সুরমা মিত্র দাশগুপ্ত

ড.সুরমা মিত্র দাশগুপ্ত, শাস্ত্রী (১০ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ – ১২ জুন ১৯৯৮) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত ও দার্শনিক। বাংলার তথা ভারতের প্রথম ডক্টরেট সম্মানে ভূষিতা মহিলা ছিলেন তিনি। [১]

সুরমা মিত্র দাশগুপ্ত
জন্ম(১৯০৭-০৯-১০)১০ সেপ্টেম্বর ১৯০৭
মৃত্যু১২ জুন ১৯৯৮(1998-06-12) (বয়স ৯০)
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাঅধ্যাপনা
উল্লেখযোগ্য কর্ম
ডেভেলপমেন্ট অফ মরাল ফিলোজফি অফ ইন্ডিয়া
দাম্পত্য সঙ্গীসুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (বি.১৯৪৫,মৃ.১৯৫২)

দার্শনিক জীবন

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

সুরমা মিত্রের জন্ম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়। পিতা হরেন্দ্রনারায়ণ মিত্র। তাদের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। অল্প বয়সে তার পিতার মৃত্যু হলে, তিনি মা, ভাই বোনসহ মাতামহ সুপণ্ডিত ঈশানচন্দ্র বসুর কাছে চলে যান। কয়েক বছর তার কাছে কাটানোর ফলে মাতামহের প্রভাব পড়েছিল তার উপর। এমনিতেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন সুরমা। কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বেথুন কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এ এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতের নয়টি বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে এম.এ পাশ করেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তিনি স্বর্ণপদক, বৃত্তি ও আর্থিক পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে সংস্কৃত কলেজ থেকে “কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ” এর উপর গবেষণা করে “শাস্ত্রী” উপাধি লাভ করেন।[১] সংস্কৃত কলেজে পাঠের সময় থেকে দীর্ঘ দশ বৎসর প্রথিতযশা দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ছাত্রী ছিলেন তিনি। তারই অধীনে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের দুটি বিষয়ের উপর গবেষণা করে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি (বর্তমানকালের ডি.লিট. সমতুল্য) ডিগ্রি অর্জন করেন। [২]ভারতীয় মহিলাসমাজে সুরমা মিত্রই সর্বপ্রথম “ডক্টরেট” সম্মানের অধিকারিণী। ছাত্রীরূপে গবেষণা চলাকালে তিনি তার গুরু-শিক্ষককের প্রখ্যাত গ্রন্থ “এ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফিলসফি “ (৫ খণ্ড) সম্পাদনায় গুরুকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। [১] ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দেই তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তাকে নিয়ে অপবাদ ও কলঙ্কে মধ্যে জডিয়ে পড়েন এবং সে সব অপবাদের কথা শিক্ষকের পরিবার থেকেই আসে, পরিণতিতে তার বর্তমান স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে এবং তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। শিক্ষককে অপবাদ আর কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে সুরমা শিক্ষককে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আর্যমতে বিবাহ করেন। [৩] এই বিবাহকে কেন্দ্র করে সমাজ তাদের যতদূর সম্ভব বেইজ্জত ও বে-আব্রু করার চেষ্টা করে। শেষে তিনি ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন যাত্রা করেন অবসর প্রাপ্ত স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে।

কর্মজীবন সম্পাদনা

সুরমা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। পাঁচ বছর পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তারা দেশে ফিরে আসেন। দু-বছর পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর তার স্বামী সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। তিনি ১৭ বৎসর অধ্যাপনার পর ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পরও তিনি বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫/৬ বছর অতিথি অধ্যাপক হিসাবে সংস্কৃত ও দর্শন পড়িয়েছেন। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় এমনকি অবসরের পর বিদেশের বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলোরাডোতে এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিলোজফিক্যাল কনফারেন্সে যোগ দেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে হাওয়াইতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ফিলজফিক্যাল কনফারেন্সে একমাত্র মহিলা ছিলেন তিনিই। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম জার্মানি সরকারের আমন্ত্রণে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যান ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরিখের সি জি জাং ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেন।

তিনি ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের উপর রচিত —ডেভেলপমেন্ট অফ মরাল ফিলজফি অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে বেদ, উপনিষদ, মীমাংসা, স্মৃতি, গীতা, বেদান্ত, সাংখ্যযোগ, ন্যায়, বৈশেষিকা, বৌদ্ধ এবং জৈন চিন্তাধারা সমীক্ষা করে ভারতীয় নৈতিকতার ক্রমবিকাশের সূত্র ব্যাখ্যা করেছেন। তার অপর গ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলি হল-

  • অ্যান এভার এক্সপ্যান্ডিং কোয়েস্ট অফ লাইফ অ্যান্ড নলেজ
  • রিলিজিয়ন অ্যান্ড ন্যাশনাল আউটলুক
  • ফান্ডামেন্টালস অফ ইন্ডিয়ান আর্ট

তার বহু রচনা অবশ্য অপ্রকাশিত থেকে গেছে।

শেষ জীবন সম্পাদনা

অধ্যাপিকা সুরমা দাশগুপ্তের শেষজীবন কেটেছে মঠবাসিনী সন্ন্যাসিনী হিসাবে। মধুপুরের সন্ন্যাসী ধর্মমেঘ আরণ্যের দীক্ষিতা ছিলেন তিনি। ১৯৭২-৮১ খ্রিস্টাব্দের সময়ে মধুপুরের কাপিলমঠে স্বামী হরিহরানন্দ সাংখ্যযোগাচার্য আরণ্যের 'দ্য যোগ ফিলজফি অফ পাতঞ্জল', দ্য সাংখ্য সূত্রজ অফ পঞ্চশিখা প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশনার দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এরপর কিছুদিন তিনি লখনউ এবং জামশেদপুরের বৃদ্ধাশ্রমে কাটিয়ে পুনরায় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মধুপুরে ফিরে আসেন এবং কাপিলমঠের ভক্তনিবাসে থাকেন এবং এখানেই ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন পরলোক গমন করেন।[১]


তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৪৫৯,৪৬০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. দাশগুপ্ত, সুরমা (১৯৯৪)। Development of moral Philosophy in India। মুন্সীরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রা লি। আইএসবিএন 8121506271  অজানা প্যারামিটার |পাতাসমূস= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  3. "Surendranath Dasgupta Biography"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৩