হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত ছায়াছবি "বড় ভালো লোক ছিল" চলচ্চিত্রের একটি সঙ্গীত।[১] ধীর-লয়ের এই মরমী সংগীতের গীতিকার ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক।[২][৩] আলম খানের সুর ও সংগীত আয়োজনে এই গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর।[৩][৪] চলচ্চিত্রে এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। এই গানের দৃশ্যায়নে প্রবীর মিত্রও ছিলেন। গানটির গীতি কতিপয় দেশি বাংলা শব্দ ব্যবহারের জন্য আলোচিত।[৫] এই গানটির সঙ্গীতায়োজন ও কণ্ঠদানের জন্য আলম খান এবং এন্ড্রু কিশোর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।[৬]
"হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস" | ||
---|---|---|
বড় ভালো লোক ছিল অ্যালবাম থেকে | ||
এন্ড্রু কিশোর কর্তৃক একক সঙ্গীত | ||
ভাষা | বাংলা | |
মুক্তিপ্রাপ্ত | ১৯৮২ | |
স্টুডিও | শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিও | |
স্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ | |
ধারা |
| |
দৈর্ঘ্য | ০৩:৫৫ | |
লেবেল | জি-সিরিজ (২০১৮- বর্তমান) | |
লেখক | সৈয়দ শামসুল হক | |
সুরকার | আলম খান | |
প্রযোজক | আলম খান | |
সঙ্গীত ভিডিও | ||
ইউটিউবে "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস" |
পটভূমি ও বিশেষত্ব
সম্পাদনাআমি আরেকটি ছবির সবগুলো গান লিখেছিলাম। ছবির নাম ‘বড় ভালো লোক ছিল।’ এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপও আমার। আমি পীর বংশের ছেলে। ভেতরে একটা আধ্যাত্মিকতা কাজ করে। এ ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখার সময় আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের মধ্যেই ছবির গানগুলো লেখা। বিশেষ করে ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটির কথা বলব।
—কবির বকুলের প্রতি সৈয়দ শামসুল হক[৫]
পটভূমি
সম্পাদনা"বড় ভালো লোক ছিল" চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান "শাওন সাগর"-এর চিত্র পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার জন্য সৈয়দ শামসুল হক এবং সংগীত পরিচালনার জন্য আলম খানকে মনোনীত করেন। সৈয়দ শামসুল হক এই চলচ্চিত্রের গীতিকার হতে আগ্রহী ছিলেন না। চিত্রনাট্যের সাথে গানগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের অনুরোধে সৈয়দ শামসুল হক এই চলচ্চিত্রের জন্য "হায়রে মানুষ রঙ্গীন মানুষ" সহ সকল গান লিখেছিলেন।[৭]
বিশেষত্ব
সম্পাদনামানব জীবনের অবধারিত পরিণতি এই গানের মুখ্য বিষয়।[৮] গীতি রচনা করার ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুল গীতিতে ব্যবহার হয়নি, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন।[৭] গানের কথায় বাংলাদেশের লোকজ শব্দকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।[৯] এই গানের মাধ্যমে 'হুঁশ', 'ঠুশ', 'ফুশ', 'ভুস'-এর মত দেশী বাংলা শব্দগুলোকে কাব্যরূপ দেয়া হয়েছে।[১০] গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বাংলা গানের গীতি নিয়ে গবেষণা করতেন, তাদের পর্যবেক্ষণে 'হুঁশ', 'ঠুশ', 'ফুশ', 'ভুস'-শব্দগুলো বাংলা গানে ইতোপূর্বে ব্যবহার হয় নি।[৫]
সুর আরোপ
সম্পাদনাওরে নীল দরিয়া গানের মত, এই গানেও দুই ধাপে সুর আরোপ করা হয়েছিল। সৈয়দ শামসুল হক এই গানটি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গান বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে এই গানের প্রথম চার লাইন একটি চিরকুটে লিখে এই গানের গায়ক এন্ড্রু কিশোরের উপস্থিতিতে সুরকার আলম খানকে দিয়েছিলেন।[১১] আলম খান গানের মুখের জন্য ত্রিশ থেকে চল্লিশ বার পরীক্ষামূলক সুর আরোপের পর বর্তমান সুর মনোনীত করেন। এই গানের মুখ্য সুর করতে আলম খানের তিন মাস সময় লেগেছিল।[১২] প্রথম চার লাইন বা মুখরার সুর, সৈয়দ শামসুল হকের পছন্দ হওয়ার পর এই গানের অবশিষ্ট অন্তরা আলম খানকে সুরারোপের জন্য সরবরাহ করেছিলেন।[৭] মগবাজারের শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে এই গানের রেকর্ড করা হয়েছিল।[৫][১২]
মুক্তিলাভ
সম্পাদনা১৯৮২ সালে গানটি চলচ্চিত্রের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্র মুক্তির ছত্রিশ বছর পর গানটি জি-সিরিজের ব্যানারে তাদের 'অফিসিয়াল' ইউটিউব চ্যানেলে ৫ এপ্রিল,২০১৮ তারিখে অবমুক্ত করা হয়।[১৩]
জনপ্রিয়তা ও স্বীকৃতি
সম্পাদনাআমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এ গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য। কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয় নি। আপনি যদি আমার চাওয়া মতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আর আপনি যাকে দিয়ে গাওয়াবেন, তার ১০০ পার্সেন্ট লাগবে না, ৬০ পার্সেন্টও যদি গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে- নিশ্চিত।
—এন্ড্রু কিশোর ও আলম খানের প্রতি সৈয়দ শামসুল হক[৭]
মুক্তির পর এই ছায়াছবির সব গান জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে এই গানটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়। এই গানের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।[৫][৭] আলম খান এই চলচ্চিত্রের গানে সুর ও সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ১৯৮২ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ও গায়ক এন্ড্রু কিশোর শ্রেষ্ঠ গায়ক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন।[১১] এন্ড্রু কিশোরের জন্য এটি ছিল প্রথম জাতীয় পুরস্কার।[৫][৭]
বছর | পুরস্কার | মনোনীত | বিভাগ | ফলাফল | তথ্যসূত্র |
---|---|---|---|---|---|
১৯৮২ | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার | আলম খান | শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক | বিজয়ী | [৬] |
এন্ড্রু কিশোর | শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী | বিজয়ী |
বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ও বাংলাদেশ বেতারে এই গান নিয়মিত প্রচার হয়েছে। সম্প্রচার টেলিভিশনের যুগে এই গান নতুন করে বিভিন্ন আপাতবাস্তব টেলিভিশন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়েছে।[১৪][১৫] জনপ্রিয়তার নিরিখে নতুন প্রজন্মের গায়ক গায়িকারা এই গান নতুন করে পরিবেশন করেছেন।[১৬][১৭] এছাড়া এই গান নিয়ে নৃত্য পরিবেশনের উদাহরণ রয়েছে।[১৮]
পুনরুৎপাদন
সম্পাদনা- ২০০৫-এ গানটি সাউন্ডটেকের প্রযোজনায়, ডিজে মোর্তাজার সংগীত পরিচালনায় 'রঙিন মানুষ'-নামক এ্যালবামে নতুন করে প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণে পান্থ কানাই কন্ঠ দেন।[১৬]
- ২৩ আগস্ট, ২০১৬-তে গান বাংলা নামক বাংলাদেশি সম্প্রচার টেলিভিশন নেটওয়ার্কের 'উইন্ড অব চেঞ্জ' নামক সংগীতানুষ্ঠানের জন্য এই গানের মূল গীতি ঠিক রেখে সংগীত পরিচালক কৌশিক হোসেন তাপস নতুন করে সংগীত পরিচালনা করেন। মূল গানের গায়ক এন্ড্রু কিশোর এই সংস্করণেও কণ্ঠ দেন। এই সংস্করণে মূল কণ্ঠের নেপথ্যে কোরাস ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে এই সংস্করণের দৃশ্য ধারণ করা হয়। গানের রেকর্ডিংয়ে বারো জন বিদেশি বাদ্যযন্ত্র শিল্পী অংশগ্রহণ করেন।[১৯] এই সংস্করণটি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে গান বাংলা টেলিভিশনের 'অফিসিয়াল' ইউটিউব চ্যানেলে অবমুক্ত করা হয়।[২০]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "রাজ্জাকের সেরা দশ চলচ্চিত্র"। সময় টিভি। ২০১৭-০৮-২১। ২০১৯-০৮-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ "সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী"। চ্যানেল আই অনলাইন। ২০১৮-০৯-২৭। ২০২০-০৭-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২।
- ↑ ক খ "'হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস'"। বাংলা ট্রিবিউন। ২০১৬-০৯-১৬। ২০১৯-১১-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ "'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস'"। দৈনিক কালের কন্ঠ। ২০১৬-০৯-২৭। ২০১৯-০৩-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ "তিনি যদি আরও কয়েকটা গান দিয়ে যান..."। প্রথম আলো। ২০১৯-০৯-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২।
- ↑ ক খ "জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তদের নামের তালিকা (১৯৭৫-২০১২)"। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন। ২০১৮-১২-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ "সেই সব গানের গল্প"। দৈনিক সমকাল। ২০১৭-০৮-২৫। ২০২১-০১-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ "তিনি সৈয়দ শামসুল হক"। ইউএসবাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০১৬-১০-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "গানে ও চলচ্চিত্রে অনিবার্য সৈয়দ হক : ফরিদ আহমদ দুলাল"। দৈনিক ভোরের কাগজ। ২০১৮-০৯-২৮। ২০২০-০৬-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ "হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস"। সময় টিভি। ২০১৬-০৯-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "'দম ফুরাইলে ঠুস'"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০১৬-০৯-২৭। ২০২০-০৭-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ ক খ "আলম খানের গান ও গল্প"। প্রথম আলো। ২০১৯-০৯-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২।
- ↑ "Old Movie Songs | Haire Manush Rongin Fanush | by Andrew Kishore | Boro Valo Lok Chilo"। জি-সিরিজ। ২০১৮-০৪-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ "Closeup1 2006 [Boishakh.com] Haire Manush - Muhin"। গাও বাংলাদেশ গাও। ২০০৭-০১-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ "Hayre Manush Rongin Fanush | Nannu | Shera Kontho 2017 | Piano Round | Channel i TV"। চ্যানেল আই। ২০১৮-০১-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ ক খ "Haire Manush || Dj Mo Mortuza feat Pantha Kanai || Official Video"। মুসাফির মুর্তজা। ২০১৫-০৩-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ "Haire Manus Rongin Fanus | Konal | Bangla New Song | BanglaVision | 2018 | HD"। বাংলাভিশন। ২০১৮-০৬-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২২ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ "Haire Manush"। নাদিম ইকবাল। ২০১৭-০৮-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।
- ↑ "এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে নতুন করে 'হায়রে মানুষ'"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০১৬-০৮-২৪। ২০২০-০৬-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫।
- ↑ "HAAIREY MANUSH - TAPOSH featuring ANDREW KISHORE : ROBI YONDER MUSIC WIND OF CHANGE [ PS:02 ]"। গান বাংলা। ২০১৬-০৯-১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৫ – ইউটিউব-এর মাধ্যমে।