অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি
দেশবাংলাদেশ
ধরনবেসরকারি
প্রতিষ্ঠিত১৮৯০
অবস্থানAbdul Hamid Road, Pabna 6600
অন্যান্য তথ্য
পরিচালকঅঞ্জন চৌধুরী পিন্টু

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সম্পাদনা

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির শুরুটা ১৮৯০ সালে। তখন জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার ছিলেন গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরী। তাঁর ছেলে বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলে অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামেই এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা। শুরুতে ১৩ শতাংশ জমির ওপর দুই কক্ষের একটি ভবন নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন পাবনা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর এফ বিজ। তখনো পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকের সুবিধার জন্য লাগানো হয়েছিল ১৩ টাকা আট আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইট। সন্ধ্যার পর সে আলোয় পড়াশোনা করতেন পাঠকেরা। ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারটি খোলা থাকে পাঠকের জন্য।[১][২]

ইতিহাস সম্পাদনা

পাবনা জেলা প্রতিষ্ঠার ৬১ বছর পর ১৮৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সোয়াশ বছর আগে ঝিরিঝিরি নারকেল পাতার ছাউনিতলের রূপশ্রীমণ্ডিত এ শহরের জনজীবনের বৈচিত্র্যের ইতিহাস সন্ধান আমাদের নানাভাবে ভাবিত করে। ইতিহাসের জানালায় মুখ রাখলে দেখা যায়, শহরের প্রাণকেন্দ্রে আবদুল হামিদ সড়কের পূর্বে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি’। সময়ের সিঁড়িতে পা রেখে সমকালীন মানুষের জীবন ও কীর্তিকথা ভাবতে ভাবতে মনে প্রার্থনা জাগে ‘আমারে ফিরায়ে লহ সেই সর্বমাঝে। ’ নানা স্মৃতি-স্মারকের মুখোমুখি দাঁড়ালে ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল। ’

পাবনার কীর্তিমান জমিদার তাঁতিবন্দের চৌধুরী বংশ। চাটমোহরের বোঁথড় গ্রামে ছিল তাদের আদি বাসস্থান। তখন তাদের উপাধি ছিল সান্যাল। একসময় দারিদ্র্যের তাড়নায় এ বংশের পূর্বপুরুষ রাধাবল্লভ চাটমোহর থেকে সুজানগর উপজেলার চণ্ডীপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর তাঁতিবন্দের ব্রাহ্মণদের সাহায্য-সহযোগিতায় তিনি এখানে স্থায়ী আবাস গড়েন। রাধাবল্লভের এক পুত্র উপেন্দ্রনারায়ণ সে সময় বাংলা ও উর্দুতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে নাটোর কালেক্টরির সেরেস্তাদার পদে এবং দুলাইয়ের রহিমউদ্দিন চৌধুরী পেশকার পদে নিযুক্ত হন। উনিশ শতকের শুরুতে সেরেস্তাদাররা পুলিশ বিভাগেও প্রধান কর্মচারী ছিলেন।

উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীই প্রকৃতপক্ষে তাঁতিবন্দের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার পুত্র ও পৌত্র যথাক্রমে গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরী ও গুরু গোবিন্দ চৌধুরী তাঁতিবন্দের ভবানীপুরের নন্দী ও হেমরাজপুরের সরকার উপাধিক কায়স্থ জমিদারের স্থাবর সম্পত্তি কেনেন। জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর তিন পুত্র গুরু গোবিন্দ, দুর্গা গোবিন্দ ও বরদা গোবিন্দ। এই তিন পুত্রের মধ্যে প্রথম জমিদারি বণ্টন শুরু হয়। দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর সময়কালে এই বংশের যথেষ্ট উন্নতি হয়। বরদা গোবিন্দ চৌধুরী ও দুর্গা গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন নিঃসন্তান। তাদের বিধবা পত্নী যথাক্রমে চন্দ্রমণি ও মনমোহনী দেব্যাদের মধ্যে এবং তাদের দত্তকদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় জমিদার বংশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বরদা গোবিন্দের দত্তক পুত্র অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরী নিজের নামানুসারে পাবনা শহরে ১৮৯০ সালে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে কালের ইতিহাসে এক অক্ষয় সেতু গেঁথে দেন। মতান্তরে এ কথাও জানা যায় যে, জ্ঞানদা গোবিন্দ পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে ১৮৮৯ সালে লাইব্রেরি নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেন। তিনি গ্রন্থাগারটির পরিসর বড় করেন। ১৮৯০ সালে ভাইসরয় লর্ড ল্যান্স ডাইনের (১৮৮৮-৯৪) শাসনামলে জ্ঞানের ভুবন এই অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির দ্বারোদ্ঘাটনের কথা আজও অনেকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।

এ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার আগে পাবনায় আরও কয়েকটি গ্রন্থাগার ছিল। তবে এ গ্রন্থাগারের মহিমা আজও প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার সময়ে পৌরসভার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। তখন ইছামতী নদীর প্লাবনে শহরের পাঁচ থেকে ছয় মাইল পাকা রাস্তা ভেঙে যায়। বাজিতপুর ঘাটে তখন স্টিমার ভেড়ে। ত্রিশোত্তর তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকা ভাসে সেখানে।

এক টাকায় যখন চাল পাওয়া যেতে ১৩ সের, তখন সেই ১৮৯০ সালের পাবনায় এই অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি ও অস্ট্রেলীয় মিশনারি গির্জা গড়ে ওঠে। সে সময়কার রোকনপুর পরগনায় (বর্তমানে গোপালপুর মৌজা) ১৩ শতাংশ জমির ওপর দুটি কক্ষের একটিতে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়। পাশে ছিল একটি টিনের ঘর। জানা যায়, গ্রন্থাগারটির প্রথম সম্পাদক সীতানাথ অধিকারী ছিলেন এর দখলদার। তখন এ জমি ছিল নিষ্কর। উল্লেখ্য, ১৯৩৪ থেকে খাসমহলে (তাড়াশ বিল্ডিং) এক টাকা খাজনা দিতে হতো। লাইব্রেরির জন্মলগ্নে পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর এফ বিজ পদাধিকার বলে এর সভাপতি ছিলেন।

জমিদার বংশের অনেকে ছিলেন কবি-সাহিত্যিক। তারা গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য বইপত্র দান করেন। পাশাপাশি আরও অনেক বিদ্যানুরাগী গ্রন্থাগারে বইপুস্তক দান করেন। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। শুরুতে কিছু বাংলা, সংস্কৃতি ও ফারসি কেতাব নিয়ে শুরু হয় এর পথপরিক্রমা। আরও স্থান পায় রাজা রামমোহন, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালী প্রসন্ন, মেহেরুল্লাহ সিংহ, গিরিশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল সেন, মধুসূদন দত্ত, হেমনবীন চন্দ্র, বিহারীলাল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয় কুমার বড়াল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায়, মান কুমারী বসু, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শেখ ফজলল করিম, অমৃতলাল বসু, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদা প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখের রচনাসম্ভার। কালক্রমে শত লেখকের হাজারো বইয়ে লাইব্রেরিটি সমৃদ্ধ হতে থাকে।

১৯২৮ সালের ৮ জুলাই এক অধিবেশনে ‘অল বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন’-এর মেম্বার শ্রেণিভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও এই সমিতির শাখা খোলা হয়। তখন লাইব্রেরির সদস্য বাড়ানো ও পাবনার শিক্ষিত জনগণের কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় এক হাজার কপি আবেদন মুদ্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তখনও পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকরা লাইব্রেরির ১৩ টাকা আট আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইটে পড়াশোনা করত। ১০০ টাকা ব্যয়ে লাইব্রেরিতে বিদ্যুৎ আসে ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে। বিদ্যুৎব্যবস্থা লাইব্রেরির কর্মোদ্যম বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৭ সালে লাইব্রেরির সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ রায় ও পূর্ণচন্দ্র রায় দায়িত্ব নেন সাহিত্য সম্মেলনের। ১৯৩৮ থেকে ১৫ দিন অন্তর সাহিত্য সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৩৯ সালে লাইব্রেরিতে আসেন বাংলার দুই মন্ত্রী শ্রীশচন্দ্র নন্দী (কর্মজীবন মন্ত্রিত্ব দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীকালে তিনি কলিকাতা বঙ্গীয় পরিষদের সভাপতি হন) ও নলিনীরঞ্জন সরকার। ওই একই বছরে অনুষ্ঠিত হয় ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তখন ৬৪ টাকা ১০ আনা পাঁচ পাই ব্যয়ের এ অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে আসেন সাহিত্যিক পরিমল কুমার গোস্বামী ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট থেকে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, রবীন্দ্র পরিষদ, পাবনা সাহিত্য চক্র ও পূর্ণিমা সম্মেলনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টাউন হলে সপ্তাহব্যাপী প্রথম রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়। অনুষ্ঠানমালায় আটটি বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ রচিত হয়। এ বছরই প্রথম প্রতি রোববার বেলা ৩টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নারীদের জন্য পাঠকক্ষ খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

উপযুক্ত পরিবেশ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক নথিপত্র। তাই ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রক্ষা করতে স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরীকে অনুরোধ জানানো হয়। স্কয়ার কর্তৃপক্ষ পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ভৌতগত অবকাঠামোর নির্মাণকাজটি সম্পন্ন করে। ফলে দেশসেরা বেসরকারি লাইব্রেরির তকমা পায়।[১][২][৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. নিউজ, শেয়ার বিজ। "অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি"শেয়ার বিজ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০৭ 
  2. "উৎসবমুখর পরিবেশে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির ১২৬তম বর্ষপূর্তি পালন" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৬-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০৭ 
  3. "গ্রন্থাগারের বয়স ১২৭ বছর"প্রথম আলো। ২০১৮-০২-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০৭