উইলিয়াম কিড

স্কটিশ ন্যাভিগেটর

ক্যাপ্টেন উইলিয়াম কিড (সি. ১৬৪৫ - ২৩ মে ১৭০১[]) ছিলেন একজন স্কটিশ নাবিক যাকে ভারত মহাসাগর থেকে সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করে ফেরার পথে জলদস্যুতার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। আধুনিক কিছু কিছু ইতিহাসবিদ তার জলদস্যুতার অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন, বরং তারা মনে করেন, তিনি শুধুমাত্র একজন প্রাইভেটিয়ার (শত্রু-জাহাজ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের অধিকারপ্রাপ্ত বেসরকারী জাহাজ) ছিলেন। মূলত কিডের খ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যখন ব্রিটিশ সংসদে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা ও তার আসন্ন বিচার নিয়ে আলোচনা করা হয়।

উইলিয়াম কিড
— জলদস্যু —
ধরনজলদস্যু
জন্ম১৬৪৫
জন্মস্থানডান্ডি, স্কটল্যান্ড
মৃত্যু২৩ মে ১৭০১(১৭০১-০৫-২৩)
মৃত্যুর স্থানওয়াপিং, ইংল্যান্ড
আনুগত্যস্কটল্যান্ড

ক্যাপ্টেন উইলিয়াম কিড হয় পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত জলদস্যু ছিলেন অথবা তিনি সাম্রাজ্যবাদের ভুল সিদ্ধান্তের বলি একজন সফল প্রাইভেটিয়ার ছিলেন। তার চরিত্রের সঙ্গে আলোচিত কিংবদন্তি বা কাল্পনীক কাহিনী বাদে, তার নাম প্রমাণ করার জন্য এটিই যথেষ্ট যে, তিনি অতন্ত্য দক্ষ ও নিয়ম মেনে চলা একজন সৈনিক ছিলেন। কিড স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডিতে ১৬৪৫ সালের জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি সমুদ্র বেছে নেন এবং শীঘ্রই তিনি নিজেকে একজন দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী নাবিকে পরিণত করেন। উচ্চ আদালতের অ্যাডমিরালিটিতে তার জন্মসনদে ১৬৯৫ বা ১৬৯৪ এ তার বয়স ৪১ বলে ‍উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষক ডেভিড ডবসন ১৬৫৪ সালে তার সনদ খুজে পান। তার পিতা ছিলেন ক্যাপ্টেন জন কিড যিনি সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান তার পরিবারকে দেখাশোনা করত। দ্য পাইরেট হান্টার জীবনীতে (২০০২) রিচার্ড জ্যাক বলেন, কিড ড্যান্ডির বাসিন্দা ছিলেন। কিড গিনকের বাসিন্দা ছিলেন এই ধারণা ড. ডবসন বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, এরকম কোন নথি পত্র খোঁজে পাওয়া যায়নি। এটাও ধারণা করা হয় যে তার পিতা চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের মন্ত্রী ছিলেন, তবে এটিও প্রমাণিত হয়নি। ঐ সময়কার গির্জার কোন নথি পত্রেই এরকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় পরবর্তীতে কিড নিউ ইয়র্কে বসবাস করা শুরু করেন।[][] তবে এরকমও তথ্য প্রচলিত যে, তিনি নিজে তার বিখ্যাত সমুদ্রাভিযান পরিচালনার পূর্বে, প্রথম দিকে একটি জলদস্যু জাহাজে নাবিকের সহকারী হিসেবে কিছুকাল কাজ করেছেন।

তার জীবনের প্রথম তথ্য-উপাত্ত খোঁজে পাওয়া যায় ১৬৮৯ সালের পর থেকে, যখন তিনি ফরাসি-ইংরেজ জলদস্যু দলের একজন সদস্য যারা ক্যারিবীয় অঞ্চলে যাত্রা করেছিল। কিড ও অন্যান্য সদস্যরা বিদ্রোহ করেছিল ও জাহাজের ক্যাপ্টেনকে আটক করেছিল এবং ইংরেজ উপনিবেশ নেভিসের দিকে যাত্রা করেছিল। তখন তার জাহাজের নামও পরিবর্তন করে ব্লেজড উইলিয়াম রেখেছিলেন। কিড জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পান। মনে করা হয়, জাহাজের ক্রূরা নির্বাচনের মাধ্যমে বা নেভিস দ্বীপপুঞ্জের শাষক তাকে ক্যাপ্টেন পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন কিড ও ব্লেজড উইলিয়াম ফরাসিদের আক্রমণ থেকে নেভিসকে রক্ষার জন্য ইংরেজদের সাথে ফরাসিদের যে যুদ্ধ হচ্ছিল তাতে যুক্ত হয়ে পরেন। তিনি ইংরেজ কমান্ডার কডরিংটনের দলে যোগ দেন। সরকার তাদের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিনিময়ে কিছু দিতে চান নি বরং তারা ফরাসিদের আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে পাওনা বুঝে নিতে বলেন। কিড ও তার লেকেরা ফরাসি দ্বীপ ম্যারিগ্যালান্টে আক্রমণ করে সেখানকার একমাত্র শহর ধংস্ব ও লুট করে প্রায় ২,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং সংগ্রহ করেন। গ্র্যান্ড এলিয়েন্স যুদ্ধের সময় নিউ ইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস প্রদেশের এক আদেশের উপর ভিত্তি করে কিড শত্রুপক্ষের একজন প্রাইভেটিয়ারকে গ্রেফতার করেন ও কর্তব্য পালনের জন্য তিনি নিউ ইংল্যান্ড উপকূলে কমিশন লাভ করেন।[] এর কিছুদিন পর ক্যারিবীয়তে সফল প্রাইভেটিয়ারিং পরিচালনার জন্য তাকে £১৫০ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এক বছর পর কুখ্যাত জলদস্যু ক্যাপ্টেন রবার্ট কালিফোর্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজের এন্টিগোয়া থেকে তার জাহাজ চুরি করেন যখন তিনি ডাঙায় ছিলেন। ১৬৯৫ সালে ইংল্যান্ডের উইলয়াম তৃতীয় দূর্নীতিগ্রস্থ ব্যাঞ্জামিন ফ্লেচার সরকারকে রিচার্ড কোট (আর্ল অফ বেলুমন্ট) দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন। ব্যাঞ্জামিন ফ্লেচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি জলদস্যুদের কাছ থেকে একশত ডলার ঘুষ গ্রহণ করে তাদের বনিজ্য করার সুবিধা দিয়েছিলেন।[] নিউ ইয়র্ক শহরে কিড ট্রিনিটি চার্চে সক্রিয় ছিলেন।[][]

নিউ ইয়র্কে অবস্থানের সময় ১৬ মে, ১৬৯১ সালে কিড সারা ব্রেডলি কক্স উড নামে একজন সম্ভ্রান্ত ইংরেজ বিধবাকে বিয়ে করেন।[]

বিচার ও মৃত্যুদন্ড

সম্পাদনা
 
শিকলে ঝুলন্ত ক্যাপ্টেন কিড

নিউ ইয়র্কে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে কিড জানতে পারেন জলদস্যুতার অভিযোগে তাকে খুঁজা হচ্ছে এবং ইংরেজ কিছু ম্যান অফ ওয়ারও তাকে খুঁজছে। এটা জানতে পেরে কিড তার সাথে থাকা স্বর্ণ-মুদ্রা ভেসেলটি ক্যরিবীয় সাগরের গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে রেখে তিনি পুনরায় নিউ ইয়র্কের দিকে যাত্রা করেন। তিনি তার কিছু ধন-সম্পদ গার্ডিনারস দ্বীপে জমা রাখেন এই আশায় যে এই সম্পদ আলোচনা চালানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

ম্যাসাচুসেট্স বোস্টনে এক বিনিয়োগকারী ছিলেন। তিনি কিডের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং জলদস্যুতার অভিযোগে তার নিজের বিচার হওয়ারও সম্ভবনা ছিল। তিনি দেখলেন, তিনি কিডকে ইংল্যান্ড-এর হাতে তুলে দিতে পারলে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন। তিনি মিথ্যা ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলে কিডকে প্রলুব্ধ করে বোস্টন নিয়ে আসেন,[] তারপর ৬ জুলাই, ১৬৯৯ সালে তাকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। তাকে স্টোন প্রিজনে স্থানান্তর করা হয় ও তিনি অধিকাংশ সময় নির্জন কারাবাসেই কাটিয়েছেন। তার স্ত্রী সারাও জেলে ছিলেন। জেলখানায় তার অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন এবং সাময়িকভাবে তিনি পাগল হয়েও গিয়েছিলেন।

এরপর এক বছরেরও কিছু বেশি সময় পরে তাকে ইংল্যান্ড পাঠানো হয় পার্লামেন্ট দ্বারা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য। নতুন রক্ষণশীল মন্ত্রণালয় কিডকে যারা নিয়োগ দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের প্রত্যাশা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কিন্তু তিনি কোন প্রকার নাম দিতে অস্বীকৃতি জানান। রাজনৈতিকভাবে কিডকে ব্যবহার করতে না পেরে রক্ষণশীল নেতারা তাকে দূর সাগরে জলদস্যুতা ও উইলিয়াম মুরকে হত্যার দায়ে লন্ডনের নৌবিভাগ হাইকোর্টে অভিযোগ দায়ের করে বিচারের মুখমুখী দাঁড় করান। কিড যখন বিচারের জন্য অপেক্ষায়মাণ ছিলেন তখন তাকে কুখ্যাত নিউগেট কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগার থেকে কিড রাজা উইলিয়ামের কাছে তাকে ক্ষমা প্রদর্শনের অণুরোধ করে কয়েকটি পত্র লিখেছিলেন।

কিডের পক্ষে আইনি লড়াই করার জন্য দুজন আইনজীবী ছিলেন।[১০] তিনি এটি জেনে দুঃখ পান যে তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারে তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগেই (হত্যা ও জলদস্যুতার অভিযোগ ৫টি) তিনি দোষী প্রমাণিত হন। ২৩ মে, ১৭০১ সালে লন্ডনের ওয়াপিং-এর এক্সিকিউসন ডেকে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসি দেওয়ার সময় প্রথমে জল্লাদের দড়ি ছিড়ে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার মৃতদেহ টেম্‌স নদীর উপর টিলবারি পয়েন্টে পরবর্তী তিন বছরের জন্য ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে রাখা হয় এই বার্তা দিতে যে, কারো বিরোদ্ধে জলদস্যুতার অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই পরিণতিই বরণ করতে হবে।[১১]

পদটীকা

সম্পাদনা
  1. "William Kidd"। UXL Encyclopedia of World Biography। ২০০৩। ১৮ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  2. "Pirates: William Kidd"। Genealogy & Family History Achievements Heraldry and Research। ১৭ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  3. "WELCOME TO THE ULTIMATE CAPTAIN WILLIAM KIDD WEB SITE"। ৩০ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  4. "WILLIAM KIDD"। Online Encyclopedia। ২ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  5. "Bellomont, Richard Coote, earl of"। The Columbia Encyclopedia, Sixth Edition। 2001-05। ১৮ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 13 December 2007  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  6. "Trinity Wall Street Historical Timeline"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  7. "Question of the Day: Trinity's Very Own Pirate?"The Archivist's Mailbag। Trinity Church। ১৯ নভেম্বর ২০০৮। ২৬ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  8. Zacks, p. 82-83, 86.
  9. "The Quest for the Armenian Vessel, Quedagh Merchant" (PDF)। AYAS Nautical Research Club। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ 
  10. Zacks, p. 364.
  11. "A brief history of piracy"। Royal Navy Museum। ১২ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১১ 

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  • Douglas Botting (১৯৭৮-০৫-০১)। The Piratesআইএসবিএন 978-0-8094-2650-8 
  • Cordingly, David (1995). Under The Black Flag : The Romance and the Reality of Life Among the Pirates. Harcourt Brace & Company.
  • Hamilton, Cochran, et al. (1961). Pirates of the Spanish Main, 1st Edition. New York: American Heritage Publishing Co., Inc.

আরো পড়ুন

সম্পাদনা
বই
  • Campbell (1853). An Historical Sketch of Robin Hood and Captain Kid. New York.
  • Dalton (1911). The Real Captain Kidd: A Vindication. New York.
  • Gilbert, H. (1986). The Book of Pirates. London: Bracken Books.
  • Howell, T. B., সম্পাদক (১৭০১)। "The Trial of Captain William Kidd and Others, for Piracy and Robbery"। A Complete Collection of State Trials and Proceedings for High Treason and Other Crimes and MisdemeanorsXIV। London: Longman, Hurst, Rees, Orme, and Brown (প্রকাশিত হয় ১৮১৬)। পৃষ্ঠা 147–234। সংগ্রহের তারিখ ২৭ আগস্ট ২০০৮ 
  • Ritchie, Robert C. (1986). Captain Kidd and the War against the Pirates. Cambridge: Harvard University Press.
  • Zacks, Richard (2002). The Pirate Hunter : The True Story of Captain Kidd. Hyperion Books. আইএসবিএন ০-৭৮৬৮-৮৪৫১-৭.
  • Konstan, Angus. (2008) "The Complete History of Piracy". (Osprey Publishing).
নিবন্ধ

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা