সাতই মার্চের ভাষণ

শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ
(৭ই মার্চের ভাষণ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
এটি একটি পরীক্ষিত সংস্করণ, যা ১৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পরীক্ষিত হয়েছিল।

সাতই মার্চের ভাষণ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি উক্ত ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। উক্ত ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়।[]

৭ই মার্চের ভাষণ
৭ই মার্চে রেসকোর্সে ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান
তারিখ৭ মার্চ ১৯৭১ (1971-03-07)
সময়দুপুর ২:৪৫ — বিকেল ৩:০৩
স্থিতিকাল১৮ মিনিট
ঘটনাস্থলরেসকোর্স ময়দান
অবস্থানরমনা, ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ)
স্থানাঙ্ক২৩°৪৩′৫৯″ উত্তর ৯০°২৩′৫৪″ পূর্ব / ২৩.৭৩৩০৬৬° উত্তর ৯০.৩৯৮৪৩৭° পূর্ব / 23.733066; 90.398437
ধরনভাষণ
বিষয়বস্তুবাংলাদেশের স্বাধীনতা
চিত্রগ্রাহকআবুল খায়ের
স্বীকৃতিবিশ্ব স্মৃতির আন্তর্জাতিক নিবন্ধন

এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য অচিরেই বিতরণ করা হয়েছিল। এটি তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছু পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।[] ১৩টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ১৩ তম হিসাবে মাহাতো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর কুড়মালি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়, যা নৃ তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় ১ম অনুবাদ।[] নিউজউইক ম্যাগাজিন শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে উল্লেখ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।[]

পটভূমি

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে-কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন।[]

ভাষণ

তিনি ভাষণে কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করেন:

  • সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা
  • পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত
  • সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানানো
  • অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য বাঙালিদের আহ্বান জানানো
  • দাবী আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রদান
  • নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান এবং বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা

ভাষণ রেকর্ড

পাকিস্তান সরকার ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ভাষণটি প্রচার করার অনুমতি দেয় নি। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তৎকালীন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশনের চেয়ার‍ম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক একইসঙ্গে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনে সংসদ সদস্য এম আবুল খায়ের ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন। তাদের সঙ্গে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন।[]

অডিও রেকর্ডটি এম আবুল খায়েরের মালিকানাধীন রেকর্ড লেবেল ঢাকা রেকর্ড বিকশিত এবং আর্কাইভ করা হয়। পরে, অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের একটি অনুলিপি শেখ মুজিবকে হস্তান্তর করা হয় এবং অডিওর একটি অনুলিপি ভারতে পাঠানো হয়। সেই সাথে অডিওর ৩০০০ অনুলিপি করে তা সারা বিশ্বে ভারতীয় রেকর্ড লেবেল এইচএমভি রেকর্ডস দ্বারা বিতরণ করা হয়।[]

স্বীকৃতি ও প্রতিক্রিয়া

২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটি সহ মোট ৭৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) ’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।[]

এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে ‘ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।[]

শাবিপ্রবির শিক্ষক জাফর ইকবাল প্রতিক্রিয়ায় বলেন,

বঙ্গবন্ধু নয় বরং ইউনেস্কোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ এখন তাদের কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে, এমনটা তারা বলতে পারবে।[]

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন,

"শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন,

"২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল। তখন অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।"[]

অনুবাদ

জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০১৯ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছে। পূর্বে ভাষণটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হলেও বিদেশি ভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়।[১০]

সম্প্রতি প্রকাশিত 'কঁআথুয়েঁনঃ মাহাতো ডিকশনারি' নামের কুড়মালি ভাষায় রচিত একটি গ্রন্থে সংযুক্ত করা হয় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। এটি কুড়মালি ভাষায় অনুবাদ করেন কুড়মালি ভাষার লেখক ও গবেষক উজ্জল মাহাতো। এটি ভিন্ন ভাষায় ১৩ তম এবং ক্ষুদ্র নৃ তাত্ত্বিক ভাষায় প্রথম অনুবাদ। [১১]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ - দলিল পত্র ১৫শ খণ্ড
  2. "কুড়মালি ভাষায় ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ"কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৫ 
  3. "বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক দলিল: ইউনেস্কো"দৈনিক প্রথম আলো 
  4. সাতই মার্চের ভাষণ - বাংলাপিডিয়া, লেখক - হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
  5. "ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ ধারণ করেছিলেন আবুল খায়ের"প্রিয়.কম। ২৩ নভেম্বর ২০১৭। ২৯ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১৯ 
  6. "ইউনেস্কোর তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ"বিবিসি বাংলা। ৩১ অক্টোবর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১৭ 
  7. "৭ মার্চের ভাষণকে প্রতিশোধ বললেন শেখ হাসিনা"। bdnews24। ১৮ নভেম্বর ২০১৭। ২২ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১৭ 
  8. "৭ মার্চের ভাষণ একটি মহাকাব্য : জাফর ইকবাল"এনটিভি। ১৮ নভেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১৭ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  9. "বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ৭ মার্চের ভাষণ"ডয়চে ভেলে। ১৮ নভেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১৭ 
  10. "বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাপানি ভাষায় প্রকাশ"দৈনিক প্রথম আলো। ৩ জুন ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৯ 
  11. "কুড়মালি ভাষায় ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ | কালের কণ্ঠ"কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৫ 

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ