সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়

বাঙালি মৃত্তিকাবিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ

ড.সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় (১৩ অক্টোবর ১৯১৪ - ১৮ নভেম্বর ২০০৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি মৃত্তিকাবিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। সয়েল সায়েন্স বা মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও মৃত্তিকা রসায়ন গবেষণায় ভারতে তিনি ছিলেন অগ্রণীর ভূমিকায়। কলকাতা ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তিনি। [২]

সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়
জন্ম(১৯১৪-১০-১৩)১৩ অক্টোবর ১৯১৪[১]
মৃত্যু১৮ নভেম্বর ২০০৬(2006-11-18) (বয়স ৯২)
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা
পরিচিতির কারণমৃত্তিকাবিজ্ঞানী
দাম্পত্য সঙ্গীকে কে রোহাতগি-মুখার্জি
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্ররসায়ন
প্রতিষ্ঠানসমূহকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
ডক্টরাল উপদেষ্টাজ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
ডক্টরেট শিক্ষার্থীড.অনিলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কুলকাঠি গ্রামে। পিতা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ভগবতীচরণ মুখোপাধ্যায় স্বদেশী আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং রিপন স্কুলে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পাশের পর রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আইএসসি ও রসায়নে অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভৌত রসায়নে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এমএসসি পাশ করেন। বিশিষ্ট রসায়নবিদ নীলরতন ধর, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, শান্তি স্বরূপ ভাটনগর প্রমুখেরা তার উচ্চ প্রশংসা করেন। [১]এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট রসায়নবিদ জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ইন্ডিয়ান (তৎকালীন ইম্পেরিয়াল) এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে অ্যাসোসিটরশিপ কার্যক্রম সমাপ্ত করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে "ইলেক্ট্রোকেমিস্ট্রি অফ ক্লে"র উপর গবেষণায় তিনি ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নির্দেশ—বড়ো হয়ে যেন দেশের মুখ রাখতে পারিস পালন করতে শিক্ষকের ন্যায় সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনে দীর্ঘদিন গবেষণার কাজে লিপ্ত ছিলেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের সয়েল তথা মৃত্তিকা সম্পদের উপর জাতীয় পরিকল্পনায় সর্বেক্ষণ কার্যসূচি গৃহীত হলে, সুশীলকুমার পূর্ব ভারতের সর্বেক্ষণের প্রধান হন। মৃত্তিকা সংক্রান্ত নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় অনেকসময় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে, পূর্ব বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে, ওড়িশার নির্জন সমুদ্রতটে, উত্তরবঙ্গ ও অসমের পার্বত্য ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে।[১] মৃত্তিকা-কণা, মৃত্তিকার আয়ণ-এক্সচেঞ্জ, থার্মোডায়নামিক্স ইত্যাদি বিষয়ে তার গবেষণা আন্তর্জাতিক স্তরে স্থান লাভ করেছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি "ইউনেস্কো-প্রফেসর" পদ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া যান। জার্মান, ফরাসি, রুশভাষা তার আয়ত্তে ছিল, পরে ডাচ ও ইন্দোনেশিয় ভাষাও শিখেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় তিন বৎসর অবস্থানকালে সেখানে শুধু বিজ্ঞানের শিক্ষা দেন নি, তিনি রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে মনোগ্রাফ তথা প্রকরণগ্রন্থ রচনা করে দিয়েছিলেন। [১] তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আগ্রহে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে 'প্রফেসর অফ ম্যাক্রোমলিকিউলস' পদে যোগ দেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি রসায়ন বিভাগের ডিন ও প্রধান হয়ে নবগঠিত কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এই সময়েই তিনি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আগ্রহে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে নোবেলজয়ী ব্রিটিশ প্রাণরসায়নবিদ রিচার্ড লরেন্স মিলিংটন সিঞ্জের সঙ্গে যৌথভাবে "পৃথিবীতে প্রাণের উৎস সন্ধানে" গবেষণা পরিকল্পনায় যুক্ত হন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম আচার্য পি সি রায় প্রফেসর অফ এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড সয়েল সায়েন্স সম্মানজনক পদে আসীন হন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। [২]

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে অধ্যাপনা ও দীর্ঘ গবেষণার কাজে থেকেও দেশে-বিদেশর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের মাসিক পত্র—এভরিম্যানস সায়েন্স পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন টানা চল্লিশ বৎসর। দেশ-বিদেশের নানা পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রায় দু-শো গবেষণাপত্র ও একাধিক বই রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উত্তরসূরি। তিনি সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসংক্রান্ত যেকোন প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। খ্যাতির শিখরে থেকেও তিনি কিন্তু অতি সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গিয়েছেন।[২] প্রখ্যাত ভৌত রসায়নবিদ অধ্যাপিকা কে কে রোহাতগিকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। [১] অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Sushil Kumar Mukherjee" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৮ 
  2. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৪৬৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬