আব্দুল আলি মাজারি (দারি: عبدلعلی مزاری‎) (১৯৪৭–মার্চ ১৯৯৫) সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়ে এবং তারপরে হেজবে ওয়াহদাত দলের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন।[১][২] মাজারি জাতিগতভাবে ছিলেন হাজারা[১] এবং বিশ্বাস করতেন যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের সমাধান পাওয়া যাবে, প্রতিটি জাতিগত দলের নির্দিষ্ট সাংবিধানিক অধিকার থাকার মাধ্যমে।[৩] তালিবানদের হাতে নিহত হওয়ার পর, ২০১৬ সালে তাকে মরণোত্তরভাবে উপাধি দেওয়া হয় ‘জাতীয় ঐক্যের শহীদ’।[৪]

উস্তাদ আব্দুল আলি মাজারি
استاد عبدالعلی مزاری
উস্তাদ আব্দুল আলি মাজারি
কাজের মেয়াদ
১৯৮৯ – মার্চ ১৯৯৫
রাষ্ট্রপতিহেজবে ওয়াহদাত
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্মআব্দুল আলি
১৯৪৭
চারকিন্ত, বাল্‌খ প্রদেশ, আফগানিস্তান
মৃত্যু১২ মার্চ ১৯৯৫(1995-03-12) (বয়স ৪৭–৪৮)
গাজনি শহর, গাজনি প্রদেশ, আফগানিস্তান
জাতীয়তা আফগানিস্তান
রাজনৈতিক দলহেজবে ওয়াহদাত
জীবিকারাজনীতিবিদ
জাতিতত্ত্বহাজারা
ওয়েবসাইটbabamazari.info

প্রথম জীবন সম্পাদনা

আব্দুল আলি মাজারি উত্তরের মাজার-ই-শরিফ শহরের দক্ষিণে চারকিন্ত জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর থেকেই তার মাজারি উপনাম এসেছে। তার বাবা হাজি খুদাদাদ, যিনি পেশায় একজন চাষী ছিলেন, অভিপ্রয়াণ করে (এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে যাওয়া) ওয়ারাস জেলার (বামিয়ান প্রদেশ) সুর্খজই থেকে মাজার-ই-শরিফে আসেন। তিনি বেহসুদ উপজাতির লোক ছিলেন। মাজারি, তার গ্রামের স্থানীয় বিদ্যালয়ে, ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে তার প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু করেন, তারপর তিনি যান মাজার-ই-শরিফে, এবং তারপর ইরানের কোম শহরে, এবং সেখান থেকে ইরাকের নাজাফ শহরে।

রাজনৈতিক জীবন সম্পাদনা

সোভিয়েতের রেড আর্মি আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আব্দুল আলি মাজারি তার জন্মস্থানে ফিরে আসেন এবং সোভিয়েত-বিরোধী আন্দোলনে একটি বিশিষ্ট জায়গা অর্জন করেন। প্রতিরোধের প্রথম বছরে, সোভিয়েত সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়, তিনি তার ছোট ভাই মহম্মদ সুলতানকে হারান। এরপর একে একে তিনি তার বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও এই প্রতিরোধে হারান। তার কাকা, মহম্মদ জাফর এবং তার ছেলে, মহম্মদ আফজল, কারারুদ্ধ হন এবং সোভিয়েত সমর্থিত আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তাদের হত্যা করে। তিনি, এই বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধ আন্দোলনে, তার পিতা হাজি খুদাদাদ এবং ভাই হাজি মহম্মদ নবিকেও হারান।

হেজবে ওয়াহদাত সম্পাদনা

আব্দুল আলি মাজারি ছিলেন হেজবে ওয়াহদাত ("ইউনিটি পার্টি")র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন এবং প্রথম নেতা। বামিয়ানে প্রথম দলীয় সম্মেলনে, তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় সম্মলনে, তিনি মহাসচিব নির্বাচিত হন। মাজারির উদ্যোগে তৈরী হয় জনবেশ-এ শামাল বা (উত্তরের আন্দোলন), যার মধ্যে দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের সাথে যোগদান করেছিল। এর ফলে একটি অভ্যুত্থান হয় এবং কাবুলের কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে।[৫]

গৃহযুদ্ধ সম্পাদনা

কাবুলের পতনের পর, আফগান রাজনৈতিক দলগুলি পেশোয়ার চুক্তির মাধ্যমে শান্তি ও ক্ষমতা ভাগাভাগিতে সম্মত হয়েছিল। পেশোয়ার চুক্তির ফলে তৈরী হয় ইসলামিক স্টেট অফ আফগানিস্তান এবং সাধারণ নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুসারে:

সোভিয়েত - সমর্থিত নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর, আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যস্ত হয় ইসলামিক স্টেট অফ আফগানিস্তানের ওপর, যা এপ্রিল ১৯৯২ সালে গঠিত হয়েছিল। ...গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজব-এ ইসলামি ছাড়া, সমস্ত দল... এই সরকারের অধীনে একত্রিত হয় এপ্রিল ১৯৯২ সালে। ... হেকমতিয়ারের হেজব-এ ইসলামি, এই রিপোর্টে উল্লিখিত অধিকাংশ সময়ের জন্য এই সরকারকে অস্বীকার করে এবং সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালায়। কিন্তু কাবুলের সর্বত্র তাদের শেল এবং রকেট পড়ার ফলে বহু অসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।[৬]

হেজবে ওয়াহদাত প্রাথমিকভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রে অংশ নেয় এবং সরকারের কিছু পদ গ্রহণ করে। যদিও, শীঘ্রই, দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে মাজারির হাজারা হেজবে ওয়াহদাত, সৌদি আরব সমর্থিত আব্দুল রসুল সায়াফের ওয়াহাবি পাশতুন ইত্তিহাদ-ই ইসলামি দলের মধ্যে।[৬][৭][৮] ইসলামিক স্টেটের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আহমদ শাহ মাসুদ দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন, কিছুটা সাফল্যও আসে, কিন্তু যুদ্ধবিরতি বেশিদিন চলেনি। ১৯৯২ সালের জুন পর্যন্ত, হেজবে ওয়াহদাত এবং ইত্তিহাদ-ই ইসলামি একে অপরের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের সমর্থনে[৭] সায়াফের সেনা কাবুলের দক্ষিণ পশ্চিম শহরতলীতে বার বার হামলা চালায়। ফলে বহু অসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

মৃত্যু সম্পাদনা

১২ই মার্চ, ১৯৯৫ সালে, তালিবানেরা কাবুলের কাছে চার আসিয়াবে, তাকে, তার পাঁচজন সঙ্গীসহ গ্রেফতার করে। পরেরদিন মাজারির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় এবং তার দেহ গাজনি জেলায় পাওয়া যায়। তখন তার বয়স হয়েছিল ৪৯। তালিবান একটি বিবৃতি জারি করে বলে যে, কান্দাহার নিয়ে যাবার সময়ে মাজারি, তালিবান সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। পরে তার এবং তার সঙ্গীদের দেহ হেজবে ওয়াহদাতের হাতে তুলে দেওয়া হয়, সব দেহগুলো বিকৃত অবস্থায় ছিল এবং নির্যাতনের লক্ষণও ছিল। মাজারির দেহ গাজনি থেকে উত্তরের মাজার-ই-শরিফে (সেই সময় তার সঙ্গী আব্দুল রশিদ দোস্তুমের নিয়ন্ত্রণে) নিয়ে যাওয়া হয়। তার অনুসারীরা পায়ে হেঁটে চল্লিশ দিনের বেশি সময় ধরে তীব্র তুষারপাতের মধ্য দিয়ে সমগ্র হাজারা পার হয়েছিল। মাজার-ই-শরিফে হাজার হাজার মানুষ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। ২০১৬ সালে মাজারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের জাতীয় ঐক্যের জন্য শহীদ হিসেবে অভিহিত করেন রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি

গ্যালারী সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Afghanistan Online: Biography (Abdul Ali Mazari)"। Afghan-web.com। ১৯৯৫-০৩-১৩। ২০১০-১২-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০২-২৮ 
  2. "Afghanistan rocked by northern bombing"। Asia Times Online। ২২ মে ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৫-২৮ 
  3. Mazari, Abdul Ali (1995 (1374 AH)) Iḥyā-yi huvyyat: majmū‘ah-’i sukhanrānīha-yi shahīd-i mazlūm ... Ustād ‘Abd ‘Ali Mazāri (rah) (Resurrecting Identity: The collected speeches of Abdul Ali Mazari) Cultural Centre of Writers of Afghanistan, Sirāj, Qum, Iran, OCLC 37243327
  4. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৬ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০১৮ 
  5. Father of Hazara Nation - Abdul Ali Mazari at Hazara.net. Accessed 2011-02-28
  6. "Blood-Stained Hands, Past Atrocities in Kabul and Afghanistan's Legacy of Impunity"Human Rights Watch। ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০১৮ 
  7. Amin Saikal (২০০৬)। Modern Afghanistan: A History of Struggle and Survival (1st সংস্করণ)। London New York: I.B. Tauris & Co। পৃষ্ঠা 352। আইএসবিএন 1-85043-437-9 
  8. Gutman, Roy (2008): How We Missed the Story: Osama Bin Laden, the Taliban and the Hijacking of Afghanistan, Endowment of the United States Institute of Peace, 1st ed., Washington DC.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা