অপারেশন খরচাখাতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিহারীদের অংশগ্রহণে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সংঘটিত একটি হত্যাযজ্ঞের অভিযানের নাম। নীলফামারীর সৈয়দপুরে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাড়োয়ারিরা এ হত্যাযজ্ঞের অসহায় বলি।[১]

পটভূমি সম্পাদনা

নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শহরে বিপুলসংখ্যক মাড়োয়ারি বসবাস করতেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, যাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের বহু আগেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরে এসে এই শহরে থেকে যান।

ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামলাল আগরওয়ালা জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাত থেকে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর সৈয়দপুরের বিহারিরা বাঙালি নিধন শুরু করে। মহল্লায়-মহল্লায় ঢুকে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল শহরের মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা। ২৪ মার্চ থেকে সৈয়দপুর শহরের বাঙালি পরিবারগুলো পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

সৈয়দপুরের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে স্থানীয় মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের শীর্ষব্যক্তিত্ব তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনাপ্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকে ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের অদূরে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাড়োয়ারিপট্টিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিহারিরা মাড়োয়ারিদের বাসায় বাসায় চালায় লুটতরাজ।

১৯৭১-এর ৫ জুন পাকিস্তানি বাহিনী মাইকে ঘোষণা শুরু করে। ওই ঘোষণায় বলা হয়, যাঁরা হিন্দু মাড়োয়ারি তাদের নিরাপদ স্থান ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে। একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই ট্রেনটি ১৩ জুন সকালে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চিলাহাটি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের জলপাইগুড়িতে পৌঁছাবে। এ ঘোষণায় মাড়োয়ারিপট্টিতে স্বস্তি নেমে আসে। ১৩ জুন রেলওয়ে স্টেশনে ঠিকই আসে বিশেষ ট্রেনটি। সৈয়দপুর রেল-কারখানা থেকে ট্রেন র‌্যাকটি সকাল আটটায় স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। গাদাগাদি করে বসতে থাকেন বৃদ্ধ-যুবক, তরুণ-শিশু ও সকল পর্যায়ের নারীরা। ওই ট্রেন থেকে কমপক্ষে ২০ জন তরুণীকে নামিয়ে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের মিলিটারি জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে।[২]

হত্যাকাণ্ড সম্পাদনা

১৩ জুন সকাল ১০টায় ট্রেনটি ছাড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী তপন কুমার দাস কাল্ঠু ও বিনোদআগরওয়ালার বর্ণনায় জানা যায়, ট্রেন ছাড়ার পর সব জানালা-দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিলো। ট্রেনট ধীরগতিতে দুই মাইলের মতো পথ অতিক্রম করার পর শহরের গোলাহাটের কাছে এসে থেমে যায়। এরপর কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে ভেতরে রামদা হাতে কয়েকজন বিহারি প্রবেশ করে। একইভাবে প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ে রামদা হাতে বিহারিরা। বাহিরে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনী গোটা এলাকা ঘিরে রাখে, যাতে কেউ পালাতে না পারে। বিহারিরা প্রধানত রামদা দিয়ে কুপিয়েই হত্যাযজ্ঞ করে। ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয় অপারেশন খরচাখাতা।[১]

এভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন খরচাখাতায় ৪৩৭ জন নিরীহ হিন্দু মাড়োয়ারিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনোরকমে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান প্রায় ১০ জন যুবক। তারা ট্রেন থেকে নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দিনাজপুর হয়ে ভারতে পালিয়ে যান।[২]

স্মারক সম্পাদনা

১৩ জুন ওই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি ধরে রাখতে গোলাহাটে বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ইশতিয়াক, আহমাদ (২০২১-০৬-১৪)। "অপারেশন খরচাখাতা: নৃশংসতা, পৈশাচিকতার আরেক নাম"The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৪ 
  2. http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2010-06-15/news/71002 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৯-১২-০৫ তারিখে , অপারেশন খরচাখাতা, এম আর আলম | তারিখ: ১৫-০৬-২০১০