আল-কায়েদার ইতিহাস

আল-কায়েদার বিকাশের পাঁচটি স্বতন্ত্র পর্যায় রয়েছে, আল-কায়েদার ধারনা শুরু ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে, "মরুময়তা" সময় ১৯৯০ - ১৯৯৬, "দাওয়াত" পর্ব ১৯৯৬ - ২০০১, পরস্পর-সংযুক্ত সময় ২০০১ থেকে ২০০৫ এবং বিভাজন সময় ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত।[১]

আফগানিস্তানে জিহাদ সম্পাদনা

আল-কায়েদার উৎপত্তি মুলত সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধর (ডিসেম্বর 1979 - ফেব্রুয়ারি 1989) পটভূমি থেকে।[২] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সংঘাতকে শীতল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছে, যার একপক্ষে রাশিয়ার মার্কসবাদ এবং অন্যদিকে আফগান মুজাহিদিন। মার্কিন এই দৃষ্টিভঙ্গি, আফগানিস্তানে সিআইএ "অপারেশন সাইক্লোন" নামে একটি গোপন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। যেখানে পাকিস্তানের আইএসআই-এর সহায়তায় আফগান মুজাহিদিন-কে তহবিল প্রেরণ করে।[৩] মার্কিন সরকার আফগান ইসলামিক জঙ্গিদের যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। হিজব-ই ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা এবং আফগান মুজাহিদিন নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ $৬০০ মিলিয়নেরও বেশি। আমেরিকান সাহায্যের পাশাপাশি হেকমতিয়ার সৌদি সাহায্যও পেত।[৪] ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে, মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে, হেকমতিয়ার, বিন লাদেনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন"।[৫] একই সময়ে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আরব মুজাহিদিন আফগান মার্কসবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিয়েছিল, সেটিতে আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলি সহায়তা করেছিল, বিশেষ করে মাকতাব আল-খিদামত (MAK), যা আফগান সার্ভিস ব্যুরো নামেও পরিচিত। মিশরীয় ইসলামপন্থী কামাল আল-সানানিরি'র (মৃত্যু ১৯৮১) সাথে যুক্ত মুসলিম ব্রাদারহুড নেটওয়ার্কগুলি আফগান মুজাহিদীনদের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং আরবদের নিয়োগে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এই নেটওয়ার্কগুলির মধ্যে আফগান কমান্ডার আব্দুর রসুল সায়াফ এবং আবদুল্লাহ ইউসুফ আজম, ফিলিস্তিনি ইসলামী পণ্ডিত এবং জর্ডানিয়ান মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত মুজাহিদিন গ্রুপগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। আটক ও ১৯৮১ সালে মিশরীয় নিরাপত্তা কারাগারে সানানিরির মৃত্যুর পরে, আবদুল্লাহ আজম আফগান আরব এবং আফগান মুজাহিদিনদের মধ্যে প্রধান সমন্বয়ক হন।[৬]

আফগান জিহাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সরবরাহের জন্য, উসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানে ইসলামপন্থী সংগঠন জামায়াত-ই-ইসলামিতেমুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। পেশোয়ারে থাকাকালীন, বিন লাদেন, আবদুল্লাহ আজমের সাথে দেখা করেন এবং তারা দুজন যৌথভাবে ১৯৮৪ সালে মাকতাব আল-খিদামত (MAK) প্রতিষ্ঠা করেন,যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে আফগান জিহাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং নিয়োগ সমন্বয় করা। MAK আফগান সীমান্তবর্তী পেশোয়ারে গেস্ট হাউসে বিদেশী জিহাদিদের আধাসামরিক প্রশিক্ষণ শিবির নির্মাণের জন্য সরবরাহ সংগ্রহ করেছিল এবং আফগান সন্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার জন্য সংগঠিত করেছিল। সৌদি সরকার এবং সৌদি ব্যবসায়ীসহ স্বতন্ত্র ব্যক্তিরা অর্থায়ন করেছিল।[৭][৮] বিন লাদেনও মুজাহিদিনদের প্রধান অর্থদাতা হয়ে ওঠেন, নিজের অর্থ এবং প্রভাব যুদ্ধ সম্পর্কে জনমত গঠনে ব্যবহার করেন।[৯] সিরিয়ান মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক অসন্তুষ্ট সদস্য যেমন আবু মুসয়াব আল সুরি এই MAK নেটওয়ার্কে যোগ দিতে শুরু করে; ১৯৮২ সিরিয়ায় ইসলামপন্থী অভ্যুত্থান দমনের পর।[১০]

 
ওমর আবদেল-রহমান

১৯৮৬ সাল থেকে, MAK মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োগ অফিসগুলির একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে শুরু করে; ব্রুকলিনের আটলান্টিক এভিনিউতে অবস্থিত ফারুক মসজিদের আল কিফাহ শরণার্থী কেন্দ্র ছিল তার কেন্দ্রস্থল। ব্রুকলিন কেন্দ্রের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন "ডাবল এজেন্ট" আলী মোহাম্মদ, যাকে এফবিআই বিশেষ এজেন্ট জ্যাক ক্লুনান "বিন লাদেনের প্রথম প্রশিক্ষক" বলে অভিহিত করেছিলেন।[১১] এবং "অন্ধ শেখ" ওমর আবদেল-রহমান, একজন নেতৃস্থানীয় মুজাহিদিন নিয়োগকারী ছিলেন। আজম এবং বিন লাদেন ১৯৮৭ সালে আফগানিস্তানে ক্যাম্প স্থাপন শুরু করেন।[১২]

MAK এবং বিদেশী মুজাহিদিন স্বেচ্ছাসেবক বা "আফগান আরব" যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেনি। যখন ২৫০,০০০ আফগান মুজাহিদিন সোভিয়েত এবং কমিউনিস্ট আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, এটা অনুমান করা হয় যে, কোন একই সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দুই হাজারের বেশি বিদেশী মুজাহিদীন ছিল না।[১৩]

তা সত্ত্বেও, বিদেশী মুজাহিদিন স্বেচ্ছাসেবকরা ৪৩টি দেশ থেকে এসেছেন এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে আফগান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মোট সংখ্যা ৩৫,০০০ ছিল বলে জানা যায়।[১৪] বিন লাদেন বিদেশী মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন।[১৫][১৬]

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট আফগান সরকার আরও তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল, মুজাহিদিনদের দ্বারা এটি দখল করার আগ পর্যন্ত।

কার্যক্রম সম্প্রসারণ সম্পাদনা

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক অভিযানের শেষের দিকে, কিছু বিদেশী মুজাহিদিন বিশ্বের অন্যান্য অংশে ইসলামপন্থী সংগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল, যেমন ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর। সেই আকাঙ্খাগুলিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকগুলি ওভারল্যাপিং এবং আন্তঃসম্পর্কিত সংস্থাগুলি গঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি সংগঠন ছিল যা শেষ পর্যন্ত আল-কায়েদা নামে পরিচিত হবে।

গবেষণায় দেখা যায় যে ১১ আগস্ট, ১৯৮৮-এ আল-কায়েদা গঠিত হয়েছিল, যখন মিশরীয় ইসলামিক জিহাদের নেতা আবদুল্লাহ ইউসুফ আজম এবং বিন লাদেনের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি বৈঠক হয়েছিল।[১৭] এই নেটওয়ার্কটি ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় ওসামা বিন লাদেন, আবদুল্লাহ ইউসুফ আজম[১৮] এবং অন্যান্য আরব স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[২] বিন লাদেনের অর্থ ইসলামিক জিহাদ সংগঠনের দক্ষতার সাথে যুক্ত করার জন্য এবং সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার পর অন্যত্র জিহাদী তৈরি করারজন্য একটি চুক্তি হয়েছিল।[১৯] "পবিত্র" যুদ্ধে লড়াই করার পর, গ্রুপটি বিশ্বের অন্যান্য অংশে এই ধরনের অপারেশন প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়েছিল, আফ্রিকার কিছু অংশ, আরব বিশ্ব এবং অন্যত্র ঘাঁটি স্থাপন করা;[২০] কাফিরদের উপর হামলা চালানো।[২১]

সুত্র নির্দেশ করে যে, আল-কায়েদা ২০ আগস্ট, ১৯৮৮ এর মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। সদস্যপদের যোগ্যতার একটি তালিকা রয়েছে: শ্রবণ ক্ষমতা, ভাল আচরণ, আনুগত্য এবং একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অনুসরণ করার জন্য একটি অঙ্গীকার (বায়া'ত) করা। তার স্মৃতিকথায়, বিন লাদেনের প্রাক্তন দেহরক্ষী, নাসের আল-বাহরি, আল-কায়েদা প্রধানের প্রতি তার আনুগত্যের শপথ করার সময় বায়া'ত দেওয়ার রীতির একমাত্র প্রকাশ্যে বর্ণনা দিয়েছেন।[২২] রাইটের মতে, গোষ্ঠীর আসল নামটি প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হয়নি কারণ "এর অস্তিত্ব নিবিড় গোপনীয়তার" ছিল।[২৩]

১৯৮৯ সালে আজমকে হত্যা করা হয় এবং MAK ভেঙে যাওয়ার পর, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক MAK অনুসারী লাদেনের নতুন সংগঠনে যোগ দেয়।[২৪]

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে, আলী মোহাম্মদ, উত্তর ক্যারোলিনার ফোর্ট লিবার্টিতে নিযুক্ত সাবেক বিশেষ বাহিনীর সার্জেন্ট, সামরিক চাকরি ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। তিনি আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং "বিন লাদেনের পরিকল্পনার সাথে গভীরভাবে জড়িত" হন।[২৫] ১৯৯১ সালে, আলী মোহাম্মদ বিন লাদেনকে সুদানে স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়।[২০]

তথ্যসুত্র সম্পাদনা

  1. Burke, Jason; Allen, Paddy (সেপ্টেম্বর ১০, ২০০৯)। "The five ages of al-Qaida"The Guardian। UK। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২২, ২০২৪  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  2. টেমপ্লেট:Cite court
    "Al-Qaeda's origins and links"BBC News। জুলাই ২০, ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ জুন ৩, ২০১৪ 
    Cooley, John K. (Spring ২০০৩)। Unholy Wars: Afghanistan, America and International Terrorism 
  3. "1986–1992: CIA and British Recruit and Train Militants Worldwide to Help Fight Afghan War"। Cooperative Research History Commons। আগস্ট ১৮, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৯, ২০০৭ 
  4. Bergen, Peter L., Holy war, Inc.: inside the secret world of Osama bin Laden, New York: Free Press, 2001. pp. 68–x69
  5. Bergen, Peter L., Holy war, Inc.: Inside the Secret World of Osama bin Laden, New York: Free Press, 2001., pp. 70–71
  6. Filiu, Jean-Pierre (১২ নভেম্বর ২০০৯)। "The Brotherhood vs. Al-Qaeda: A Moment of Truth?"Current Trends in Islamist Ideology9: 19। প্রোকুয়েস্ট ১৪৩৮৬৪৯৪১২ – ProQuest-এর মাধ্যমে। 
  7. Filiu, Jean-Pierre (১২ নভেম্বর ২০০৯)। "The Brotherhood vs. Al-Qaeda: A Moment of Truth?"Current Trends in Islamist Ideology9: 19–20। প্রোকুয়েস্ট ১৪৩৮৬৪৯৪১২ – ProQuest-এর মাধ্যমে। 
  8. Wright 2006.
  9. Gunaratna 2002, পৃ. 19
  10. Filiu, Jean-Pierre (১২ নভেম্বর ২০০৯)। "The Brotherhood vs. Al-Qaeda: A Moment of Truth?"Current Trends in Islamist Ideology9: 20। প্রোকুয়েস্ট ১৪৩৮৬৪৯৪১২ – ProQuest-এর মাধ্যমে। 
  11. Cloonan Frontline interview, PBS, July 13, 2005.
  12. Sageman 2004, পৃ. 35.
  13. Wright 2006, পৃ. 137.
  14. "The War on Terror and the Politics of Violence in Pakistan"The Jamestown Foundation। জুলাই ২, ২০০৪। ডিসেম্বর ৮, ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৯, ২০০৭ 
  15. "Who Is Osama Bin Laden?". Forbes. September 14, 2001.
  16. "Frankenstein the CIA created". January 17, 1999. The Guardian.
  17. Final Report of the National Commission on Terrorist Attacks Upon the United States, Chapter on Terrorist Financing, 9/11 Commission Report ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত জানুয়ারি ২৫, ২০২১ তারিখে p. 104
  18. "Bill Moyers Journal. A Brief History of Al Qaeda"। PBS.com। জুলাই ২৭, ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ৩১, ২০১২ 
  19. Wright 2008.
  20. "Osama bin Laden: The Past"। ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১২, ২০০৭ 
  21. Jihadi Terrorism and the Radicalisation Challenge: p.219, Rik Coolsaet – 2011
  22. Al-Bahri, Nasser, Guarding bin Laden: My Life in al-Qaeda. p. 123. Thin Man Press. London. আইএসবিএন ৯৭৮০৯৫৬২৪৭৩৬০
  23. Wright 2006, পৃ. 260.
  24. Gunaratna, Rohan (২০০৭)। "The evolution of al Qaeda"। Biersteker, Thomas J.; Eckert, Sue E.। Countering the Financing of Terrorism (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। পৃষ্ঠা 51। আইএসবিএন 978-1-134-15537-8 
  25. Wright 2006, পৃ. 181.