হকিং বিকিরণ হল কৃষ্ণগহ্বর হতে নিঃসরিত এক ধরনের বিকিরণ যার উৎস হল কৃষ্ণগহ্বরের আশে পাশের এলাকা। কৃষ্ণবিবরের ঘটনা দিগন্ত হতে এই বিকিরণের যাত্রা শুরু বলে ধরে নেয়া হয়। হকিং বিকিরণ নামকরণ করা হয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের নাম অনুসারে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংই ১৯৭৪ সালে একটি অঙ্ক কষে দেখান এর অস্তিত্বের কথা।[১] কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি যে সবচে দ্রুত বেগে ধাবমান আলোর কণাও এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা। একবার কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের (Event Horizon) ব্যাসার্ধের মধ্যে যদি কোন কিছু ঢুকে যায়, ফেরত আসার আর কোন পথ থাকেনা। যেহেতু আলোও এর মধ্য থেকে বের হতে পারেনা তাই কৃষ্ণগহ্বর দেখা যায়না। এমন বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের মাঝে বিজ্ঞানী হকিং বললেন কৃষ্ণগহ্বর থেকেও বিকিরণ সম্ভব। এবং এটা নিয়মিত হচ্ছে। এই বিকিরণের জন্য যে শক্তি দরকার তা ঐ কৃষ্ণগহ্বরই সরবারহ করে। এই বিকিরণকেই হকিং বিকিরণ বলা হয়। বিজ্ঞানী জ্যাকব বেকেনস্টাইন, যিনি কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি এবং তাপমাত্রা নিয়ে অনেক গবেষণা করে গেছেন এবং বলে গেছেন যে কৃষ্ণগহ্বরের একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও এনট্রপি থাকবে যা শূন্যও নয়, অসীমও নয় বরং সসীম। তাই এই বিজ্ঞানীর নামকে অন্তর্ভুক্ত করে অনেক সময় এ বিকিরণকে হকিং-বেকেনস্টাইন বিকিরণও বলা হয়।[২]

শিল্পীর তুলিতে আঁকা কৃষ্ণগহ্বর

হকিং এর কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে তার মস্কো পরিদর্শনের পর যেখানে সোভিয়েত বিজ্ঞানী ইয়াকভ যেলদোভিচ এবং অ্যালেক্সেই স্টারোবিনস্কি তাকে দেখান যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি অনুসারে ঘূর্ণায়মাণ কৃষ্ণগহ্বরের কণা তৈরি এবং নির্গমন করার কথা। হকিং বিকিরণ কৃষ্ণগহ্বরের ভর এবং শক্তি কমায় যেটা black hole evaporation নামেও পরিচিত। এই কারণে, যেসব কৃষ্ণগহ্বরের অন্য কোনো কারণে ভর বৃদ্ধি পায় না তারা ছোটো হতে থাকবে এবং সবশেষে নিঃশেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হয়। ধারণা করা হয় যে, ছোটো কৃষ্ণগহ্বর বড় কৃষ্ণগহ্বর হতে বেশি পরিমাণে বিকিরণ নিঃসরণ করে এবং তাড়াতাড়ি ছোটো এবং নিঃশেষ হয়।

২০০৮ সালের জুন মাসে নাসা ফার্মি স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করে যেটা প্রান্তীয় গামা রশ্মির খোঁজ করছে প্রাথমিক পর্যায়ের কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিঃসৃত বলে আশা করা হয়। এই ঘটনায় লার্জ এক্সট্রা ডাইমেনশন এর তত্বগুলো সঠিক হলে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার হয়তবা ছোটো আকারের কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে সক্ষম হবে এবং তার নিঃশেষকরণ দেখতে পারবে।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দাবি করা হয় যে একটা পরীক্ষাগারে অপ্টিকাল লাইট পালস নিয়ে পরীক্ষনে একটা সঙ্কেত দেখা যায় যেটা কৃষ্ণগহ্বরের হকিং বিকিরণের সাথে খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাও ফলাফলগুলো অপরীক্ষিত এবং বিতর্কিতই থেকে যায়। এই বিকিরণ শনাক্ত করতে অন্য প্রজেক্টও শুরু হয়েছে অ্যানালগ গ্র্যাভিটির কাঠামোতে।

ব্যাখ্যা সম্পাদনা

হকিং বিকিরণের ব্যাখ্যা দেয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী শূন্যস্থান আসলে শূন্য না। সে শূন্যস্থানে অবিরত ভার্চুয়াল কণা নামের কণিকারা জোড়ায় জোড়ায় উৎপন্ন হচ্ছে। এই জোড়ার মধ্যে একটি বাস্তব কণা, অন্যটি প্রতিকণা। এই কণা প্রতিকণা উৎপন্ন হবার পর এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মত ক্ষুদ্র সময়েই এরা একটা আরেকটার সাথে মিলে নিঃশেষ হয়ে যায়। সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু যখন এই ভার্চুয়াল কণারা কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের কাছে সৃষ্টি হয় তখন কৃষ্ণগহ্বর এই কণাদের প্রভাবিত করে। কৃষ্ণগহ্বর কর্তৃক প্রযুক্ত শক্তির প্রভাবে এই কণাযুগল আর একে অপরের সাথে মিলিত হয়না। দুটি কণার একটিকে নিজের দিকে টেনে নেয় আরেকটিকে বাইরে ঠেলে দেয়। কণাটির বাইরে চলে আসতে যে শক্তির দরকার হয় তা সরবারহ করে কৃষ্ণগহ্বর নিজে।

কৃষ্ণগহ্বরের নিঃশেষ সম্পাদনা

কণাকে বাইরের দিকে ঠেলে দিতে যে অতিরিক্ত শক্তি লাগে তা যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরই সরবারহ করে তাই যতবারই এই ঘটনা ঘটবে কৃষ্ণগহ্বর কিছুটা শক্তি হারাবে। আইনস্টাইনের ভর শক্তি সমীকরণ E=mc2ভর আর শক্তি একই জিনিস। শক্তি হারানোর অর্থ হল তার ভর কমে যাওয়া। এভাবে যদি বিকিরণ চলতেই থাকে তবে কৃষ্ণগহ্বর তাত্ত্বিকভাবে ভর হারাতে হারাতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Charlie Rose: A conversation with Dr. Stephen Hawking & Lucy Hawking"। ২৯ মার্চ ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১৩ 
  2. "হকিং বিকিরণ কী?"। ১০ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১৩ 
  3. মাসিক জিরো টু ইনফিনিটি; নভেম্বর ২০১৩

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা