১৯৪৪ বোম্বে বিস্ফোরণ

ভারতে ১৯৪৪ সালে ঘটা বিষ্ফোরণ

১৪ এপ্রিল ১৯৪৪-এ বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) বন্দরের ভিক্টোরিয়া ডকে মালবাহী জাহাজ এসএস ফোর্ট স্টিকিন-এ বিস্ফোরণ ঘটে। এটি অনেক বেল তুলা(বেল তুলা পরিমাপের একক), সোনা এবং ১,৪০০ টন সমরাস্ত্র বহন করছিল। অতঃপর জাহাজটিতে আগুন ধরে যায় এবং দুটি বড় বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। যার ফলে এর ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আশপাশের জাহাজ এবং এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ৮০০-১৩০০ মানুষের তাৎক্ষণিক প্রাণহানি ঘটে।[১] ৮০০০০ মানুষ গৃহহীন হয়[২] এবং ৭১ জন অগ্নিনির্বাপক যোদ্ধা প্রাণ হারান।[৩]

বোম্বে বিস্ফোরণ
বোম্বে পোতাশ্রয় হতে উদিত ধোঁয়া
তারিখ১১ এপ্রিল, ১৯৪৪
সময়১৬:১৫ ভারতীয় প্রমাণ সময় (১০:৪৫ ইউটিসি)
স্থানভিক্টোরিয়া ডক, বম্বে, ব্রিটিশ ভারত
স্থানাঙ্ক১৮°৫৭′১০″ উত্তর ৭২°৫০′৪২″ পূর্ব / ১৮.৯৫২৭৭৭° উত্তর ৭২.৮৪৪৯৭৭° পূর্ব / 18.952777; 72.844977
কারণজাহাজে আগুন
ক্ষতিগ্রস্ত
৮০০+ নিহত
৩,০০০ আহত

যুদ্ধজাহাজ,সমুদ্রযাত্রা এবং কার্গো সম্পাদনা

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রিন্স রুপার্টে ১৯৪২ সালে ৭,১৪২ জি.আর.টি(গ্রস রেজিস্টার টন) ওজনের এসএস ফোর্ট স্টিকিন নির্মাণ করা হয়। আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে হাডসন বে কোম্পানির অধিকৃত প্রত্যন্ত এলাকা বা আউটপোস্ট ফোর্ট স্টিকিনের(বর্তমানে র‍্যাঙ্গেল) নামানুসারে জাহাজটির নামকরণ করা হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে বার্কেনহেড থেকে যাত্রা শুরু করে জিব্রাল্টার, পোর্ট সাঈদ এবং করাচি হয়ে ১২ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে বোম্বে পৌঁছায়। এর কার্গোতে ২৩৮ টন মাইন, শেল এবং বিস্ফোরক মজুদ ছিল। এছাড়াও এটি "সুপারমেরিন স্পিটফায়ার" বায়ুযান বহন করছিল, যা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হয়। তদুপরি এর মধ্যে কাঁচা তুলা, প্রক্রিয়াজাত লোহা, কাঠ, তেল, জ্বালানি প্রভৃতি মজুদ ছিল। প্রায় ৮,৯০,০০০ ইউরো মূল্যের সোনার বার ৩১টি ক্রেটে সুরক্ষিত রাখা হয়। এর মধ্যে ৮৭,০০০ বেল তুলা এবং লুব্রিকেটিং তেল করাচিতে পৌঁছানো হয়। জাহাজের ক্যাপ্টেন আলেক্সান্দার নাইস্মিথ এত জিনিস জাহাজে একসাথে রাখায় প্রতিবাদ করেছিলেন।[৪] রেলপথে তুলা পরিবহনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যবসায়ীদের সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। [৫] ১২ এপ্রিল পৌঁছানোর ৪৮ ঘণ্টা পরও এর মাল জাহাজ থেকে নামানো হয়নি।

বিস্ফোরণ সম্পাদনা

বিস্ফোরণের দিন দুপুর দুইটায় জাহাজের ক্রুদের সতর্ক করা হয়, দুই নং হোল্ডের কোথাও আগুন লেগেছে। জাহাজের ক্রু, ডকে থাকা অগ্নিনির্বাপক দল কিংবা অগ্নিযান (ফায়ারবোট) কেউই সেই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়নি।জাহাজে ৯০০ টন পানি ঢাললেও ঘন ধোঁয়ার কারণে আগুনের প্রকৃত উৎস শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আগুনের প্রচণ্ড তাপে পানি ফুটে বাষ্পে পরিণত হতে শুরু করে । [৬]

৩:৫০ ঘটিকায় জাহাজটি খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৬ মিনিট পরে একটি বিশাল বিস্ফোরণে এটি দ্বিখণ্ডিত হয়। এরপরে আরেকটি বিস্ফোরণ হয়, যা বোম্বের কোয়ালা মানমন্দিরে রক্ষিত ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রে নিরীক্ষা করা যায়। ১,৭০০ কিলোমিটার দূরের সিমলা শহরেও ভূমিকম্প হয়। দাহ্য পদার্থ জাহাজ থেকে ছিটকে পড়ে নিকটস্থ বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১১টি নিকটবর্তী জাহাজের সলিলসমাধি হয়। আশি কিলোমিটার দূরেও বিস্ফোরণের শব্দ শুনা যায়।বোম্বের অনেক অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এলাকা বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়।

সংবাদ সম্পাদনা

১৫ এপ্রিল ১৯৪৪-এ জাপানি-নিয়ন্ত্রিত রেডিও পুরো ঘটনাপ্রবাহের সংবাদ পরিবেশন করে। যুদ্ধকালীন সেন্সরশিপের কারণে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এর খবর প্রকাশিত হয়। ১৯৪৪ সালের ২২শে মে টাইম ম্যাগাজিন এ ঘটনা প্রকাশ করে। [৭] সিনেমাটোগ্রাফার সুধীশ ঘটক এটি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করলে ব্রিটিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে, যদিও এর কিছু অংশ পরবর্তীতে সাধারণ জনগণ দেখতে পান।

ক্ষয়ক্ষতি সম্পাদনা

  • ডক সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ২৩১ জন মারা যান, যাদের ৬৬ জনই ছিলেন অগ্নিনির্বাপক যোদ্ধা।
  • কমপক্ষে ৫০০-১৩০০ নাগরিক মৃত্যুবরণ করেন।
  • ২,৫০০ জন নাগরিক আহত হন।
  • ১৩টি জাহাজ হারিয়ে যায়; অনেকগুলো জাহাজ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়।
  • ৩১টি কাঠের ক্রেন ধ্বংস হয়ে যায়, প্রত্যেকটিতে ৪টি করে সোনার বার ছিল।
  • ৫০,০০০ টন শিপিং ধ্বংস এবং ৫০,০০০ টন শিপিং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • ৫০,০০০ টন শস্যদানা নষ্ট হয়, যা পরবর্তীতে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দেয়।

উদ্ধার অভিযান সম্পাদনা

ভারতীয় সরকার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেন জ্যাকসনকে জাহাজ উদ্ধারকরণ অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। ১৯৪৪ সালের ৭ই মে তিনি এবং চিফ পেটি অফিসার চার্লস ব্রাজিয়ার বোম্বে বন্দরে আসেন। সেখানে তারা তিন মাস কাজ করেন। পরবর্তী জীবনে তারা স্বীয় কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পদোন্নতি লাভ করেন।[৮]

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পাদনা

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন দিন সময় লাগে। ৮,০০০ ব্যক্তি সাত মাস পরিশ্রম করে ৫০,০০০ টন ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে বন্দরকে আগের অবস্থায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়।

বিস্ফোরণের পরে করা তদন্তে বলা হয়, তুলাগুলোই ছিল আগুনের মূল উৎস। আগুন লাগা থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণ করা পর্যন্ত সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করে:

  • তুলা এবং সমরাস্ত্র একই সাথে মজুদ রাখা
  • "বিপজ্জনক কার্গো রয়েছে" - এ মর্মে লাল পতাকা প্রদর্শন না করা
  • জাহাজ থেকে বিস্ফোরক সরাতে দেরি করা
  • বাষ্পপ্রবেশক ( স্টিম ইনজেক্টর) ব্যবহার করে আগুন না নেভানো
  • স্থানীয় ফায়ার ব্রিগেডকে যথাসময়ে অবহিত না করা

৬,০০০ প্রতিষ্ঠান এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৫০,০০০ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে। সরকার সম্পূর্ণ ঘটনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়।

ডকের নিচে খনন করে প্রায়ই অক্ষত সোনার বার পাওয়া গেছে। অতি সম্প্রতি ২০১১ সালে এরূপ একটি সোনার বার পাওয়া গেছে। [৯] বাইকুল্লায় মুম্বাই ফায়ার ব্রিগেড তাদের সদর দপ্তরে শহিদ অগ্নিনির্বাপক যোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। তাদের স্মৃতিতে প্রতিবছর ১৪ থেকে ২১শে এপ্রিল ভারতে জাতীয় অগ্নিনিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করা হয়। [১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. http://www.history.com/this-day-in-history/explosion-on-cargo-ship-rocks-bombay-india
  2. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-33105898
  3. http://www.mumbaimirror.com/mumbai/others/Thats-how-Mumbais-fire-brigade-Rolls/articleshow/51354019.cms
  4. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০১৩-০১-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২২ 
  5. Ennis, John (১৯৫৯)। The Great Bombay Explosion 
  6. https://web.archive.org/web/20120204060500/http://www.merchantnavyofficers.com/bomEx.html
  7. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৯ জুলাই ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০২০ 
  8. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ জুলাই ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০২০ 
  9. https://web.archive.org/web/20111230054616/http://mumbaimirror.com/article/15/20111024201110240334556615f57c7a8/Live-45kg-shell-dredged-from-WWII-ship%E2%80%99s-ruins.html
  10. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০ এপ্রিল ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০২০