অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়

ড.অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ - ১৭ নভেম্বর ২০০৮) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক যিনি পশ্চিমবঙ্গে গণবিজ্ঞান আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণে দীর্ঘসময় যুক্তি ও তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞান পত্রিকা উৎস মানুষ সম্পাদনা করেন।[১]

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম(১৯৫০-০৯-১৩)১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫০
মৃত্যু১৭ নভেম্বর ২০০৮(2008-11-17) (বয়স ৫৮)
কর্মজীবন১৯৭৫ - ২০০৩
পিতা-মাতাহরিজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় (পিতা)
মায়া দেবী (মাতা)

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। পিতা হরিজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা মায়া দেবী। অশোকের প্রাথমিক শিক্ষা প্রথমে সোদপুরের শিক্ষায়তনে এবং পরে কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফল করে ন্যাশনাল স্কলার হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞান অনার্সসহ বি এসসি এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিক্ষেপী ক্ষেপণাস্ত্র তথা 'ব্যালিস্টিক্স'-এর উপর গবেষণা করে পি এইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। [১]

কর্মজীবন সম্পাদনা

পদার্থবিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র ড.অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিড়লা শিল্প ও কারিগরী সংগ্রহশালায় গাইড-লেকচারপদে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমিত চক্রবর্তী ও কৃষ্ণা ঘোষালের সঙ্গে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। আকাশবাণীর সপ্তাহের বিজ্ঞান-অনুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করতে বিশেষ অবদান রাখেন। [২] ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টেট ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার পদে যোগ দিয়ে মৃত্যুকালে ওই সংস্থার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। [১]

গণবিজ্ঞান আন্দোলনে অবদান সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গে গণবিজ্ঞান আন্দোলনে ড. অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল একটি স্মরণীয় নাম। সত্তরের দশকের কিছু বাঙালি তরুণ বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার এক আন্দোলনে নেমেছিল। তিনি ছিলেন তাদের মধ্যমণি। সত্তরের দশকের শেষের দিকে তিনি মাটির কাছে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রায় দু'দশক ধরে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের সমস্যা, জিজ্ঞাসা, অজ্ঞতা , বিভ্রান্তি দূর করতে সচেষ্ট হন। ক্যানিং যুক্তিবাদী সংস্থা প্রকাশিত সুন্দরবনের সাপ নামক সিডিতে তিনি ধারাভাষ্য দেন। কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও রূপায়ণে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। নিজের উদ্যোগে বাহুল্যবর্জিত সহজ অথচ মর্মভেদী ভাষায় তদন্ত ভিত্তিক অকাট্য তথ্য ও তত্ত্বের উপাদানে সমৃদ্ধ বিজ্ঞান রচনায় ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন "মানুষ" নামের মাসিক বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা।[১]১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বারোটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটির নাম ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পরিবর্তিত হয় উৎস মানুষ নামে। নানা কাজকর্মে নিযুক্ত মানুষজন, সামাজিক সংগঠন "উৎস মানুষ" পত্রিকা থেকে নিয়েছেন কাজের প্রেরণা। দীর্ঘ তেইশ বছর একটানা প্রকাশিত হওয়ার পর ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ হতে এর প্রকাশনা অনিয়মিত হতে থাকে। দুরারোগ্য কার্ডিয়াক মায়োপ্যাথি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তা সত্ত্বেও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য নিয়ে নানা আকারে উৎস মানুষ-কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন [১] কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে, সামাজিক অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে, বিজ্ঞানমনষ্ক মানসিকতা গড়ে তুলতে তিনি নিরলস শ্রম দিয়েছেন। কখনও ব্যক্তিগত প্রাপ্তি বা মূল্যায়ন প্রত্যাশা করেন নি। 'বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ' বলতে তিনি বুঝিয়েছেন-

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগেই একজন সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন ভাবনায়, সামাজিক–রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক চিন্তায়, বিশ্বাসে–অবিশ্বাসে, সঠিক ন্যায়সঙ্গত মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে পারে, জীবনের সামগ্রিক মূল্যবোধকে উপলব্ধি করতে পারে। এহেন পরিশীলিত মন গড়ে উঠলেই আমরা তাকে বিজ্ঞান মনষ্ক বলতে পারি।

আত্ম-প্রচার বিমুখ ছিলেন ড. অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কর্মের মাধ্যমে দুই বাংলায় গণবিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

রচিত গ্রন্থসমূহ সম্পাদনা

  • বিজ্ঞানকে মুখোশ করে (১৯৯২) (মার্টিন গার্ডনার এর ইংরাজী রচনার অনুবাদ)
  • সাপ নিয়ে গালগল্প (২০০২)
  • মাটি জল মানুষ (২০০৩)
  • রিলেটিভিটি (২০০৭)

জীবনাবসান সম্পাদনা

২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ড. অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর উৎস মানুষ পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রতি বছর আয়োজন করা হয়ে থাকে 'অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা'।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৩৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. বাংলা বিজ্ঞান সম্প্রচারের ইতিহাস পরিক্রমা: একটি রূপরেখা, নিবন্ধ রচনা সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, আগস্ট, ২০২১,সংখ্যা ৮ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ২৭ মে ২০২২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ 
  3. "উৎস মানুষ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-২৪