লিলান চানেসার (সিন্ধি: ليلا چنيسر) হল চৌদ্দ শতকের সোমরা শাসক জাম চানেসারের সময়কালের একটি ঐতিহ্যবাহী উপাখ্যান। চানেসার, চৌদ্দ শতকে পাকিস্তানের সিন্ধুর থাট্টার অন্যতম সোমরা শাসক ছিলেন। সিন্ধি এবং ফার্সি উভয় ভাষায় এই উপাখ্যানটি প্রসিদ্ধ।

চানেসার স্ত্রী লিলান, নয় লক্ষ রুপি মূল্যমানের নেকলেসের প্রলোভনে, পরনারীকে স্বামীর সাথে রাত্রি যাপনের সুযোগ করে দেয়ার কাহিনি উঠে এসেছে উপাখ্যানটিতে। লিলানের এহেন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর রাগে চানেসার তাকে তালাক দেয়, পরবর্তীতে পুনরায় স্বামীর কাছে ফিরে আসা এবং বিয়োগান্তক পরিণতিই উপাখ্যানটির আলোচ্য বিষয়।

গল্পটি শাহ জো রিসালোতেও উল্লেখ করা হয়েছে এবং পাকিস্তানের সিন্ধুর সাতটি জনপ্রিয় বিয়োগান্ত উপন্যাসের একটি। বাকি ছয়টি হল উমার মারভি, সোহনি মহিওয়াল, শাসি পুন্নুহ, নুরি জাম তামাছি, সরাথ রাই দিয়াচ এবং মোমাল রানো।[১][২][৩]

গল্প সম্পাদনা

রাজা চানেসার ছিলেন সোমরা রাজবংশের একজন প্রসিদ্ধ শাসক, যিনি পাকিস্তানের থাট্টা নিকটে সিন্ধুর একটি প্রাচীন শহর দেওয়াল কোট শাসন করতেন। তাঁর সুন্দরী রানী লিলান হীরা এবং গহনা খুব পছন্দ করতেন।

তাঁর সমসাময়িক রাজা রাও খেঙ্গার ভারতের কুচের লক্ষপত শাসন করতেন। তাঁর একমাত্র কন্যা কৌনুর ছিল অত্যন্ত সুন্দরী এবং তার চাচাতো ভাই উতমাদির বাগদত্তা। রানা খানঘর ও মিরখির একমাত্র কন্যা হওয়ায় অত্যধিক ভালবাসা তাকে বিপথগামি করে তোলে। সর্বদা সে সৌন্দর্যের অহঙ্কার এবং রূপচর্চায় বিভর থাকত।

একদিন তাঁর বন্ধু জামনী যে কিনা উম্মাদির বোন ছিলেন, কৌনুরকে তার রুপের অহংকার কে তাছিল্ল করে বলে যে, সে এমন আচরণ করছে যেন সে চানেসার রানী। এমন অপমানে কউনুর প্রতিজ্ঞা করে যে হয় সে চানেসার রানী হবে নতুবা আত্মহত্যা করবে। তার এমন সিদ্ধান্তে বাবা-মা হতাশ হয়ে পড়ে কারণ তারা জানত যে চানেসার বিবাহিত ছিল এবং তার রানী লীলাকে খুব ভালবাসত।

স্বামীর সাথে পরামর্শ করে মিরখি এবং কাউনরু ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে দেওয়ালের দিকে রওয়ানা দেয়। সেখানে তারা চানেসার মন্ত্রী জাখিরের সাক্ষাত লাভ করে এবং তার সহযোগিতা কামনা করে। মন্ত্রি তাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে চানেসারের সাথে কউনুরের বিয়ের ব্যবস্থা তিনি করবেন।

জাখিরো কাউনুরের ব্যাপারটি চানেসারের কানে তোলা মাত্র রাজা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যেন ভবিষ্যতে এই ধরনের কথা বলার সাহস না দেখায়। লিলানের উপস্থিতিতে তিনি অন্য কোনও মহিলার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। রাজার নিকট থেকে এমন জবাব পেয়ে জখিরো মিরখি এবং কাউনুর কাছে ফিরে গিয়ে চানেসার কে বিয়ের আশা ছেড়ে দিতে বলে।

অতপর কাউনরু এবং তার মা ছদ্মবেশ ধারণ করে সাধারণ পোশাকে লিলার প্রাসাদে যায়। সেখানে দারিদ্র্যের কারণে তাদের দেশ ত্যাগ করার বানোয়াট গল্পের অজুহাতে লিলাকে তাদের চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। এমন গল্পে লীলা ভুলে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত চাকর হিসাবে নিযুক্ত করে। কৌনরুর দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন চানেসার বিছানা গুছিয়ে রাখা। এভাবেই সময় কাটতে থাকে।

একদিন কৌনরু যখন চানেসার বিছানা প্রস্তুত করছিল তখন তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল। লীলা, যিনি অলক্ষিতভাবে ঘরে প্রবেশ করছিল, কাউনুর অশ্রু দেখে ফেলে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে কউনুরুকে। কাউনরু তাকে বলে যে এক সময় সেও রাজকন্যা ছিল এবং তাঁর মতো বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। ফানুস বা বাতি ব্যবহার না করে সে তার প্রাসাদে ‘নওলখা হার’ (৯০০,০০০ রুপির মালা) দিয়ে আলোকিত করত।

প্রথমে লীলা তাকে বিশ্বাস করতে দ্বিধায় পড়ে যায় তবে শীঘ্রই সে সেই হারটি দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কৌনরুর কাছে হারটি দেখে সে সেটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে দাম জিজ্ঞেস করে। কৌনরু লীলাকে বলে যে সে তার গলায় হার বিনামূল্যে দিবে তবে একটি শর্তে। লীলা অধৈর্য হয়ে শর্তটি শুনতে চাই। কৌনরু তাকে বলে যে, হারটি তার হবে যদি সে কেবল একরাতের জন্য চানেসার শয্যা সঙ্গী হতে পারে। এই ব্যাপারে লীলা চানেসারকে রাজি করাতে চেষ্টা করেও বিফল হয়।

একদিন, চানেসার উৎসব থেকে মাতাল হয়ে ঘরে ফেরে। লীলা এটিকে তার সেরা সুযোগ হিসাবে বিবেচনা করে এবং কাউনরুকে তার শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।

সকালে যখন চানেসার ঘুম থেকে উঠে লীলার পরিবর্তে বিছানায় কউনুরুকে দেখে চমকে ওঠে। তিনি অত্যন্ত রেগে যান এবং ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখনি মিরখি (কাউনুর মা) তাকে বলে যে লীলা তাকে ‘নওলখা হারের’ বিনিময়ে কাউনুর কাছে বিক্রি করেছে। চেনেসার এটিকে কেবল গলার হারের বিনিময়ে অপমান হিসাবে বিবেচনা করে। তার প্রতিশোধ হিসাবে তিনি লিলাকে তালাক দিয়ে কৌনরুকে বিয়ে করেন। লীলা ক্ষমা চায়, কান্নাকাটি করে কিন্তু চানেসার তার কথা শুনতে অস্বীকার করে বলে যে সে তার থেকে গহনা বেশি পছন্দ করে এবং সে আর তাকে ভালবাসে না। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও রাজার মন গলাতে না পেরে লীলা তার বাবা মার কাছে ফিরে যায়। সেখানে সে দুঃখ, নির্জনতা এবং অনুশোচনাতে দিনাতিপাত করতে থাকে।

চানেসার মন্ত্রী জখিরোর সাথে লিলার পরিবারের একটি মেয়ের বাগদান ছিল। কিন্তু লিলার পরিনতি দেখে তাদের মেয়েকে জখিরর হাতে তুলে নিতে নারাজ হন। এসময় লীলা এসে পরিস্থিতি সামলে নেন এবং জখিরোকে বলেন যেন তার বিয়েতে রাজাকে নিমন্ত্রণ করা হয়।

জখিরোর বিবাহ উপলক্ষে কনেপক্ষের সাথে চানেসার আসেন। অন্যান্য মেয়েদের সাথে লীলা নাচ-গান করলেও তিনি তার পরিচিতি ঘোমটার আড়ালে গোপন করে রাখেন। চানেসার তাদের অভিনয় দেখে সন্তুষ্ট হন, বিশেষ করে মুখ ওড়নায় ঢাকা থাকা কণ্ঠে তিনি মুগ্ধ হন। চেনেসার মেয়েটিকে তার ওড়না তুলে মুখটি উন্মোচন করার জন্য অনুরোধ করেন, কারণ সে পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। লীলা ওড়না খুলতেই চানেসার বিস্মিত হয়ে মেঝেতে পড়ে সাথে সাথে মারা যায়। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে লীলাও সেখানে প্রাণ ত্যাগ করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Schimmel, Annemarie (২০০৩)। Pain and Grace: A Study of Two Mystical Writers of Eighteenth-century Muslim India (ইংরেজি ভাষায়)। Sang-e-Meel Publications। আইএসবিএন 978-969-35-1495-7 
  2. "Leela-XX"web.archive.org। ২০০৯-১০-২৬। Archived from the original on ২০০৯-১০-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-২৭ 
  3. "Bhurgri's Sindhi Website"bhurgri.com। ২০১১-০৪-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-২৭