আলম আরা

আরদেশির ইরানি পরিচালিত প্রথম ভারতীয় সবাক চলচ্চিত্র

আলম আরা (হিন্দি: आलमआरा; উর্দূ: عالم آراء; অনু. পৃথিবীর আলো; ১৯৩১) আরদেশির ইরানি পরিচালিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র।[][] গল্পটি এক রাজাকে ঘিরে, যার দুই স্ত্রী—নববাহার ও দিলবাহার, কিন্তু কেউই মা হতে পারেননি। একদিন এক ফকির (মুহাম্মদ ওয়াজির খান) ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে নববাহার এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন, যার নাম হবে কামর (মাস্টার ভিথাল)। তবে শর্ত হল—তার ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর যদি নববাহার কামরের চাওয়া একটি বিশেষ হার না খুঁজে পান, তাহলে ছেলেটি মারা যাবে। এদিকে, রাজা জানতে পারেন যে দিলবাহার সেনাপতি আদিলের (পৃথ্বীরাজ কাপুর) প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ক্রোধে, রাজা আদিলকে বন্দি করেন এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন। পরে সেই নির্বাসিত নারী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় আলম আরা (জুবেইদা)।

আলম আরা
আলম আরা চলচ্চিত্রের প্রচ্ছদ
পরিচালকআরদেশির ইরানি
প্রযোজকইম্পেরিয়াল মুভিটোন
রচয়িতাজোসেফ ডেভিড
উর্দূ: মুন্সি জহির
শ্রেষ্ঠাংশে
সুরকার
ফিরোজশাহ এম. মিস্ত্রি
চিত্রগ্রাহকউইলফোর্ড ডেমিং
আদি এম. ইরানি
সম্পাদকএজরা মীর
প্রযোজনা
কোম্পানি
ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানি
পরিবেশকসাগর মুভিটোন
মুক্তিমার্চ ১৪, ১৯৩১
স্থিতিকাল১২৪ মিনিট
দেশভারতভারত
ভাষাহিন্দুস্তানি

ইরানি ১৯২৯ সালের মার্কিন আংশিক-সবাক চলচ্চিত্র শো বোট দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আলম আরা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ছবিটির গল্প বোম্বের নাট্যকার জোসেফ ডেভিডের একই নামের নাটক থেকে নেওয়া হয়। মাত্র ₹৪০,০০০ বাজেটে (২০২৩ সালের হিসাবে যা প্রায় ₹১.২ কোটি বা ১,৪০,০০০ মার্কিন ডলারের সমান) নির্মিত এই ছবির মূল চিত্রগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন আদি এম. ইরানি, এবং এটি চার মাসের মধ্যে বোম্বেতে সম্পন্ন হয়। যেহেতু স্টুডিওটি রেললাইনের কাছে ছিল, ট্রেনের শব্দ এড়াতে বেশিরভাগ শুটিং রাতের বেলায় করা হয়। চিত্রগ্রহণ শেষ হওয়ার পর, আর্দেশির ইরানি একক-সিস্টেম রেকর্ডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবিটির শব্দ সংযোজন সম্পন্ন করেন। ছবিটির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ফিরোজশাহ মিস্ত্রি ও বি. ইরানি।

আলম আরা ১৪ মার্চ ১৯৩১ সালে মুক্তি পায় এবং বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য অর্জন করে। সমালোচকরা ছবিটি প্রশংসা করেন, বিশেষ করে অভিনয় ও গানগুলোর জন্য, যদিও কিছু সমালোচক শব্দ রেকর্ডিং নিয়ে আপত্তি জানান। তবে এসবের বাইরেও, এটি ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে শুধু দর্শকদের মন জয় করেনি, বরং ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মাইলফলক হয়ে ওঠে এবং আর্দেশির ইরানির ক্যারিয়ারেও বড় ভূমিকা রাখে। দুঃখজনকভাবে, ছবিটির কোনো প্রিন্ট বা গ্রামোফোন রেকর্ড সংরক্ষিত নেই, যার ফলে এটি বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর একটি। তবে এর কিছু স্থিরচিত্র ও প্রচ্ছদ এখনো টিকে আছে। ২০১৭ সালে, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট একে ভারতের নির্মিত হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করে।

পটভূমি

সম্পাদনা
 
আলম আরা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

এক রাজা ও তার দুই স্ত্রী, নববাহার ও দিলবাহার, নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন এক ফকির নববাহারকে ভবিষ্যদ্বাণী করে জানান যে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন, তবে ছেলেটি ১৮ বছর বেঁচে থাকার জন্য তাকে একটি বিশেষ হার খুঁজে বের করতে হবে, যা একটি মাছের গলায় বাঁধা থাকবে এবং মাত্র একবার রাজপ্রাসাদের হ্রদে দেখা যাবে। নববাহার পরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় কামর। এদিকে, দিলবাহার গোপনে রাজপ্রাসাদের সেনাপতি আদিলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাজা এই সম্পর্কে জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন, কিন্তু দিলবাহার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে আদিলই প্রথম তাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। এতে রাগান্বিত হয়ে রাজা আদিলকে বন্দি করেন এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মেহর নিগারকে রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করেন। পরে নিগার এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় আলম আরা। কিন্তু যখন এক শিকারি তাকে জানায় যে তার স্বামী আদিল অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তখন শোকে তিনি মারা যান। শিকারি পরে ছোট্ট আলম আরাকে দত্তক নেন।

দিলবাহার নববাহারের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং ফকিরের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে জানতেন। কামরের ১৮তম জন্মদিনে যখন সেই হারটি হ্রদে ভেসে ওঠে, তখন তিনি গোপনে তা বদলে একটি নকল হার রেখে দেন। ফলস্বরূপ, কামর মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার পরিবার শেষকৃত্য না করে ফকিরকে খুঁজতে বের হয়, কারণ তারা বুঝতে পারেন কিছু একটা ভুল হয়েছে। রহস্যময়ভাবে, কামর প্রতি রাতে জীবিত হন যখন দিলবাহার তার গলায় থাকা হার খুলে ফেলেন, কিন্তু সকালে আবার মারা যান যখন তিনি তা পরে নেন। অন্যদিকে, আলম আরা জানতেন যে তার নির্দোষ বাবা আদিল অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ হয়েছেন এবং তাকে মুক্ত করার সংকল্প নেন। এক রাতে তিনি রাজপ্রাসাদে গিয়ে কামরকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান এবং তার প্রেমে পড়ে যান। একপর্যায়ে রাজপ্রাসাদের সবাই দিলবাহারের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন এবং অবশেষে আসল হারটি উদ্ধার করেন। আদিল কারাগার থেকে মুক্তি পান, এবং শেষ পর্যন্ত কামর ও আলম আরা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে থাকেন।[]

অভিনেতা ও চরিত্র

সম্পাদনা

অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিলু, সুশীলা, এলাইজার, জগদীশ শেঠি, এল. ভি. প্রসাদ ও ইয়াকুব।[]

প্রযোজনা

সম্পাদনা
 
আরদেশির ইরানি ১৯৩১ সালের আলম আরা চলচ্চিত্রের শব্দগ্রহণের সময়

১৯২৯ সালে বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) এক্সেলসিয়র থিয়েটারে হ্যারি এ. পোলার্ডের আংশিক-সবাক রোমান্টিক নাটক শো বোট দেখার পর ইরানি তার পরবর্তী প্রকল্প হিসেবে একটি সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, যা তিনি নিজেই পরিচালনা ও প্রযোজনা করবেন।[] যদিও এর আগে তিনি কখনও এ ধরনের চলচ্চিত্র বানাননি, তবুও তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোনো পূর্ববর্তী চলচ্চিত্রের ধাঁচ অনুসরণ না করে একেবারে নতুন কিছু করবেন।[১০] পরবর্তীতে, এই প্রকল্পের নাম রাখা হয় আলম আরা, যা ইরানি তার ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানির (আইএফসি) ব্যানারে প্রযোজনা করেন। এই স্টুডিও তিনি তাবু-ভিত্তিক প্রদর্শনী উদ্যোক্তা আবদুলালি এসুফালির সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[১১] চলচ্চিত্রের গল্পটি বোম্বের পারসি নাট্যকার জোসেফ ডেভিডের একই নামের নাটক থেকে গৃহীত হয়, আর চিত্রনাট্য লেখেন ইরানি নিজেই।[১২] সংলাপ লেখা হয়েছিল হিন্দুস্তানি ভাষায়, যা হিন্দিউর্দুর মিশ্রণ।[১৩]

মূল চরিত্রের জন্য প্রথমে রুবি মায়ার্সকে নির্বাচন করা হয়েছিল, যিনি ইরানির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তবে, তিনি ছবির ভাষা বলতে না পারায় তাকে বাদ দেওয়া হয়, যা তাকে হতাশ করেছিল। এরপর তিনি এক বছরের জন্য অভিনয় থেকে বিরতি নেন এবং হিন্দুস্তানি শেখার উপর মনোযোগ দেন।[১৪] প্রথমে ইরানি চেয়েছিলেন নবাগত মেহবুব খান ছবির নায়ক হোন, কিন্তু পরে তিনি এমন একজন অভিনেতাকে নিতে চাইলেন যিনি বাণিজ্যিকভাবে বেশি সফল হতে পারেন। এ কারণে এই সুযোগটি পান মাস্টার ভিথাল, যিনি ভারতীয় নির্বাক চলচ্চিত্রের অন্যতম সফল তারকা ছিলেন। পরে মেহবুব খান স্বীকার করেন যে এতে তিনি বেশ হতাশ হয়েছিলেন।[১৫] মাস্টার ভিথাল যখন আলম আরা তে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি সারধি স্টুডিওর সাথে চুক্তি বাতিল করেন, যেখানে তিনি তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন। এতে আইনি সমস্যা তৈরি হয়, কারণ স্টুডিও কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল তিনি তাদের সঙ্গে করা চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন। তবে, তার আইনজীবী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহায়তায় তিনি মামলায় জয়ী হন এবং আইএফসিতে যোগ দেন, যেখানে তিনি আলম আরার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।[১৬]

আলম আরা চলচ্চিত্রটি মূলত ব্যবসায়ী শেঠ বদ্রীপ্রসাদ দুবে অর্থায়ন করেছিলেন, যার বাজেট ছিল মাত্র ৪০,০০০ (ইউএস$ ৪৮৮.৯৩)[১৭] ছবিটির মূল চিত্রগ্রহণ সম্পন্ন করেছিলেন আদি এম. ইরানি, যা বোম্বের জ্যোতি স্টুডিওতে চার মাসের মধ্যে শেষ হয়েছিল। শুটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমেরিকার বেল ও হাওয়েল কোম্পানি থেকে কেনা হয়। চলচ্চিত্র গবেষক ভগবান দাস গর্গর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইরানি স্বীকার করেন যে, তিনি ছবিটির নির্মাণের সময় এটি সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিলেন।[১৮] চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন এইচ. এম. রেড্ডি, ভরুচা, গিদওয়ানি এবং পেসি কেরানি।[১৯] যেহেতু স্টুডিওটি একটি রেললাইনের পাশেই অবস্থিত ছিল, তাই শুটিংয়ের সময় ট্রেনের আওয়াজ যেন না আসে, সে জন্য বেশিরভাগ দৃশ্য রাত ১টা থেকে ৪টার মধ্যে ধারণ করা হয়।[] ইরানির ভাষ্যমতে, কয়েক মিনিট পরপরই ট্রেন চলে যেত, তাই শব্দদূষণ এড়াতে অভিনয়শিল্পীদের চারপাশে গোপনে মাইক্রোফোন রাখা হত।[]

চলচ্চিত্রের শব্দ প্রযুক্তির দায়িত্বে ছিলেন ইরানি ও রুস্তম ভরুচা। ইরানির আরেকটি প্রযোজনা সংস্থা, ইম্পেরিয়াল স্টুডিওর ব্যবস্থাপক ও আইনজীবী ছিলেন ভরুচা।[২০] শুটিং শুরুর আগে তারা আমেরিকান শব্দ বিশেষজ্ঞ উইলফোর্ড ডেমিং থেকে শব্দ রেকর্ডিংয়ের মৌলিক ধারণা শেখেন। ডেমিং যখন মুম্বাইয়ে শব্দযন্ত্র সরবরাহ করতে আসেন, তখন তিনি এর জন্য  ১০০ (ইউএস$ ১.২২) দাবি করেন। ইরানির কাছে এটি তখন বড় অঙ্কের অর্থ মনে হয়েছিল, যা তিনি পরিশোধ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ও ভরুচা নিজেদের প্রচেষ্টায় শব্দ রেকর্ডিং সম্পন্ন করেন। তারা ‘টানার’ নামক একক-ব্যবস্থার রেকর্ডিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যাতে চিত্রগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ ধারণ করা যায়।[২১] শুটিং শেষ হওয়ার পর চলচ্চিত্রটির সম্পাদনা করেন এজরা মির, এবং চূড়ান্ত চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ছিল ১০,৫০০ ফুট (প্রায় ৩,২০০ মিটার)।[২২] ২০১২ সালে আউটলুক পত্রিকা জানায়, আলম আরার পুরো কলাকুশলী এই ঐতিহাসিক সিনেমার অংশ হতে পেরে আনন্দিত ছিলেন এবং তারা তুলনামূলক কম পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেও প্রস্তুত ছিলেন।[২৩]

সাউন্টট্র্যাক

সম্পাদনা

আলম আরা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত অ্যালবাম সারেগামা দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে সঙ্গীত দেন ফিরোজশাহ এম. মিস্ত্রি এবং বি. ইরানি এবং এতে ৭টি গান রয়েছে:

  • দে দে খোদা কে নাম পে পেয়ারে: ওয়াজির মোহাম্মদ খান
  • বাদলা দিলওয়াএগা ইয়া রাব তু সিতামগারো সে: জুবাইয়া [২৪]
  • রুঠা হে আসমা গুম হো গেয়া মাহতাব: জিল্লু
  • তেরি কাতিল নিগাহো নে মারা
  • দে দিল কো আরাম আয়ে সাকি গুলফাম
  • ভার ভার কে জাম পিলা জা সাগার কে চালানেওলা
  • দারাস বিনা মারে হে তারসা নেইনা পেয়ারে

চলচ্চিত্রের প্রথম গান দে দে খোদা কে নাম পে পেয়ারে মুক্তির পর খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এটিই হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রথম গান হিসেবে স্বীকৃত হয়। ছবিতে বাকি গানগুলোর বেশিরভাগই গেয়েছিলেন জুবেইদা। তবে চলচ্চিত্রের ক্রেডিট তালিকায় সুরকার বা গীতিকার কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। ফিরোজশাহ মিস্ত্রির পুত্র কেরসি মিস্ত্রি দাবি করেন যে, সব গানই তার পিতা সুর করেছিলেন, অন্যদিকে চলচ্চিত্রের বুকলেটে বি. ইরানিকে সুরকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইরানি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি নিজেও নিশ্চিত নন কে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন, কারণ তখন তার কাছে শুধুমাত্র একজন হারমোনিয়ামতবলা বাদক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি স্বীকার করেন যে, ছবির গানগুলোর গীত রচনাও তিনিই করেছিলেন।

মুক্তি ও প্রতিক্রিয়া

সম্পাদনা
 
ম্যাজেস্টিক সিনেমায় আলম আরা চলচ্চিত্রের একটি প্রচারমূলক প্রচ্ছদ

আলম আরা ১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ বোম্বের ম্যাজেস্টিক সিনেমায় মুক্তি পায় এবং টানা আট সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়।[২৫] ছবিটি সাগর মুভিটোন দ্বারা পরিবেশিত হয়। আইএফসি অফিস পরিচারক রমেশ রায় চলচ্চিত্রের রিল নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে আসেন। ২০০৬ সালে হিন্দুস্তান টাইমস-এর সাক্ষাৎকারে মায়াঙ্ক শেখর বলেন, "সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার পরও চলচ্চিত্র সম্বন্ধে কথা বলতেই থাকেন, কারণ তারা এমন একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলেন, জেতাতে কথাও শোনা যাচ্ছে!"[২৬] দৈনিক ভাস্কর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সকাল ৯টা থেকে মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষা করত, যদিও প্রথম শো শুরু হতো দুপুর ৩টায়। ভিড় সামলাতে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে লাঠিচার্জ করার অনুমতিও দেওয়া হয়।[২৭] টাইমস অব ইন্ডিয়া-তে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে শর্মিষ্ঠা গুপ্তু লিখেছেন, "আলম আরা ম্যাজেস্টিক সিনেমায় বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, এবং প্রেক্ষাগৃহ প্রতিদিন দর্শকে পরিপূর্ণ থাকছে।"{{sfn|Gooptu|2013} এটি দিল্লির পাহাড়গঞ্জের ইম্পেরিয়াল সিনেমায় প্রদর্শিত হওয়া প্রথম চলচ্চিত্রও ছিল।[২৮]

চলচ্চিত্রটি জে. জে. মদনের পরিচালিত সঙ্গীতনির্ভর ছবি শিরিন ফারহাদ-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়ে, যা আলম আরা-র মুক্তির প্রায় দুই মাস পর প্রকাশিত হয়। যদিও ছবিটির বক্স-অফিস আয়ের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তবে বহু ইতিহাসবিদের মতে এটি ভালো ব্যবসা করেছিল। ২০০৩ সালে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া অব হিন্দি সিনেমা অনুসারে, আলম আরা শিরিন ফারহাদ-এর তুলনায় বেশি সফল হয়।[২৯] ২০০৬ সালে দ্য হিন্দু এক প্রতিবেদনে জানায় যে, এটি এক "তাৎক্ষণিক হিট" হয়ে ওঠে।[] একই মত প্রকাশ করেন রয় আর্মস, যিনি তার ১৯৮৭ সালের বই থার্ড ওয়ার্ল্ড ফিল্ম মেকিং অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট-এ চলচ্চিত্রটিকে "অসাধারণ জনপ্রিয় সাফল্য" বলে বর্ণনা করেন।[৩০] ২০১২ সালে আউটলুক পত্রিকার একজন লেখক বলেন যে, আলম আরা-র বাণিজ্যিক সাফল্য সেই সময়কার নির্বাক চলচ্চিত্রের তারকাদের ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা দেয়, বিশেষত মাস্টার ভিথাল, যিনি হিন্দুস্তানি ভাষায় সাবলীল ছিলেন না।[২৩]

সমালোচকরা সাধারণত চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে ইতিবাচক মত দেন, বিশেষত অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করেন, যদিও কেউ কেউ শব্দ রেকর্ডিংয়ের সমালোচনা করেন। তাদের মতে, এটি "ভারতীয় প্রযোজনার সাধারণ কিছু ত্রুটির অংশীদার ছিল" এবং পূর্ববর্তী ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলোর সামাজিক মূল্যবোধ প্রচারের ধারা থেকে সরে আসে।[] ২ এপ্রিল ১৯৩১ সালে দ্য বম্বে ক্রনিকল আরদেশির ইরানির "সুচিন্তিত" পরিচালনার প্রশংসা করে এবং ভিতাল, জুবেইদা ও পৃথ্বীরাজ কাপুরের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করে, যা রিভিউয়ারের মতে নির্বাক চলচ্চিত্রের তুলনায় বেশি নাটকীয়তা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।[৩১] ১৯৩২ সালের জুন মাসে আমেরিকান সিনেমাটোগ্রাফার ম্যাগাজিনে চলচ্চিত্রটির উপর কড়া সমালোচনা করা হয়, যেখানে বলা হয় যে, "পুরো ছবিতে মৌলিক বিষয়গুলোর অন্ধ অন্বেষণ স্পষ্ট ছিল" এবং ল্যাবরেটরির প্রসেসিং ও শব্দ রেকর্ডিং ছিল ছবিটির সবচেয়ে বড় সমস্যা।[৩২] দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া-এর এক লেখক উল্লেখ করেন যে, অভিনেতাদের মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলার অভিজ্ঞতা কম থাকায় তাদের সংলাপ অনেক সময় চিৎকারের মতো শোনাত।[৩২] ভারতীয় টকি (১৯৩১ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ফিল্ম ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন) চলচ্চিত্রটিকে "টকিজ যুগের জন্ম মুহূর্ত" বলে অভিহিত করে।[৩৩]

ঐতিহ্য

সম্পাদনা
 
চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে বিট্ঠল এবং জুবেইদা। পরে ২০১১ সালে গুগল একটি ডুডলে এই দৃশ্যটি পুনরায় তৈরি করে।

আলম আরা ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। এটি ১৯৩০-এর দশকের শুরুর ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উত্থানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।[৩৪] ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, "... নির্বাক যুগে বিদেশি চলচ্চিত্রের যে আধিপত্য ছিল, বিশেষত আমেরিকান চলচ্চিত্র যেগুলো ভারতীয় বাজারের বড় অংশ দখল করেছিল, আলম আরা-এর মাধ্যমে সেই প্রভাব কমতে শুরু করে ... এই পরিবর্তনের ফলে একদল নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতা উঠে আসেন, যারা পরবর্তী যুগের পথপ্রদর্শক হন।"[৩৫] ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান ফিল্ম মিউজিক বইয়ের লেখিকা নাসরিন মুনী কবীর মনে করেন, আলম আরা ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সঙ্গীতনির্ভর করে তুলেছে, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রের থেকে ভারতীয় সিনেমাকে স্বতন্ত্র করেছে। ১৯৯৯ সালে দ্য রাফ গাইড টু ওয়ার্ল্ড মিউজিক-এর লেখক মার্ক এলিংহাম লিখেছেন যে এই চলচ্চিত্রের সাফল্য ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করেছে।[৩৬] ২০০৩ সালে গবেষক শোমা চ্যাটার্জি বলেছিলেন, "আলম আরা মুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণ করল—এখন স্থানীয় ভাষায় চলচ্চিত্র তৈরি করা সম্ভব, যা দর্শক সহজেই বুঝতে পারবে, এবং গান ও সঙ্গীত চলচ্চিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে।"[৩১]

এই চলচ্চিত্রটি ইরানির ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এবং তাকে "ভারতীয় সবাক চলচ্চিত্রের জনক" হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।[৩৭] এর সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে প্রযোজক বীরেন্দ্রনাথ সরকার আলম আরা-এর জন্য ব্যবহৃত রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেন এবং মার্কিন বিশেষজ্ঞ উইলফোর্ড ডেমিংকে কলকাতায় কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান।[৩৮] ইরানি এই চলচ্চিত্রের সেট ব্যবহার করে তার পরবর্তী প্রযোজনা কালিদাস নির্মাণ করেন, যা ১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ভারতের প্রথম বহুভাষী চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।[৩৯]

২০১৩ সালে এনডিটিভি-এর "ভারতীয় চলচ্চিত্রের ৪০টি প্রথম ঘটনা",[৪০] ২০১৪ সালে ফিল্মফেয়ার-এর "১০০ ফিল্মফেয়ার ডেস",[৪১] এবং ২০১৭ সালে মিন্ট-এর "ভারতীয় সিনেমার ৭০টি আইকনিক চলচ্চিত্র" তালিকায় আলম আরা স্থান পায়।[৪২] ২০১১ সালে গুগল এই চলচ্চিত্রের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে একটি বিশেষ ডুডল প্রকাশ করে, যেখানে মাস্টার ভিতাল ও জুবেইদার ছবি ব্যবহৃত হয়েছিল।[৪৩] লেখিকা রেণু সরন ২০১৪ সালে প্রকাশিত ১০১ হিট ফিল্মস অব ইন্ডিয়ান সিনেমা বইয়ে এই চলচ্চিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।[৪৪] একই বছর, "ভারতীয় চলচ্চিত্রের সূচনা" নামে একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়, যেখানে আলম আরা-এর প্রচ্ছদ অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৪৫] এই চলচ্চিত্রটি অন্তত চারবার পুনর্নির্মিত হয়েছে—১৯৪২ ও ১৯৬৭ সালে চিত্রপু নারায়ণ রাও তেলুগু ভাষায় এবং ১৯৫৬ ও ১৯৭৩ সালে নানুভাই ভাকিল হিন্দি ভাষায় এটি পুনরায় নির্মাণ করেন।[৪৬]

বর্তমানে আলম আরা-এর কোনো পূর্ণাঙ্গ কপির অস্তিত্ব নেই, তবে কিছু স্থিরচিত্র ও প্রচ্ছদ সংরক্ষিত রয়েছে।[৪৭] দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে বিভিন্ন সূত্র, এমনকি উইকিপিডিয়াতেও ভুলভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০০৩ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগারে আগুনে পুড়ে চলচ্চিত্রটির শেষ কপি নষ্ট হয়ে যায়। তবে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা পি. কে. নাইয়ার ২০১১ সালে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সংরক্ষণাগারটি ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার আগেই আলম আরা হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি আরও জানান, ওই আগুন মূলত প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির নাইট্রেট নেগেটিভগুলোর ক্ষতি করেছিল, তবে ইরানি ও তার ছেলে শাপুরজির কাছ থেকে আলম আরা-এর বেশ কিছু স্থিরচিত্র তিনি পেয়েছিলেন।[৪৮] নাইয়ার অনুমান করেন যে ১৯৫০-এর আগের ৭০ শতাংশ ভারতীয় চলচ্চিত্র হারিয়ে গেছে।[৪৯] ২০১৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শ্রুতি নারায়ণস্বামী আলম আরা-কে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষণা করেন।[৫০]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Goddard, John. "Missouri Masala Fear not, St. Louisans: You don't need to go to Bombay to get your Bollywood fix" Riverfront Times, St. Louis, Missouri, July 30, 2003, Music section.
  2. Gokulsing, K. (২০০৪)। Indian popular cinema: a narrative of cultural change। Trentham Books। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 1-85856-329-1  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  3. Miglani 2006
  4. Miglani 2006; Pradeep 2006.
  5. Pradeep 2006
  6. Pradeep 2006; Kapoor & Gahlot 2004, p. 10.
  7. Nihalani 2018; Gulzar, Nihalani & Chatterjee 2003, p. 280.
  8. Pradeep 2006; Miglani 2006; Gazdar 1997, p. 9.
  9. Garga 1980, pp. 11–12; Bali 2015.
  10. Garga 1980, পৃ. 11–12।
  11. Valicha 1996, p. 54; Rajadhyaksha 1996, pp. 398–403; Gulzar, Nihalani & Chatterjee 2003, p. 170.
  12. Garga 1980, pp. 11–12; Bose 2006, p. 74; Gulzar, Nihalani & Chatterjee 2003, p. 170; Dev 2013; Pradeep 2006; Miglani 2006.
  13. Gulzar, Nihalani এবং Chatterjee 2003, পৃ. 45।
  14. Raheja ও Kothari 1996, পৃ. 13।
  15. Chatterjee 2002, p. 14; Bose 2006, p. 98.
  16. Bali 2015; Ahmed 2012.
  17. Mid Day 2019
  18. Garga 1980, pp. 11–12; Bali 2015; The Hindu 2012; Bose 2006, p. 194; Advani 2006, p. 138; Garga 1996, p. 72.
  19. Narasimham 2006; Garga 1980, p. 11.
  20. Ahmed 2012; Garga 1980, p. 11.
  21. Garga 1980, পৃ. 11।
  22. British Film Institute; Miglani 2006.
  23. Ahmed 2012
  24. Alam Ara ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে Film History.
  25. Bombay: The City Magazine 1988, p. 36; Ojha 2002, p. 22.
  26. Shekhar 2011
  27. Daily Bhaskar 2017; Goddard 2003.
  28. Soofi 2015
  29. Rajadhyaksha & Willemen 2014, p. 253; Gulzar, Nihalani & Chatterjee 2003, p. 170; News18 2016.
  30. Armes 1987, পৃ. 111।
  31. Gulzar, Nihalani এবং Chatterjee 2003, পৃ. 170।
  32. Garga 1996, পৃ. 72।
  33. Chakravorty 2016, পৃ. 130।
  34. Gulzar, Nihalani এবং Chatterjee 2003, পৃ. 561।
  35. Gooptu 2013
  36. Ellingham 1999, পৃ. 105।
  37. Ramachandran ও Rukmini 1985, পৃ. 63।
  38. Bose 2006, পৃ. 46।
  39. Poorvaja 2016; Narasimham 2012; Narasimham 2010.
  40. Chakravarty 2013
  41. Filmfare 2014
  42. Mint 2017
  43. Business Insider 2011
  44. Saran 2014, পৃ. 1–2।
  45. Indo-Asian News Service 2014
  46. Rajadhyaksha & Willemen 2014, p. 253; Murthy 2012, p. 20.
  47. Press Trust of India 2008; Stardust 2003.
  48. Jain 2011
  49. The Hans India 2013
  50. Narayanswamy 2017

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা