পূরণচাঁদ জোশী

ভারতীয় রাজনীতিবিদ

পূরণচাঁদ জোশী সংক্ষেপে পি সি জোশী (১৪ এপ্রিল ১৯০৭ — ৯ নভেম্বর ১৯৮০), ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাতের সময়কালের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও অন্যতম নেতা। মাত্র আঠাশ বৎসর বয়সে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক হন।[১]

পূরণচাঁদ জোশী
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পি সি জোশী
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক
কাজের মেয়াদ
১৯৩৬ – ১৯৪৭
পূর্বসূরীগঙ্গাধর অধিকারী
উত্তরসূরীবি. টি. রণদিভে
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৯০৭-০৪-১৪)১৪ এপ্রিল ১৯০৭
আলমোড়া, আগ্রা ও অবধের যুক্তপ্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে উত্তরাখণ্ড)
মৃত্যু৯ নভেম্বর ১৯৮০(1980-11-09) (বয়স ৭৩)
দিল্লি, ভারত
রাজনৈতিক দলভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
প্রাক্তন শিক্ষার্থীএলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাস্বাধীনতা সংগ্রামী

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

পূরণচাঁদ জোশী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের অধুনা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের আলমোড়ার দিগোলী গ্রামের এক কুমায়নি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হরিনন্দন জোশী ছিলেন একজন শিক্ষক। আলমোড়ার মডেল স্কুল থেকে প্রাথমিক এবং গভর্নমেন্ট ইন্টার কলেজ থেকে পরবর্তী শিক্ষা লাভের পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দেএলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ বি.এএম.এ পাশ করেন এবং পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পরীক্ষায় পাশ করেন। [২] সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা  করে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইডি ডিগ্রি লাভ করেন।[৩] জোশী কিছু সময়ের জন্য এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।[৪]

 
(বাম থেকে ডানে) মুজাফফর আহমেদ, বঙ্কিম মুখার্জি, পি সি জোশী, সোমনাথ লাহিড়ী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায়

অল্প বয়সেই যখন সবেমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে, তখনই পূরণচাঁদ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যান। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসেই  মিরাটে গঠিত উত্তর প্রদেশের শ্রমিক ও কৃষক পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯২৯ সালে ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’য় পার্টির শওকত উসমানি, মুজাফফর আহমেদ, এসএ ডাঙ্গে,  এসভি ঘাটে সহ ১৩ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে তিনি কারারুদ্ধ হন। এর সঙ্গেই তার রাজনৈতিক দীক্ষাগ্রহণ সমাপ্ত হয়। সংবাদ মাধ্যমে ষড়যন্ত্র মামলার  আইনি প্রেসনোট পূরণচাঁদ নিজেই তৈরির করতেন, যাতে সংবাদমাধ্যম কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্য জানতে পারে। আত্মপক্ষ সমর্থনে যে ৬৫ পাতার ড্রাফ্ট জমা দেন, সেখানে তিনি ব্রাহ্মণসন্তান উল্লেখ না করে শুরু করেন—‘আই অ্যাম বাই কাস্ট নো কাস্ট’।[৫]

সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনা

 
জেলের বাইরে তোলা মীরাটের বন্দির ২৫ জনের প্রতিকৃতি । পিছনের সারি (বাম থেকে ডানে): কেএন সেহগাল, এসএস জোশ, এইচএল হাচিনসন, শওকত উসমানি, বিএফ ব্র্যাডলি, এ. প্রসাদ, পি. স্প্র্যাট, জি অধিকারী । মধ্য সারি: আরআর মিত্র, গোপেন চক্রবর্তী, কিশোরী লাল ঘোষ, এলআর কদম, ডিআর থেংদি, গৌরা শঙ্কর, এস ব্যানার্জি, কেএন জোগলেকার, পিসি জোশি, মুজাফফর আহমেদ । সামনের সারি: এমজি দেশাই, ডি. গোস্বামী, আরএস নিম্বকর, এসএস মিরাজকর, এসএ ডাঙ্গে, এসভি ঘাটে, গোপাল বসাক

ছয় বছরের কারাদণ্ডে আন্দামানে পাঠানো হলে বয়সের কারণে তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পান। দেশজুড়ে পার্টির প্রসারে লেগে পড়েন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসতে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থন করেন এবং সুকৌশলে কমিউনিস্ট পার্টি আঞ্চলিক গোষ্ঠীভিত্তিক গ্রুপকে সর্বভারতীয় রূপে একত্রিত করেন।  ফলতঃ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি "থার্ড কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল" বা কমিন্টার্ন  রূপে পরিগণিত হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সম্পাদক সোমনাথ লাহিড়ীর আকস্মিক গ্রেপ্তারের পর জোশী সাধারণ সম্পাদক হন এবং তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন।১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় কর্মসমিতি গঠিত হলে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন পূরণচাঁদ জোশী। প্রখর দূরদৃষ্টি ও বিস্তৃত চিন্তাশক্তির কারণে তিনি অবিসংবাদী নায়কের উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। চল্লিশের দশকে তার নেতৃত্বে একের পর এক কৃষক অভ্যুত্থান ও শ্রমিক ধর্মঘট দেশের মানুষের কাছে পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্ট আর কৃষক ফ্রন্টে পার্টির সদস্য সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্রতগতিতে বৃদ্ধির কারণে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ — এই বারো বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানের মাত্র কয়েকশো কর্মীর একটি ক্ষুদ্র আঞ্চলিক গ্রুপ, প্রায় আশি হাজার সদস্যের একটি গণ-পার্টিতে পরিণত হয় পূরণচাঁদ জোশীর নেতৃত্বে।

আদর্শিক-রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সম্পাদনা

পূরণচাঁদ মার্কসীয় নন্দনতাত্ত্বিকদের পুরোধা সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডি পি মুখার্জির প্রেরণায় ভারতীয় সমাজশাস্ত্রের উচ্চ মার্গের অধ্যয়নে ও ভাবধারায় বিশেষত্ব অর্জন করেছিলেন। সেকারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনের তত্ত্ব ও অনুশীলনে তার অসামান্য অবদান ছিল। তার নেতৃত্বেই কমিউনিস্ট পার্টিতেই এসেছিল মতাদর্শগত রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সেই সঙ্গে সূচিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক জাগরণ। তার সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোশীর নেতৃত্বে 'ন্যাশনাল ফ্রন্ট'-এর আহ্বান ছিল সমকালীন শিক্ষিত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সকলে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিলেও, ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, পেশাজীবী, শিল্পী, বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বুর্জোয়া মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তাদের অনেকেই  মার্কসবাদের দিকগুলো ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৪৩ -এ প্রথম সিপিআই কংগ্রেস সম্পাদনা

কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসটি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (২৩ মে হতে ১ জুন) বোম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক বিষয় আলোচনার পাশাপাশি  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। পার্টি-সদস্য ছাড়াও বিপুল সংখ্যক নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হয়ে কার্যধারায় অংশ নেন এবং পুরণচাঁদ জোশীর বক্তব্যের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন এবং মনোযোগ সহকারে শোনেন।

বহুমুখী সংগ্রাম সম্পাদনা

পূরণচাঁদ জোশী ছিলেন প্রখর দূরদৃষ্টির সাধারণ জনগণের নেতা। তিনি জানতেন কখন আন্দোলন শুরু করতে হবে এবং কখন কোথায় কী স্লোগান দিতে হবে। গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে পার্টি অংশ না নেওয়ায়, পার্টি এক ঘরে হলে, পঞ্চাশের মন্বন্তরে তথা বাংলার দুর্ভিক্ষে তাঁর কাজ ছিল অতুলনীয়। ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে। পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অভুক্ত, কঙ্কালসার, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষজনের পাশে। কলকাতায় পার্টির এক সভায় তাঁর সঙ্গে আলাপ হল প্রখ্যাত ফোটোগ্রাফার সুনীল জানার। পূরণচাঁদ জোশী তাঁকে দ্রুত নির্দেশ পাঠালেন ক্যামেরা নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে। সুনীল জানার তোলা ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি সহ দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিষয়ে জোশীর মর্মস্পর্শী লেখাগুলো বেরোতে শুরু করল পার্টি-মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’-এ। বহু নিবন্ধে গভীর বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ করা হয়ছে দুর্ভিক্ষের কারণ। চট্টগ্রামের শিল্পী চিত্তপ্রসাদের আঁকা ছবিও নিয়মিতই স্থান পেত দলীয় মুখপত্রে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্টির সম্পাদক ভবানী সেনও চিত্তপ্রসাদের আঁকা বেশ কিছু রাজনৈতিক পোস্টার বোম্বাই-এ জোশীর কাছে বোম্বেতে পাঠান। এদের কাজ পার্টি মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ এবং ‘পিপলস এজ’-এর পৃষ্ঠায় এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, ঔপনিবেশিক শাসকের আসল রূপ বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিল। প্রতিভাবান শিল্পী দুজনকে যথোচিত মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করান সুযোগ করে দেন।[৫] গণসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা জোশীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার পরিকল্পিত সেন্ট্রাল কালচারাল স্কোয়াড রূপান্তরিত হয় "ইপ্টা"- আইপিটিএ তথা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ নামে। শিল্পজগতের সমকালীন বিনয় রায়, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, নেমিচাঁদ জৈন, শান্তি বর্ধন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, অবনী দাশগুপ্ত, শচীন শঙ্কর, নরেন্দ্র শর্মা প্রমুখ সেরা ব্যক্তিদের একত্রিত করে পার্টির কালচারাল ফ্রন্টের দায়িত্ব তাঁদের হাতে দেওয়ার দুরূহ কাজটি তিনিই করেছিলেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুরারি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বোম্বাই সম্মেলনে প্রদর্শিত হয়েছিল অবিস্মরণীয় উপস্থাপনা - দ্য স্পিরিট অফ ইন্ডিয়া

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে গণসংগ্রামে পূরণচাঁদ কেবল দলকে শান্তিপূর্ণ নেতৃত্ব দেয়নি,  তিনি সশস্ত্র সংগ্রামেও সফলতা পেয়েছেন। জোশী সুবক্তা ছিলেন। তার বক্তৃতা শোনার জন্য বহু মানুষ দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতেন। মহারাষ্ট্রের ওরলিতে গোদাবরিবাই পারুলেকরের নেতৃত্বে যে বিশাল কৃষক-অভ্যুত্থান হয়, বাংলার ১৯টি জেলা জুড়ে উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে যে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন হয়, প্রতিটিরই পিছনেই ছিল পূরণচাঁদ জোশীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও রণকৌশল। ওরলি ও তেভাগা আন্দোলন পূর্ণ সাফল্য পায় এবং কৃষক জনতার ভিতর কমিউনিস্ট পার্টির স্থায়ী গণভিত্তি গড়ে ওঠে। তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানায় যে ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছিল সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন জোশী। তেলঙ্গানা কৃষক অভ্যুত্থানে গেরিলা কৃষকদের হাতে গোপনে অস্ত্র জোগানোর কাজটি সুসম্পন্ন করেছিলেন  জোশী এবং গঙ্গাধর অধিকারী। গণেশ শুক্লর স্মৃতিচারণ থেকে পরে  জানা যায়, সেনা আধিকারিক অফিসারদের সঙ্গে জোশীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফলে  ভারতীয় ফৌজের অস্ত্র পৌঁছে গিয়েছিল কৃষকদের কাছে।[৫]

পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পাদনা

মহাত্মা গাঁধী পরিচালিত দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলনে (১৯৩০-৩৪) কম্যুনিস্ট পার্টি যোগ দেয়নি। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রের আদান-প্রদানে  কমিউনিস্টদের বহু মতামতকে 'জাতির জনক' গুরুত্ব দিতেন।  জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সার্বিক দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন বি টি রণদিভে, দেশপাণ্ডে প্রমুখেরা। অন্যদিকে জোশী কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসতে গেলে গাঁধীর কর্মপন্থা ও জনসংযোগ অনুধাবন করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। সেই সঙ্গে তাদের কারণেই পার্টির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। বি টি রণদিভের নেতৃত্বে কট্টরপন্থীরা এক জোট হন। রণদিভের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এক সার্বিক কংগ্রেস-বিরোধী সশস্ত্র ও জঙ্গি-আন্দোলনের পথে চলতে থাকে। অর্জিত  স্বাধীনতাকে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানে চিহ্নিত করে পার্টি ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।

বহিষ্কার এবং পুনর্বাসন সম্পাদনা

স্বাধীনোত্তরকালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কলকাতায় দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর অস্ত্র হাতে নেওয়ার পথ গ্রহণ করে। কিন্তু জোশী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে  সিপিআই-এর কলকাতা কংগ্রেসে তিনি কঠোর সমালোচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত হন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি তিনি পার্টি থেকে নিলম্বিত তথা সাসপেন্ড হন এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু এক জন নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট পার্টির-সৈনিক হিসাবে তিনি পাল্টা-গোষ্ঠী গঠন করেননি, বরং সমস্ত অপমান, লাঞ্ছনা নীরবে হজম করেছেন। পরে  অবশ্য ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ১ জুন পার্টিতে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হলেও তেমন গুরুত্ব আদৌ দেওয়া হয়নি। তাকে দলীয় সাপ্তাহিক "নিউ এজ"- এর সম্পাদক পদ দিয়ে পুনর্বাসন দেওয়া হয়।   ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর তিনি সিপিআই-এর সঙ্গেই ছিলেন, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম কংগ্রেসে তিনি বিশদে সিপিআই-এর নীতি ব্যাখ্যা করলেও তাকে সরাসরি আর প্রথম সারির নেতৃত্বে আনা হয়নি।

সম্মাননা সম্পাদনা

সমাজবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য গবেষণায় কারণে ইন্ডিয়ান সোশিওলজি সোসাইটি পূরণচাঁদ জোশীকে লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড'-এ সম্মানিত করে। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি.লিট প্রদান করে।[৩][২]

হিন্দি ও ইংরাজী ভাষায় পূরণচাঁদ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল -

  • জোশী, পূরণচাঁদ (১৯৯৫)। সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড  ডেভেলপমেন্ট: কোয়েস্ট ফর রেলেভ্যান্স। হর-আনন্দ পাবলিকেশন। আইএসবিএন 9788124103203 
  • জোশী, পূরণচাঁদ (২০০৪)। বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড কনজারভেশন। এবিএইচ পাবলিশিং। আইএসবিএন 9788176485913 
  • জোশী, পূরণচাঁদ (১৯৭৫)। ল্যান্ড রিফর্মস ইন ইন্ডিয়া: ট্রেন্ডস অ্যান্ড পার্সপেকটিভস্। অ্যালায়েড পাবলিশার্স। 
  • জোশী, পূরণচাঁদ (২০১৪)। মার্কসিজম অ্যাজ সায়েন্টিফিক এন্টারপ্রাইজ। আকার বুকস্ দিল্লি। আইএসবিএন 978-9350022757 

শেষ দিনগুলো সম্পাদনা

জোশী তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতে  জওহরলাল নেহরুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর একটি আর্কাইভ স্থাপনের জন্য গবেষণা ও প্রকাশনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান সম্পাদনা

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জোশী স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও চট্টগ্রাম বিপ্লবের অন্যতম বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে (১৯১৩-১৯৯৫) বিবাহ করেন। তাদের দুই পুত্র সন্তান- চাঁদ ও সুরজ। চাঁদ জোশী (১৯৪৬ -২০০০) ছিলেন হিন্দুস্তান টাইমস-এর  বিশিষ্ট সাংবাদিক। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- ভিন্দ্রানওয়ালে: মিথ অ্যান্ড রিয়েলিটি (১৯৮৫)।  তার  দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মানিনী চট্টোপাধ্যায়ও দ্য টেলিগ্রাফ'র সাংবাদিক। তিনি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের উপর ডু অ্যান্ড ডাই:  দ্য চিটাগং আপরাইজিং (১৯৩০-৩৪) [৬] পূরণচাঁদ সহজ, নিরলঙ্কার জীবনাদর্শে চলেছেন আজীবন, যা তার পরিবারের সদস্যরা মেনে নিতে পারেননি। সে কারণে তিনি শেষজীবনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভঙ্গস্বাস্থ্যে আলমোড়ার তাঁর শেষ স্বপ্নের প্রকল্প— ‘হিমালয়ান সোশ্যালিস্ট আশ্রম’-এ কাটিয়েছেন।  ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তিনি দিল্লিতে প্রয়াত হন।

আরো পড়ুন সম্পাদনা

  • চক্রবর্তী, গার্গী (২০১৪)। পিপলস্ ওয়ারিয়র - ওয়ার্ডস্ অ্যান্ড ওয়র্ল্ডস্ অফ পি সি জোশী। তুলিকা বুকস্। আইএসবিএন 9789382381365 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "কমিউনিস্টদের সেই টানাপড়েন আজও গেল না"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১২ 
  2. "ভারতীয় সাহিত্য সংগ্রহ - পূরণচাঁদ জোশী (হিন্দিতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৩ 
  3. "Puran Chandra Joshi (হিন্দিতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  4. "পূরণচন্দ জোশী - (ভারতকোষ) হিন্দিতে" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  5. "ভারতীয় ফৌজের অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছিলেন কৃষকদের হাতে"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৩ 
  6. "This above All"The Tribune। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০০। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মে ২০১০