হিন্দু মেলা

কলকাতার প্রাক্তন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব

হিন্দুমেলা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় আয়োজিত একটি বাৎসরিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। ১৮৬৭ সালে নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসুমনোমোহন বসু ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য স্থাপন ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের জাগরণের উদ্দেশ্যে "চৈত্রমেলা" নাম দিয়ে এই উৎসবটির সূচনা ঘটান। দেশীয় খেলাধূলা, শিল্পকলা, দেশাত্মবোধক কবিতা ও গানের প্রচারে সহায়তার জন্য হিন্দুমেলার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত আয়োজিত হত এই মেলা। এরপর ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও সেই-জাতীয় অন্যান্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটায় হিন্দুমেলা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য

সম্পাদনা
 
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হিন্দুমেলার প্রথম সচিব

১৮৬৭ সালে ন্যাশনাল পেপার-এ প্রকাশিত হয় রাজনারায়ণ বসুর লেখা প্রসপেক্টাস অফ আ সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ ন্যাশনাল ফিলিং অ্যামং দি এডুকেটেড নেটিভস অফ বেঙ্গল। এই পুস্তিকাটি পাঠ করে অনুপ্রেরণা লাভ করেন নবগোপাল মিত্রদেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাজনারায়ণ ও মনোমোহন বসুর সঙ্গে একযোগে সেই বছরই হিন্দুমেলার সূচনা ঘটান তাঁরা।[][] প্রথমে এই মেলার নাম ছিল "চৈত্রমেলা"[], কারণ এটি আয়োজিত হত বাংলা পঞ্জিকার শেষ মাস চৈত্রের সংক্রান্তিতে।[][] চৈত্রমেলার প্রবর্তনায় অর্থসাহায্য করেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারের কয়েকজন সদস্য এই মেলার সংগঠন ও প্রচারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাছাড়া এই পরিবারের সদস্যেরা মেলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং মেলার জন্য গানও রচনা করেছিলেন।[]

গোড়ার দিকে মেলার সচিব ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সহকারী সচিব ছিলেন নবগোপাল মিত্র। মাত্র আঠাশ বছর বয়সে গগনেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তৃতীয় বর্ষে তাঁর পদে আসীন হন। দ্বিজেন্দ্রনাথ আরও চার বছর মেলা আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন।[][] এই চার বছরে দ্বিজেন্দ্রনাথ ও নবগোপাল হিন্দুমেলাকে এক জাতীয় উৎসবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মেলাটি বছরে একবার আয়োজিত হত বলে, বছরের যে দিনগুলিকে মেলার অনুষ্ঠান চলত না, সেই দিনগুলিতেও মেলার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি জাতীয় সমিতি গঠিত হয়েছিল।[]

১৮৭৮ সালে হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে নবগোপাল ও গগনেন্দ্রনাথ মেলার ছটি উদ্দেশ্যের খসড়া প্রস্তুত করেন। এই উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের জন্য এক জাতীয় পরিষদের সৃষ্টি,[] যে পরিষদ পরবর্তীকালে উপনিবেশে ভারতীয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে এবং ব্রিটিশ পরিষেবা গ্রহণ ও ব্রিটিশদের উৎপাদিত দ্রব্য ব্যবহারে ভারতীয়দের নির্ভরতা হ্রাস করতেও সাহায্য করবে।[][১০] এই কাজে গতি আনতে সংগঠকেরা পরিষদের কার্যবিবরণীর এক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করার নিয়ম চালু করেন, যাতে প্রতিবছর মেলায় পরিষদের উপস্থাপিত কাজকর্মগুলির বিবরণ থাকত।[১১] এই উপলক্ষ্যে গৃহীত অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে ছিল দেশীয় শিক্ষা, শিল্পকলা ও খেলাধূলার পৃষ্ঠপোষকতা; এবং যে কেউ এই উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হতে চাইবেন তাঁকে সাহায্য করা। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য হিন্দু সমাজের নেতৃবর্গের সঙ্গে সহযোগিতা করে ছ’টি সমিতি স্থাপন করা হয়েছিল।[১১][১২]

পরবর্তী বছরগুলি

সম্পাদনা

দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুমেলার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম ভারতে কর্মরত থাকার দরুন মেলার প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি উপস্থিত ছিলেন।[১৩] তিনি "মিলে সবে ভারতসন্তান, একতান গাহো গান" শীর্ষক একটি গান রচনা করেছিলেন, যেটিকে ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়।[১৪][১৫] সত্যেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হিন্দুমেলার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি এই মেলা উপলক্ষ্যে "হিন্দুমেলার উপহার" নামে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। মেলার নবম অধিবেশনে তিনি কবিতাটি স্বকণ্ঠে আবৃত্তিও করেন। এরপরই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল "অমৃতবাজার পত্রিকা"-য়। এটিকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্বনামে মুদ্রিত কবিতাগুলির অন্যতম বলে মনে করা হয়।[১৬]

হিন্দুমেলার অধিবেশনেই রবীন্দ্রনাথের ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব প্রথম প্রকাশ্যে আসে।[১৭] এই মেলার নবম অধিবেশনে তিনি আবৃত্তি করেছিলেন দিল্লীর দরবার কবিতাটি। ভারতের নবনিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড লিটন রানি ভিক্টোরিয়াকে "ভারতসম্রাজ্ঞী" ঘোষণার জন্য এক বিলাসবহুল দিল্লি দরবার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন উক্ত কবিতাটির মাধ্যমে। এই কবিতায় শুধুমাত্র অনুষ্ঠানটির নিন্দাই করা হয়নি, বরং কবি তাঁর স্বদেশবাসী ভ্রাতৃবর্গের নিকট আহ্বান জানিয়ে বলেন: [১৮][১৯][২০]

ব্রিটিশ বিজয় করিয়া ঘোষণা, যে গায় গাক্ আমরা গাব না
আমরা গাব না হরষ গান,
এস গো আমরা যে ক-জন আছি, আমরা ধরিব আরেক তান।

ব্রিটিশ রাজকে সর্বসমক্ষে আক্রমণের প্রথম ঘটনাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।[২১]

হিন্দুমেলার অনেক সংগঠকই একজোট হয়ে সঞ্জীবনী সভা নামে একটি গোপন সমিতি গঠন করেন। এই সমিতি স্বদেশী দেশলাই ও দেশীয় বস্ত্রবয়নে আত্মনিয়োগ করে।[২২] এছাড়াও হিন্দুমেলা দেশীয় খেলাধূলার উন্নতিবিধানে অনেক কাজ করে। মেলার প্রথম অধিবেশনে কলকাতার খ্যাতনামা কুস্তিগিরদের আমন্ত্রিত করা হয় এবং পদক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।[২৩] পরবর্তী অধিবেশনে কুস্তি ও লাঠিখেলার মতো দেশীয় খেলাধূলার প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। ভারতীয় মার্শাল আর্টস ও দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় টিকে থাকার নিয়মকানুনের বিভিন্ন প্রদর্শনীও এই মেলায় গুরুত্ব-সহকারে আয়োজিত হত।[২৪] এই প্রদর্শনীগুলির ফলে অনেক বিদ্যালয়ই শরীরচর্চাকে তাদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাতেও শরীরচর্চাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।[২৫]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

সূত্রনির্দেশ

সম্পাদনা
  1. সেন ২০১০, পৃ. ২৩৫।
  2. দত্ত ১৯৮৮, পৃ. ১৫৭৮।
  3. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ৭, ২৩।
  4. গুপ্ত ২০০৯, পৃ. ৫২।
  5. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ১৬-১৭।
  6. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ৭-৮।
  7. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ৬২।
  8. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ৬২-৬৩।
  9. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ২৭।
  10. গুপ্ত ২০০৯, পৃ. ২১।
  11. দত্ত ১৯৮৮, পৃ. ১৫৭৮-১৫৭৯।
  12. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ২৮-২৯।
  13. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ১৬।
  14. বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬৬, পৃ. ৯৮–১০৪।
  15. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ১০৫।
  16. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ১১।
  17. হোগান ও পণ্ডিত ২০০৩, পৃ. ৩১।
  18. রঙ্গনাথন ও ভট্টাচার্য ২০২০, পৃ. ১৩।
  19. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ৫৭।
  20. রবীন্দ্র-রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৯৮৩, পৃ. ১১১১
  21. হোগান ও পণ্ডিত ২০০৩, পৃ. ৩০-৩১।
  22. হোগান ও পণ্ডিত ২০০৩, পৃ. ৩০।
  23. রাহা ও চট্টোপাধ্যায় ২০১৭, পৃ. ১২৬।
  24. মুখোপাধ্যায় ২০০০, পৃ. ২৭-২৮।
  25. রাহা ও চট্টোপাধ্যায় ২০১৭, পৃ. 126।

উল্লখপঞ্জি

সম্পাদনা

আরও পড়ুন

সম্পাদনা