হাবিবুর রহমান আজমি

ভারতীয় দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত

হাবিবুর রহমান আজমি ( উর্দু : حبیب الرحمن الاعظمی, ১৯০১ —১৯৯২) ছিলেন একজন ভারতীয় ইসলামি পণ্ডিত, হানাফি সুন্নি আলেম। হাদীসফিকহের উপর তার বিশেষত্ব ছিল। তিনি বিলুপ্তপ্রায় হাদিস গ্রন্থ মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক সংকলনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, এটি সংকলনে তিনি প্রায় ২০ বছর ব্যয় করেছেন।[১][২][৩]


হাবিবুর রহমান আজমি
حبیب الرحمن الاعظمی
px300
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম
হাবিবুর রহমান

১৯০১
মৃত্যু১৯৯২
ধর্মইসলাম
জাতীয়তাভারতীয়
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
আন্দোলনদেওবন্দি
প্রধান আগ্রহহাদীসফিকহ
উল্লেখযোগ্য কাজমুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক (সংকলক)
যেখানের শিক্ষার্থী
ছদ্মনামআবুল মা’সির
মুসলিম নেতা
শিক্ষক
শিক্ষার্থী

জন্ম ও বংশ সম্পাদনা

হাবিবুর রহমান ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৯ হিজরি) উত্তর প্রদেশের মৌ জেলার আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজম গড়ের দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে এবং তার পূর্বপুরুষদের আজমি বলা হত। তার পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ সাবির ইনায়াতুল্লাহ, যিনি একজন ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ এবং তার সময়ের বুদ্ধিজীবী ছিলেন।[৪]

শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

হাবিবুর রহমান নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এখানে তার উস্তাদ ছিলেন আবদুল গাফফার বিন আবদুল্লাহ , (মৃ. ১৩৪১ হি.) যিনি রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহির (মৃ. ১৩২৩ হি.) শিষ্য। তিনি তার নিকট প্রায় পাঁচ বছ শিক্ষা লাভ করেন। এরপরে হাবিবুর রহমান দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন, তবে অসুস্থতার কারণে এখানে পড়াশুনা করতে পারেন নি। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি মাজাহির উলুম, সাহারানপুরে পড়াশোনা চালিয়ে যান তবে জ্ঞানের তীব্র সন্ধানের জন্য তিনি আবার দেওবন্দে ফিরে আসেন। যেখানে তিনি আবিদ শাহ কাশ্মীরি, শাব্বির আহমেদ উসমানি এবং মাওলানা আসগর হুসাইন থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। কিন্তু জাতীয় ও স্বাধীনতার আন্দোলনের কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখানে নিয়মিত লেখাপড়া শুরু করেন।[৫]

কর্মজীবন সম্পাদনা

শিক্ষা সমাপ্ত করার পরে তিনি দারুল উলুম মৌতে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং সেখানে ইসলামি সাহিত্য ও আইনশাস্ত্রের পাঠদান শুরু করেন।  তিনি ১৩৩৪ হিজরিতে মাজাহির উলুম, সাহারানপুরের কাছ থেকে শিক্ষকতার প্রস্তাব পেয়েছিলেন যা তিনি গ্রহণ করেছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে শিক্ষকতা করেন।[৫]


তিনি ১৩৩৭ হিজরিতে তার জন্মস্থান মৌতে ফিরে আসেন এবং মিফতাহুল উলুমে শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এখানে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে সহিহ বুখারী এবং তিরমিজী পড়িয়েছিলেন। মৌতে তিনি প্রায় ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন; হিন্দুস্তান, আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলির সহস্রাধিক শিক্ষার্থী তার কাছে শিক্ষা লাভ করেন। ১৩৬৯ হিজরিতে তিনি শিক্ষাদানকে বিদায় জানিয়ে গবেষণা শুরু করেন।[৬]

রাজনীতি সম্পাদনা

হাবিবুর রহমান ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নিজেকে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ রাজনীতির জন্য আমন্ত্রণ করলে তিনি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি খুব সহজে বিপুল ভোটে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। সদস্য হওয়ার পরে তাকে তার আবাসন পরিবর্তন করে লাখনৌতে চলে যেতে হয়। তার জ্ঞানকে কাজে লাগাতে আবুল হাসান আলী নদভী তাঁকে দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামায় শিক্ষকতার প্রস্তাব দেন, তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করে ১ বছর বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করে যান।

তারপরে তার সদস্যপদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনি আর্থিক চাপের মুখে পড়েন। আবুল হাসান আলী নদভী তাকে পারিশ্রমিক গ্রহণের প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি আর রাজনীতিতে অংশ নেন নি বলে তার রাজনৈতিক জীবন ছিলে মাত্র পাঁচ বছরের। একইভাবে তিনি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে লাখনৌ থেকে সরাসরি তার নিজ গ্রামে চলে আসেন।[৭]

শিষ্য সম্পাদনা

হাবিবুর রহমান আজমির খ্যাতির মূল কারণ ছিল তার রচনামূলক পরিষেবাদি, যা কেবল আরব দেশগুলিতে নয় আফ্রিকানইউরোপীয় দেশগুলিতেও তার জনপ্রিয়তার জন্য সহায়ক ছিল। তার প্রায় তিরিশ বছর শিক্ষকতার সময়ে তিনি বহু বিদ্বান ব্যক্তিত্ব প্রস্তুত করেছিলেন। মাওলানা মনজুর নুমানী, ডাঃ মোস্তফা আঘজামি, মুফতি যুবায়ের উদ্দিন মিফতাহির মত অনেকেই সরাসরি তার ছাত্র ছিল। তিনি আফগানিস্তান, আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপ এবং উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বের ধর্মতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে “ওস্তাদুল হাদীস” উপাধি অর্জন করেছিলেন। সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আব্দুল আজিজ বিন বাজ, সিরিয়ার আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, লেবাননের সাবেক প্রধান মুফতি শেখ খালিদসহ অনেকেই তার সরাসরি ছাত্র না হলেএ তার কাছে হাদিস পড়ানোর অনুমতি লাভ করেছেন।[৮]

সেবা সম্পাদনা

তিনি আবদুল আল রাজ্জাক আল সানানির মুসান্নাফকে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। [৯]

উর্দু বই সম্পাদনা

  1. নাসরাতুল হাদীস ফিল ইহতিজাজ বিল হাদীস ওয়াল রাদ আলা মুনকারে হাদীস: এই বইটিতে হাদীস ও মুনকারে হাদিসের সমালোচনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এই বইটি আরবী ভাষায় অনুবাদ করেছেন মিশরীয় মুহাদ্দিস মুহাম্মদ আওয়ামা
  2. ইয়ানুল হুজ্জাজ: এই বইয়ের দুটি খণ্ড রয়েছে যাতে প্রাসঙ্গিক মানচিত্র সহ হজ্বযাত্রীদের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা রয়েছে।
  3. আল শারিখুল হাকিকি
  4. রাকাত আল তারাবিহ মাজেল বরদা আনোয়ারুল মাসাবীহ
  5. আল আহকামুল মাজমুয়া ফি হুকমে তালাকাতুর মাজমুয়া
  6. তাহকীক আহলে হাদীস
  7. দাফায়া আল মাজাদিলা ঘান আয়াত আল-মুবাহেলা
  8. ইরশাদ আল সাকালাইন বাজাওয়াব ইতিখাদ আল ফারিকাইন
  9. আল তাকাইদ আল সাদেদ আলা আল তাফসীর আল জাদেদ
  10. আবদাল আজাদারী, তাগজিয়া দরি, রহবারে হজ্ব
  11. রাদে তাহকীকুল কালাম: (এই বইটি এখনও প্রকাশিত হয়নি)
  12. আহলে দিল কি দিলওয়াজ বাতেন
  13. রিজালুল বুখারী: সৈয়দ সুলাইমান নদভীর পরামর্শে বুখারীর রেওয়ায়েত সম্পর্কিত তিনি এই বইটি লিখেছিলেন
  14. দস্তাকরে আহলে শরফ: এটি হাবিবুর রহমান আজমির সর্বশেষ উর্দু গ্রন্থ যা ১৪০৬ হিজরিতে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ন্যায্য উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা এবং তাৎপর্য নিয়ে এই বইটি লিখেছিলেন, (কাসাবে হালাল) এমন ব্যক্তিদের জীবন কাহিনী সংবলিত যারা তাদের পেশা সম্পর্কে মূল্যহীন বলে বিবেচিত হত।[১০]

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

তার নামে বিভিন্ন পণ্ডিত গবেষণা করেন। মিরকাতুল উলুম থেকে একটি এম.ফিল. থিসিস প্রকাশ হয়েছে “হায়াতে আবুল মা’সির আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমি” শিরোনামে, এই গবেষণাটি করেছেন মাসউদ আহমদ আজমী। দুই খণ্ডে প্রকাশিত প্রায় ১৫০০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে আজমির জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মিশরের ৪৬ তম ইমাম আবদুল হালিম মাহমুদ তাকে “ইসলামি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম” উপাধি দিয়েছিলেন। [১১]

মৃত্যু সম্পাদনা

তিনি ১৬ মার্চ ১৯৯২ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মৌতে মৃত্যুবরণ করেন৷

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উদ্ধৃতি সম্পাদনা

  1. Muhammad Asad, Islamic Culture, vol 69. p 60.
  2. Maulana Habibur Rahman Azmi ki Khidmaat Uloom e Islami ke Hawale se। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। 
  3. আজীজ, হাসান (২০২২)। বিস্মৃত মনীষা: দারুল উলুম দেওবন্দের বিস্মৃত মনীষীদের জীবনালেখ্য। ঢাকা: পুনরায় প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৬৩–৭২। 
  4. Muhammad Awamam, Sheikh, Muqadama Musanaf abne abi Shaiba, Darul Qutub al Elmia, Beirut, 1387 AH, vol:1, p, 2
  5. Siraj Ul Hasan, Al Muhadith al Azam Habib Ur Rehman al Azami Maasirhu wa Asarhu, Jamia Delhi, India, 2011 AD, p, 12
  6. Colonel Hardstone,Molana Habib Ur Rehaman Al-Azmi: A colossus of Hadith literature. Page 1
  7. Siraj Ul Hasan, Al Muhadith al Azam Habib Ur Rehman al Azami Maasirhu wa Asarhu, Jamia Delhi, India, 2011 AD, p, 19
  8. Colonel Hardstone,Molana Habib Ur Rehaman Al-Azmi: A colossus of Hadith literature. Page 9
  9. Paul Cobb, The Lineaments of Islam: Studies in Honor of Fred McGraw Donner, p. 147. আইএসবিএন ৯০০৪২১৮৮৫৮
  10. :Siraj Ul Hasan, Al Muhadith al Azam Habib Ur Rehman al Azami Maasirhu wa Asarhu, Opcit. P 12
  11. Dr Muhammad Ghitreef Shahbaz Nadwi। Aalam-e-Islam Ke Chand Mashaheer (Sawaneh wa Afkar ka Mutala) (Urdu ভাষায়) (March 2017 সংস্করণ)। Rahbar Book Service, Jamia Nagar, New Delhi। পৃষ্ঠা 216-217। 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা