অনুপমা হোসকেরে

ভারতীয় পুতুলনাচ পরিচালক এবং ভরতনাট্যম শিল্পী

অনুপমা হোসকেরে একজন ভারতীয় পুতুলনাচ পরিচালক এবং ভরতনাট্যম শিল্পী। তিনি পুতুলনাচের মঞ্চায়নের জন্যে চিত্রনাট্য রচনা, পুতুল তৈরি এবং পরিবেশনা করে থাকেন। পুতুলনাচকে ভালোবেসে এবং এই শিল্পটির প্রসারের জন্যে তিনি তাঁর ইঞ্জিনীয়ারিং পেশা ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৯ সালে তিনি নিজের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'ধাতু' তৈরি করেন।[] ধাতুর মাধ্যমে তিনি ছোটদের মধ্যে পুতুলনাচের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে চলেছেন। পুতুলনাচ শিল্পে তাঁর অবদানের জন্যে ২০১৮ সালে তিনি সঙ্গীত নাটক অকাদেমী পুরস্কারে ভূষিত হন।[]

অনুপমা হোসকেরে
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাভরতনাট্যম শিল্পী, পুতুলনাচ পরিচালক

শৈশব ও ব্যক্তিগত জীবন

সম্পাদনা

শৈশবেই অনুপমা বাবাকে হারান এবং মা ও দিদার তত্ত্বাবধানে বড়ো হয়ে ওঠেন। তাঁর বড়ো হওয়ার জগৎ জুড়ে ছিল সঙ্গীত, নৃত্য, পড়াশোনা এবং পুতুল। তখন থেকেই তাঁর পুতুলের প্রতি তীব্র ভালোবাসা তৈরি হয়। অনুপমা ভারতের বেঙ্গালুরুর বি এম এস কলেজ অফ এঞ্জিনীয়ারিং থেকে স্নাতক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি-লং বিচ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি পুতুলনাচ শিল্পী এবং স্থপতি বিদ্যাশঙ্কর হোসকেরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ রয়েছেন।

কর্মজীবন

সম্পাদনা

ভরতনাট্যম

সম্পাদনা

অনুপমা একজন ভরতনাট্যম শিল্পী এবং তিনি 'পবনসুতম ভজে হাম' এবং 'ভারতী দেবীয়া নেনে নেনের' মতো ব্যালে নৃত্যরচনা এবং পরিবেশনা করেছেন। তিনি বর্তমানে কর্ণাটকের সংগীত নৃত্য একাডেমির সদস্য।

পুতুলনাচ

সম্পাদনা

তিনি কর্ণাটকের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গোম্বেয়াতা পুতুলনাচ শিল্পী এম আর রঙ্গারাও-য়ের অধীনে। এছাড়াও তিনি চেক প্রজাতন্ত্রেও আধুনিক পুতুলনাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।[]। অনুপমা আধুনিক পুতুলনাচের প্রশিক্ষণ নিলেও,মঞ্চে প্রধানত ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ দেখাতেই পছন্দ করেন। তিনি তাঁর পুতুলনাচের মাধ্যমে যে গল্পগুলি বর্ণনা করেন তা মূলত মহাকাব্যগুলি এবং পুরাণের উপর ভিত্তি করে তৈরি। তাঁর নিজের কথায় "আমি সাধারণত পুরাণের কোন গল্প নিয়ে পড়াশোনা করি যতক্ষণ না আমি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বুঝতে পারি। একবার আমি এই জায়গায় পৌঁছানোর পরে, এটি আমাকে রস প্রবাহ দেয় যা আমার কাজের মূল ভিত্তি; আমার ভরতনাট্যমের প্রশিক্ষণ এই রসপ্রবাহ বুঝতে আমাকে সহায়তা করে। গল্প প্রস্তুত হয়ে গেলে, আমি চরিত্র চিত্রায়ণের কথা ভাবতে শুরু করি" []

পুতুল প্রস্তুতি

সম্পাদনা

পুতুল প্রস্তুত করার জন্যে অনুপমা প্রধানত বিভিন্ন রকম কাঠের সংমিশ্রণ ব্যবহার করেন। সাধারণত, বুরুগা বা শাল্মলী গাছের রেশম সুতি কাঠ দিয়ে পুতুলের মুখ তৈরি করা হয়। অনুপমার পুতুলের বৈশিষ্ট্য হল বড়ো চোখ সহ বড়ো মুখ। দেহ এবং বিভিন্ন দেহসন্ধিগুলো স্থানীয় আলে, নিম এবং হোঙ্গে নামক স্থানীয় ঘন কাঠের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। মুখ এবং দেহ প্রস্তুত হয়ে গেলে চরিত্রটির বৈশিষ্ট্যগুলির মূল অনুভূতি মুখাবয়বে খোদাই করে প্রকাশ করা হয়। পুতুলের হাতগুলিও চরিত্রের মূল উদ্দেশ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যেমন নর্তকীর জন্য মুদ্রা, যোদ্ধার জন্য মুষ্টি, স্বর্গীয় সত্তার জন্য আলপদ্ম, দেবতাদের ত্রিপতাকা ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। সমস্ত প্রধান চরিত্রগুলির জন্যে পোশাক এবং আভরণও নির্মাণ করেন অনুপমা এবং তাঁর সহযোগীরা। এছাড়াও অনুপমার কাছে ভারত ও বিশ্বের পাঁচ সহস্রাধিক পুতুলের সংগ্রহ রয়েছে যা বেঙ্গালুরুতে প্রদর্শিত হয়।

অনুপমা বিশ্বাস করেন যে পুতুলনাচের মাধ্যমে ভারতের প্রাচীন গল্প এবং জ্ঞানকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌছে দেওয়া সম্ভব। পুরাণ, উপনিষদ এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন গল্পগুলিকে সকলের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্যে এবং বর্তমান প্রজন্মকে এই প্রাচীন শিল্পকলাটির প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে ২০০৪ সালে তিনি তার স্বামী বিদ্যাশঙ্কর হোসকেরের সহযোগিতায় বেঙ্গালুরুতে 'ধাতু' নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির সুচনা করেন। []। 'ধাতু'-র মাধ্যমে ২০টিরও বেশি পুতুলনাচের প্রযোজনা করা হয়েছে; ধাতুর নিজস্ব গ্যালারিতে পুতুলের প্রদর্শনী রয়েছে; এছাড়া ১১ বছর ধরে আন্তর্জাতিক পুতুলনাচ উৎসব এবং ২৪ বছর ধরে নবরাত্র মহোৎসব পালিত হয়ে চলেছে। অনুপমা এবং তার প্রতিষ্ঠান ধাতু- ইংরিজি, কন্নড় এবং সংস্কৃত ভাষায় পুতুলনাচের প্রদর্শনী করে থাকেন। তাঁরা বাল্মীকি, কালিদাস, ব্যাসদেবের রচনা এবং পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন গল্পের উপর ভিত্তি করে পুতুলনাচের চিত্রনাট্য তৈরি করে থাকেন। []

বিখ্যাত প্রযোজনা

সম্পাদনা

অনুপমার প্রথম প্রযোজনা ছিল হরিশ্চন্দ্র, যেখানে তিনি তার গুরু রঙ্গনাথ রাওয়ের তৈরি করা পুতুল ব্যবহার করেছিলেন। [] তার বিখ্যাত কিছু প্রযোজনা হলঃ

  • হরিশচন্দ্র
  • রাজসূয় যজ্ঞ
  • অষ্টাবক্র
  • ভক্ত প্রহ্লাদ
  • বিজয়নগর বৈভব
  • শ্রীকৃষ্ণ পারিজাত
  • আভরণ - ভরতণাট্যম এবং পুতুলনাচের যুগলবন্দী
  • অভিজ্ঞান শকুন্তলম
  • মালবিকাগ্নিমিত্রম
  • রামায়ণ সপ্তস্বর
  • ভাস্করাচার্য্যের লীলাবতী- যা আই আই টি বম্বের একটি অঙ্করে কনফারেন্সে প্রদর্শিত হয়েছিল

সম্মাননা

সম্পাদনা
  • অনুপমা হোসকেরে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পুতুলনাচ শেখানোর জন্য ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি পেয়েছিলেন। পঞ্চতন্ত্রের কাহিনীগুলিকে যিনি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, সেই কবি লা ফন্টেইনের জন্মবার্ষিকী উদযাপনের জন্যে অনুপমা পঞ্চতন্ত্রের একটি গল্পের পুতুলনাচ প্রযোজনা করেছিলেন।
  • পুতুলনাচে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ, ২০১৮ সালে তিনি সঙ্গীত নাটক অকাদেমী পুরস্কার লাভ করেন

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা