সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণ

জীবমণ্ডল সংরক্ষণ

সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ বা সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণ হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, যা ইউনেস্কোর ম্যান অ্যান্ড দ্য বায়োস্ফিয়ার (এমএবি) কর্মসূচির তালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি ভারতের ১৮ টি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে একটি এবং আয়তনের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভটি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাউত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন এলাকা নিয়ে গঠন করা হয়।

সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণ
মানচিত্র সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অবস্থান দেখাচ্ছে
মানচিত্র সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অবস্থান দেখাচ্ছে
অবস্থানগাঙ্গেয় ব-দ্বীপ (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
স্থানাঙ্ক২১°৫৪′১৯″ উত্তর ৮৮°৩৭′০৯″ পূর্ব / ২১.৯০৫২° উত্তর ৮৮.৬১৯১° পূর্ব / 21.9052; 88.6191
আয়তন৯,৬৩০ বর্গকিলোমিটার (৩,৭২০ বর্গমাইল)
স্থাপিত২৯ মার্চ ১৯৮৯; ৩৫ বছর আগে (1989-03-29)
কর্তৃপক্ষপশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগ, ব্যাঘ্র প্রকল্প
sundarbanaffairswb.in/home/page/sundarban_biosphere
সুন্দরবন এর একটি নদীর তীরের দৃশ্য

সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণ তথা ভারতীয় সুন্দরবন এলাকার আয়তন ৯,৬৩০ বর্গকিলোমিটার (৩,৭২০ বর্গমাইল)। জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অন্তর্গত সংরক্ষিত বনের পরিমাণ প্রায় ৪২৬০ বর্গ কিমি, যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ ভূমি গাছপালা আচ্ছাদনের অধীনে এবং বাকি ৪৫ শতাংশ জলাশয়/আন্তঃ জোয়ার অঞ্চলের অধীনে রয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৪০% বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকার আওতায় আনা হয়েছে। জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অন্তর্গত সংরক্ষিত এলাকাগুলি হল সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, লোথিয়ান দ্বীপ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যহ্যালিডে দ্বীপ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এলাকার মধ্যে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ রয়েছে, যা মোট ২৫৫৮ বর্গ কিমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে গঠিত।

ভূগোল সম্পাদনা

সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণ দক্ষিণ-পূর্ব পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় ৯,৬৩০ বর্গকিলোমিটার (৩,৭২০ বর্গমাইল) এলাকা নিয়ে গঠিত, সেইসাথে ১০০ টির বেশি ছোট বড় দ্বীপ রয়েছে। উত্তরে হাড়োয়া ও হাসনাবাদ ব্লক থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। জীবমণ্ডল সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে অসংখ্য প্রশস্ত নদী রয়েছে, যেগুলি মূলত উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়; সাগরের জল নদী খাদের মাধ্যমে জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়। পূর্ব সীমানা হল হারিভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদী। জীবমণ্ডল সংরক্ষণটির উত্তরভাগে জলাভূমি পরিলক্ষিত হয়, যেগুলি মূলত মিষ্টি জলে পরিপূর্ণ। পশ্চিমের সীমানা হুগলী নদী খাদ দ্বারা নির্ধারিত করা হয়।

ইতিহাস সম্পাদনা

মানব ইতিহাস সম্পাদনা

সুন্দরবন অঞ্চলে মৌর্য ও কুশান যুগ থেকেই মানুষের বসবাসের প্রমান পাওয়া যায়। সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ এলাকার ধানচি ও বিজওয়ারা বন থেকে হাতির দাঁতের গেমম্যান, ক্ষুদ্র পাত্র ও অর্ধমূল্য পাথরের পুঁতি সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সকল প্রত্নসামগ্রী থেকে মৌর্য যুগের (৩২২-১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময়কালের ম্যানগ্রোভে একটি প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সভ্যতা, উল্লেখযোগ্যভাবে, পরবর্তী ৫০০-৬০০ বছর ধরে স্থায়ী হয়েছিল। লোককাহিনীতে, সুন্দরবন এলাকার ইতিহাস ২০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে মালিকানা অধিকার পাওয়ার পরপরই ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের প্রথম মানচিত্র তৈরি হয়েছিল।

জীবমণ্ডল সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে গৃহীত ম্যান অ্যান্ড বায়োস্ফিয়ার প্রোগ্রাম-এর (এমএবি) অংশ হিসেবে, ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, জাতীয় এমএবি কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ভারতীয় সুন্দরবনের সমগ্র ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে বায়োস্ফিয়ার ঘোষণা করে। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশকে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসাবে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল মানব ও পরিবেশের মধ্যে আরও ভাল সম্প্রীতির পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমন্বয় ও সংহতকরণ। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভটির কেন্দ্রীয় অংশ সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, তার অনন্য বাস্তুতন্ত্রের কারণে, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ব্যতীত ভারত থেকে দ্বিতীয় বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসাবে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

জীবমণ্ডল সম্পাদনা

সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিরূপের অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সূচিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান নামে। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ । বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমিরসাপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ৫০০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।[১] [২] সুন্দোরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ৪২৬৪ বর্গ মাইল বা ৬ হাজার ৮৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত।এই এলাকার মধ্যে বন ভূমি ছারাও বন ভূমির পার্শবর্তী এলাকাও রয়েছে।এই এলাকা গুলি আগে এই বন ভূমির অন্তর্গত ছিল।

বন্য প্রাণী সম্পাদনা

সুন্দরবন জীবমণ্ডল সংরক্ষণে ২৪৮ টিরও বেশি পাখির প্রজাতি, ৫৮ টি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৫৫ টি সরীসৃপ প্রাণী রয়েছে। বাঘ হল বৃহত্তম শীর্ষ শিকারী যারা বনে বাস করে এবং মানুষ ও কুমির ছাড়া তাদের নিজস্ব কোনো শিকারী নেই। নদী খাদ ও জলাভূমিতে ঘড়িয়াল ও কুমিরের আবাসস্থল রয়েছে, তবে এই প্রজাতিগুলি বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে রেড ডাটা বুকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া গণ্ডার ও বুনো মহিষ ব্যতীত এলাকার বেশিরভাগ স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রজাতি বনে রয়েছে।

উদ্ভিদ সম্পাদনা

জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অন্তর্গত ৪২৬৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জলভাগ ও ঘন বনভূমির দ্বারা গঠিত, যা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে পরিচিত, এবং বনভূমিটি ম্যানগ্রোভ গাছকে ধারণ করতে পারে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ব্যতীত জীবমণ্ডল সংরক্ষণের অন্যান্য অংশে ম্যানগ্রোভ ছাড়া অন্যান্য উদ্ভিদ রয়েছে, যখন বনাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ম্যানগ্রোভ গাছের প্রজাতি রয়েছে। বনাঞ্চলে সুন্দরি ও গড়ান গাছের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। নদী ও জলভাগের তীরবর্তী অংশে হোগলার ঝোপ সহ প্রায় একঘেয়ে বন গঠন করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Sundarbans" in Islam, Sirajul Banglapedia: national encyclopedia of BangladeshDhaka: Asiatic Society of Bangladesh আইএসবিএন 9843205766। Pasha, Mostafa Kamal; Siddiqui, Neaz Ahmad (২০০৩)। 
  2. সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার,সুন্দোরবন বায়োস্ফিয়ার ঘোষণা করা হল,জীব বিদ্যা প্রথম খন্ড। সারদা বুক হাউস।