকী হোস্টিংকারী ওয়েবসাইটসমূহ, তথা প্রজেক্ট মিউজ, জেস্টর, পাবমেড, ইনজেন্টা ওয়েব অব সায়েন্স, ও ইনফর্মাওয়ার্ল্ডও সাময়িকীর তালিকা প্রদান করে থাকে। কয়েকটি সাইট সাময়িকীসমূহ মূল্যায়ন করে এবং সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে যেমন - একটি নিবন্ধ পর্যালোচনা করতে একটি সাময়িকীর কত সময় লাগে এবং সাময়িকীটিতে কোন ধরনের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।[১২]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. ব্লেক, গ্যারি; ব্লাই, রবার্ট ডব্লিউ. (১৯৯৩)। The Elements of Technical Writing (ইংরেজি ভাষায়)। ম্যাকমিলান পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ১১৩। আইএসবিএন 978-0-02-013085-7 
  2. The Royal Society: Royal Society journal archive made permanently free to access, 26 October 2011.
  3. মাডর‍্যাক, বেন। "Scholarly Publishing: A Brief History"। আমেরিকান জার্নাল এক্সপার্টস। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৯ 
  4. "Histoire du Journal des Savants", পৃ. ১-২।
  5. "History of Philosophical Transactions – The Secret History of the Scientific Journal"arts.st-andrews.ac.uk (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৯ 
  6. ক্রনিক, ডেভিড এ. (১৯৬২)। "Original Publication: The Substantive Journal"A history of scientific and technical periodicals:the origins and development of the scientific and technological press, 1665-1790। নিউ ইয়র্ক: দ্য স্কেয়ারক্রো প্রেস। 
  7. মেব, মাইকেল (১ জুলাই ২০০৩)। "The growth and number of journals" (পিডিএফ)Serials: The Journal for the Serials Community (ইংরেজি ভাষায়)। ১৬ (২): ১৯১–১৯৭। ডিওআই:10.1629/16191। ১৮ জুন ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৯ 
  8. মুডরাক, বেন। "Scholarly Publishing: A Brief History" (ইংরেজি ভাষায়)। আমেরিকান জার্নাল এক্সপার্টস। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৯ 
  9. "Preface"Medical Essays and Observations (ইংরেজি ভাষায়) (২য় সংস্করণ): v–xvi। ১৭৩৭। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৯ 
  10. গ্রেগরি, গুয়েন মেয়ার (২০০৫)। The successful academic librarian: Winning strategies from library leadersইনফরমেশন টুডে। পৃষ্ঠা ৩৬–৩৭। আইএসবিএন 978-1-57387-232-4 
  11. লামোঁ, মিশেল (২০০৯)। How professors think: Inside the curious world of academic judgmentহার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ১–১৪। আইএসবিএন 978-0-674-05733-3 
  12. উদাহরণস্বরূপ Reviews of Peer-Reviewed Journals in the Humanities and Social Sciences

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা