শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক ইউনেস্কো ও আইএলও সনদ

শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক ইউনেস্কো ও আইএলও সনদ একটি আন্তর্জাতিক সনদ, যা শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে তৈরি করে। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সনদটি গৃহীত হয়।

সনদের ক্রমবিকাশ সম্পাদনা

যদিও এই সনদটি ইউনেস্কোআইএলও যৌথভাবে প্রণয়ন করে, কিন্তু এই সনদ তৈরি হওয়ার পেছনে মূল কৃতিত্বের দাবিদার বিশ্ব শিক্ষক সংঘ (ডব্লিউসিওটিপি)।

১৯৪৭ সালে মেক্সিকো সিটিতে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়নের বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয়। ১৯৫৫ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ‘শিক্ষকতার মর্যাদা’ স্লোগান নিয়ে বিশ্ব শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এ ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক দলিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সম্মেলন শেষে এ বিষয়ে ইস্তাম্বুল সুপারিশ ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ব শিক্ষক সংঘ এশিয়া, আফ্রিকাআমেরিকায় শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কিত এক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা সম্পর্কিত দলিলের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন।

১৯৫৮ সালে আইএলওর একটি সভায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৬৩ সালে একই সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত আরেকটি সভায় এর অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক সংঘের মহাসচিবের সভাপতিত্বে ইউনেস্কো বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় আগের কমিটিগুলোর সুপারিশ বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয় এবং চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। বিষয়টি আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বিশ্ব শিক্ষক সংঘের মহাসচিবের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে জেনেভাতে ইউনেস্কো ও আইএলও প্রথম যৌথ সভা করে। এতে এ সম্পর্কিত ওয়ার্কিং ডকুমেন্ট প্রণয়ন করা হয় এবং এই ডকুমেন্ট সম্মেলনে আলোচনা হওয়ার পর পর্যালোচনা-পরিমার্জন-সংযোজন-সংশোধনের পর চূড়ান্ত আকারে গৃহীত হয়।

সনদের বিশেষত্ব সম্পাদনা

  • এটি শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রণীত ও স্বীকৃত প্রথম ঐতিহাসিক সনদ।
  • সনদটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা দলিল হিসেবে পরিগণিত। এই সনদ পুরোপুরি মেনে চলার ব্যাপারে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বাধ্য না থাকলেও সনদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি দেশের সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়।
  • ইউনেস্কো ও আইএলওর দায়িত্ব হচ্ছে স্ব স্ব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সনদের বিষয় অবহিত করে এর বাস্তবায়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ইউনেস্কো ও আইএলও কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা।
  • সরকার ছাড়াও শিক্ষক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে তা যৌথ কমিটির গুরুত্বসহকারে বিবেচনা ও মূল্যায়ন করা।
  • আন্তর্জাতিক যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সনদ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে থাকে। কমিটি বিভিন্ন প্রশ্নপত্র তৈরি করে তা বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিতরণ করে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত উত্তর বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে এবং তা ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ড ও আইএলওর গভর্নিং বডির নিকট প্রেরণ করে। সেখানে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো পুনরায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।
  • যদিও সনদটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সরকার বাধ্য নয় এবং এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ম্যানডেট থাকলেও সরকারের ওপর শক্তি বা চাপ প্রয়োগের এক্তিয়ার নেই, তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে পেশাগত সমস্যাগুলো নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলো নেগোশিয়েশন ও বার্গেনিং করতে সনদটি ব্যবহার করতে পারে।

সনদের ঘোষণা সম্পাদনা

শিক্ষকদের মর্যাদা প্রসঙ্গে বিশেষ আন্তসরকার পর্যায়ের সম্মেলন দ্ব্যর্থহীনভাবে:

  • শিক্ষাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করছে।
  • সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৬ অনুসারে সবার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করার জন্য রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ববোধ ঘোষণা করছে এবং শিশুদের অধিকার ঘোষণার ৫, ৭ ও ১০ নং নীতি ও যুবকদের মধ্যে শান্তির অন্বেষা এবং মানুষে মানুষে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতাবৃদ্ধি সংক্রান্ত সম্মিলিত জাতিসংঘের ঘোষণাকে পুনর্ব্যক্ত করছে।
  • মানুষের আর্থসামাজিক প্রগতি এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ অব্যাহত রাখার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যে মেধা ও প্রতিভা পাওয়া যায়, তার সুব্যবহারের প্রত্যয় এবং এ লক্ষ্যে সাধারণ, বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষাকে আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত করার অত্যাবশ্যকতা সম্পর্কে সজাগ থাকার ঘোষণা করছে।
  • শিক্ষার অগ্রগতি, মানবজাতির ক্রমোন্নতি এবং আধুনিক সমাজের বিকাশ সাধনে শিক্ষক সম্প্রদায়ের অপরিহার্য ভূমিকা ও অবদানের কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে শিক্ষকরা যাতে এসব ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করছে।
  • বিভিন্ন দেশের অবস্থান এবং সামাজিক বিধিবিধান, রীতিনীতি প্রথাগত বৈচিত্রের কারণ সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষার ধরন এবং গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করছে।
  • বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতার জন্য বিপরীতধর্মী যে সব শিক্ষা উপকরণাদি দেওয়া হয়, বিশেষ করে সে সব দেশ যেখানে শিক্ষকরা সরকারি চাকুরির বিধিমালায় চাকুরিরত, তাদের বিষয় বিবেচনার কথা ঘোষণা করছে।
  • বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপদ্ধতি এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা সত্ত্বেও সব দেশের শিক্ষকদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদার প্রশ্নে যে একটি অভিন্নতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করছে।
  • বর্ণিত আন্তর্জাতিক সনদের যা কিছু শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য – উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাধারণ সম্মেলনে গৃহীত সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা, সভা-সম্মেলন সংগঠিত করার অধিকারের নিরাপত্তা, ১৯৪৯ সালের সংগঠিত হওয়া এবং দরকষাকষির অধিকার সনদ, ১৯৫১ সালের পারিশ্রমিক সনদ এবং ১৯৫৮ সালের বৈষম্য দূরীকরণ সনদ এবং ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে গৃহীত ১৯৬০ সালের শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ এসব মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়াবলীয় গুরুত্ব স্বীকার এবং ঘোষণা করছে।

এ ছাড়া ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার উদ্যোগে আয়োজিত জনশিক্ষা বষয় সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকতার শর্ত এবং মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশাদি এবং ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে গৃহীত ১৯৬২ সালের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশমালা এবং গুণগত ও উৎকর্ষ শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনে দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং তাদের পেশাগত সমস্যাদি দূরীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষকতার বর্তমান মানদণ্ডকে আরও উন্নত করার অভিপ্রায়ে বর্ণিত আন্তর্জাতিক সনদটি প্রণীত, গৃহীত এবং ঘোষিত হল।

১. সংজ্ঞা
১ (ক): শিক্ষক বলতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত থেকে ছাত্রদের সুশিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে যারা নিয়োজিত থাকবেন, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
১ (খ): ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ বলতে বুঝানো হয়েছে শিক্ষকতা কাজের গুরুত্বানুসারে এবং সততার সাথে সম্পন্নের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার কারণে প্রদত্ত সম্মান ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি অন্যান্য পেশাজীবি সম্প্রদায়ের তুলনায় তাদের কাজের শর্তাদি, পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান।

২. পরিধি
এ সনদ সরকারি বেসরকারি নির্বিশেষে সব সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কিন্ডার গার্টেনে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্ত শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।