১৯৯০ নেপালি বিপ্লব

নেপালে গণতন্ত্রের পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন

নেপালি বিপ্লব ১৯৯০ (নেপালি: २०४६ को जनआन्दोलन, প্রতিবর্ণী. জন আন্দোলন) হলো নেপালের একটি বহুদলীয় আন্দোলন, যা দেশের সম্পূর্ণ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সূত্রপাত করে। এছাড়াও এই আন্দোলন নেপালের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটায়।[১]

১৯৯০ নেপালি বিপ্লব
অংশগ্রহণকারীনেপালি কংগ্রেস

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য এই আন্দোলনকে বিশেষত্ব দান করে। বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দল একীভূত হয়ে শুধু বামপন্থী ঐক্য ফ্রন্টই গঠন করে না, বরং অন্যান্য দল, যেমন নেপালি কংগ্রেস ইত্যাদি দলকেও সহযোগিতা প্রদান। এই ঐক্যের অন্যতম ফলাফল ছিল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (একীকৃত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) গঠন।

ইতিহাস সম্পাদনা

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালের নেপালের সর্ববৃহৎ অবৈধ গণতন্ত্রপন্থী দল নেপালি কংগ্রেস এবং সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থীদের ঐক্য জোট একীকৃত বাম ফ্রন্ট নামক দুইটি দল এককাট্টা হয়ে নেপালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূত্রপাতের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জন আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে দিনটিকে নেপালে "গণতন্ত্র দিবস" হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আন্দোলন দমনের জন্য ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি নেপালের ক্ষমতাসীন সরকার উভয় দলের জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের সমস্ত নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে ও বিরুদ্ধবাদী সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।[২][৩]

নেপালের রাজা এক বেতার ভাষণে জাতিকে রাজপরিবারের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকতে ও সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানান। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে পুলিশ ভক্তপুরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়, যার ফলে ১২ জন নিহত হন। এরপর আন্দোলন আরও দ্রুত বিকশিত হতে থাকে এবং দাঙ্গা পুলিশের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল এবং শতাধিক গ্রেফতার ও আহত হওয়ার পর সেটি ভয়াবহ রূপ নেয়। আন্দোলন থেকে বন্ধের (হরতাল) ডাক দেওয়া হয়, যা দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।[২][৩]

বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, এবং প্রাসাদ নেতৃত্বের ঘাটতি পরিলক্ষিত হতে থাকে, যার দরুন স্থানীয় সরকার বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বের অভাবে কেউ কেউ আন্দোলনে যোগ দেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আন্দোলন বিস্তৃত হয়ে রাজধানী কাঠমান্ডুতে পৌঁছায়। এপ্রিলের প্রথম প্রান্তে পাটনে সেনাবাহিনীর হাতে আন্দোলনকারীদের নিহত হওয়ার ঘটনায় কাঠমান্ডুতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিছিল বের হয়, যাতে প্রায় ২,০০,০০০ মানুষের সমাগম ঘটে।[২][৩]

প্রতিবাদকারীরা ১৯৫০ এর দশকের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার দাবিতে বেশ কিছুদিন সড়ক অবরোধ করে, পুলিশকে বাধা দেয় এবং পতাকা মিছিল বের করে। সে সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী নিহত হন। আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে জনগণ সরকারি ভবনসমূহ ঘেরাও করে এবং রাজাকে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। সেই সময় বেশ কিছু আন্দোলনকারী প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি ও রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহের মূর্তি ভাংচুর প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করায় অনেক পুলিশ সদস্য আন্দোলনে যোগদান থেকে বিরত থাকে এবং ধ্বংসযজ্ঞের ফলশ্রুতিতে নেতারা আন্দোলন উঠিয়ে নেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল রাজা সমস্ত রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।[২][৩]

জন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে নেপালের নতুন সংবিধান খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এই সংবিধান নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবকে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা প্রত্যার্পণে বাধ্য করে। মিছিল ও গণ আন্দোলনের কারণে রাজা বীরেন্দ্র জনগণের সংবিধান প্রণয়নে এবং এটি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন যে "জনগণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার উৎস..... এবং মৌলিক মানবাধিকারের অধিকারী" (বরাল)। এর মাধ্যমে নেপালের ১৮ বা ততোর্ধ্ব বয়সের নাগরিকেরা ভোট দিতে সমর্থ হন। তবে উচ্চ নিরক্ষরতার হারের (সাক্ষরতা ৪০%) কারণে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতীক ভিত্তিতে ক্রিয়াশীল। উদাহরণস্বরূপ নেপালি কংগ্রেস বৃক্ষ এবং একীকৃত মার্ক্সবাদী পার্টি সূর্য প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে থাকে।

রাষ্ট্রের অভিজাত ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে দূরত্বের কারণে নতুন সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া ব্যাপক জটিলতার সম্মুখীন হয়। অধিকাংশ বিশিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতারা সাধারণ উচ্চ বর্ণের হয়ে থাকেন এবং দেশের বৃহত্তর জনগণের সাথে খুব সামান্যই সম্পর্কিত থাকেন। আবার সাধারণ ভোটারে খুবই সাধারণত অশিক্ষিত ও নৃতাত্ত্বিক সংসর্গ বিশিষ্ট হয়ে থাকেন। এই বৃহৎ বৈষম্য এমন একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হয়, যা নেপালি জনগণ ও ভোট কর্মকর্তার মধ্য সমতা বিধান করবে এবং একই সাথে সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকেও ধারণ করবে।[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা