সুফি–সালাফি সম্পর্ক

সালাফিবাদসুফিবাদ নামক ইসলামের দুটি পৃথক ব্যাখ্যাবিশিষ্ট আন্দোলনের মধ্যকার সম্পর্ক হল ঐতিহাসিকভাবে বৈচিত্র্যময় এবং এটি আজকের দিনে মুসলিম বিশ্বের কিছু পরিবর্তন ও দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।[১]

সালাফিবাদ হল ইসলামের আক্ষরিক, কঠোরসনাতন পদক্ষেপ। পশ্চিমা বিশ্বে একে প্রায়শই ওয়াহাবিজিহাদি মতবাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[২] সুফিবাদ হল আত্মার পরিশুদ্ধি এর মাধ্যমে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা:) এর নৈকট্য লাভের (তাসাউফ-তাজকিয়া) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দুনিয়াতে সঠিক ভাবে চলার জ্ন্য এবং জান্নাত বা স্বর্গে উচ্চমর্যাদা অর্জনের জন্য ভালো মুসলিম ও ভালো মানুষ হওয়ার দিকে নজর দেয়।[৩]

কিছু মুসলিম সালাফিবাদ ও সুফিবাদকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে করলেও, সালাফিগণ সুফিবাদের প্রতি সমালোচনাসূচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।[৪] বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের মতে, সালাফিগণ "সাধারণত ... ছাড়বিহীনভাবে ভক্তিমুলক সুফি চর্চাসমূহের বিরোধী",[৫] তাদের দাবি হল, সুফিবাদ ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,[৪] এবং এটি এমন একটি উপাদান যা আধুনিক সময়ে ইসলামকে বিকৃত করছে।[৬] এই দুই আন্দোলনের মাঝে সম্পর্ককে সাধারণত "সাক্ষাত যুদ্ধ",[৭] বা "দলীয় ফাটল" বলে অভিহিত করা হয় যা কার্যত প্রতিটি মুসলিম দেশে[৮] এবং পাশাপাশি পাশ্চাত্যের অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়গুলোতে দেখা যায়।[৯]

ইতিহাস সম্পাদনা

সুফিদের বিরুদ্ধে সালাফিবাদীদের বিরোধিতার অধিকাংশই আরোপিত হয় ১৮শ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব-এর লেখনী ও তার অনুসারীদের উপর। অনেকে দাবি করেন, তার অনুসারীরা সুফিবাদের প্রতি তুলনামুলক অধিক মিত্রভাবাপন্ন ছিলেন, যা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের পুত্র লিখেছেন,

"আমরা সুফিদের তরীকাসমূহ এবং হৃদয় ও অঙ্গের সাথে সম্পর্কি‌ত পাপসমূহ থেকে অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধি (তাজকিয়া) কে অস্বী‌কার করি না, যতক্ষণ পর্য‌ন্ত ব্যক্তি শরিয়াহর নীতি ও পরীক্ষিত-সঠিক পন্থা পূর্ণ‌রুপে অনুসরণ করে।[১০]"

এছাড়াও ইবন তায়মিয়া, যাকে সালাফি মতবাদের অন্যতম পূর্বসূরী বলে মনে করা হয়, তিনি সুফীদের সমালোচনার ক্ষেত্রে তুলনামূলক নমনীয়তা প্রদর্শন করতেন। পাশাপাশি, জুনায়দ বাগদাদীসহ অনেক সালাফি পণ্ডিত সূফীদের প্রশংসা করেছেন।[১১]

১৯৭০-এর মাঝামাঝি সময়ে তেলের দাম তিনগুণ হওয়ার পর এবং সৌদি আরামকো তেল কোম্পানিকে সৌদি আরব ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সালের মাঝে ধাপে ধাপে অধিকরণের পর, সৌদি আরব প্রশাসন তেল রপ্তানির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক আয় লাভ করতে শুরু করে। দেশটি ইসলামী বিশ্বব্যাপী দশ বিলিয়ন ডলার ব্যায় করে নিজ দেশে সমর্থিত ইসলামী আন্দোলনকে প্রচার করার জন্য, যা সালাফি ইসলাম নামে পরিচিত।[১২][১৩][১৪] নিনা ওয়ার্বনারের মতানুসারে, সৌদি আরব সালাফি/ওয়াহাবি বিশেষজ্ঞদের (পাশাপাশি আধুনিকায়ন শক্তির) পেছনে অর্থায়নের ফলে সুফি তরিকাগুলো ১৯৭০ ও ৮০-র দিকে সমূলে বিলুপ্ত হবার সঙ্কটে পড়ে। যদিও তরিকাগুলো তখন থেকে আবারও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে, তারপরও ওয়ার্বনার একবিংশ শতাব্দীকে সুন্নি ইসলাম বিশ্বে এই দুই দলের মাঝে সাক্ষাত সংঘাতের উন্মেষের উষালগ্ন বলে বর্ণনা করেন। [৭]

Islamopedia.org-এর দাবিমতে, ২০১১-সালে সালাফি দলগুলো বিপুলসংখ্যক সুফি মসজিদ ও মাজার ধ্বংস করা ও জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে, যা ছিল দুটি দলের মাঝে "সুদীর্ঘ অবদমিত বৈরিতার পুনর্জাগরণের বহিঃপ্রকাশ"।[১৫] আল-আজহারের প্রধান মুফতি আলি গোমা, যিনি নিজে একজন সুফি মতবাদের অনুসারী, তিনি এই প্রথাকে অগ্রহণযোগ্য বলে এর সমালোচনা করেন।[১৫]

বিশ্বাস ও চর্চায় পার্থক্য সম্পাদনা

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুফি বিশ্বাস ও চর্চা আছে যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাখ্যায় সালাফি ও সুফিদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে:

  • ধর্মীয় তথ্যসূত্র - সূফিবাদে কোন ধর্মীয় তথ্যসূত্র ও তার ব্যাখ্যায় (কোরআন, হাদীস, তাফসীর, ধর্মীয় ঘটনা, ধর্মপণ্ডিতদের জীবনী ও বাণী) সঠিকতার চেয়ে যৌক্তিকতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, অপরদিকে সালাফিবাদে কোন তথ্যসূত্র ও তার ব্যাখ্যায় যুক্তিবোধের তুলনায় সঠিকতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সনদ, বর্ননাকারী, ইতিহাস ইত্যাদির মাধ্যমে সঠিকতার যাচাইকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
  • আল্লাহর ভৌত বৈশিষ্ট্য - অনেক সুফি বিশ্বাস করে, আল্লাহ অদৃশ্য, নিরাকার, সর্বত্র বিরাজমান ও সকল জীবের ও বস্তুর অন্তরে বাস করেন, আবার অনেক সূফি বলেন, আল্লাহ অদৃশ্য-নিরাকার নন ও সর্বত্র বিরাজমান নন, কিন্তু আল্লাহর ক্ষমতা ও নূর সর্বত্র বিরাজমান। সালাফিগণ বিশ্বাস করে, আল্লাহ দর্শনযোগ্য, সকল জৈবিক সৃষ্টির অজ্ঞাত অনন্য আকৃতিসম্পন্ন ও আরশে সমাসীন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান নন, এবং কেয়ামতের বিচারের পর জান্নাতীগণ তাদের চূড়ান্ত পুরস্কার হিসেবে আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতরূপে দেখতে পাবে।
  • তরিকত/তরিকা (ধর্মীয় আধ্যাত্মিক পন্থা/পাঠশালা) ও ফিকহ-ই-মাযহাব (আইনশাস্ত্রের পন্থা/পাঠশালা) - সুফিগণ তরিকা নামক পন্থায় বিশ্বাসী, যেখানে মুর্শিদ নামক শিক্ষকের কাছে মুরিদ নামক অনুসারীরা শিক্ষাগ্রহণ করে; সালাফিরা তরিকতকে অস্বীকার করলেও তারা বিভিন্ন ফকিহ বা ধর্মীয় আইনবিদের আইনশাস্ত্রকে তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে, যা ফিকহী মাজহাব নামে পরিচিত।
  • মারিফাত (গুপ্ত স্বর্গীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞান) - সুফিগণ মারিফাতে বিশ্বাস করে আর সালাফিরা এই ধারণাকে অস্বীকার করে।
  • বেলায়েত (আল্লাহর নৈকট্য/অভিভাবকত্ব) ও কেরামত (অলোকিক নিদর্শন) - সুফিগণ বিশ্বাস করে যে, কুরআন হাদীস অনুসরণের পাশাপাশি, কেরামত লাভও বেলায়েতে উচ্চমর্যাদা লাভের একটি লক্ষণ, সালাফিগণ বিশ্বাস করে যে, কুরআন সুন্নাহ অনুসরণই বেলায়েতের একমাত্র লক্ষণ, এবং কেরামত ও বেলায়েতের কোন সম্পর্ক নেই। সুফিগণ বিশ্বাস করে যে, কেরামতের উপর অলীদের (বেলায়েত অর্জনকারী) নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ আছে, সালাফিগণ বিশ্বাস করে, কেরামতের উপর অলীদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
  • তাজকিয়া (আত্মশুদ্ধি) - সুফি বিশ্বাস দাবি করে যে, তাজকিয়ায় সহায়তা বা মধ্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট কোন প্রশিক্ষকের (পীর বা শাইখ) সাহচার্য বিশেষভাবে প্রয়োজন; অপরদিকে সালাফি বিশ্বাসমতে, আত্মশুদ্ধির জন্য সকল ধার্মিক, পুণ্যবান ও সৎ লোকের সাহচার্য সমানভাবে প্রয়োজন। তবে, এক্ষেত্রে সুফি সালাফি চর্চা এক যে, তারা উভয়েই তাজকিয়ায়ে নফস পুনর্গঠনের ব্যাখায় কুরআনের তথ্যসূত্র অনুযায়ী নফসের তিনটি দশার কথা ব্যাখ্যা করে থাকে।
  • রুহ (আত্মা), নফস (প্রবৃত্তি) ও লাতায়িফ-এ সিত্তাহ (ছয়টি সূক্ষ সত্তা) - রুহ ও নফসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, সুফিগণ লাতায়িফে সিত্তাহর ধারণা অনুসরণ করে থাকে, আর সালাফিগণ তা প্রত্যাখ্যান করে।
  • বিদআতের সংজ্ঞা (ধর্মীয় বিষয়ে নব-উদ্ভাবন) — প্রথাগত সূফি পণ্ডিতরা এর অন্তর্ভুক্তিমূলক, সার্বজনীন সংজ্ঞা দাবি করে[১৬] যেখানে সালাফিগণ এর অন্তর্ভুক্তিবিহীন, স্বতন্ত্র ও আক্ষরিক সংজ্ঞা দাবি করে যা মুহাম্মদ কর্তৃক করা হয় নি বা নিশ্চিত হয় নি এমন সবকিছুকে বাতিল করে।
  • ঈদে মিলাদুন্নবী (মুহাম্মাদ -এর জন্মদিন পালন) — সালাফিগণ কর্তৃক বিদআত হিসেবে বিবেচিত।[১৭]
  • উরস (সুফি সাধকদের মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভা) — সালাফিগণ কর্তৃক বিদআত হিসেবে বিবেচিত।[১৭]
  • নাশিদ (মুহাম্মদ- এর প্রশংসামূলক কবিতা) — সালাফিগণ বিরোধিতা করে। তবে, কিছু সালাফি বাজনা ছাড়া মুহাম্মদ এর প্রশংসামূলক কবিতাকে অনুমোদিত বলে বিবেচনা করেন।
  • যিকির অনুষ্ঠান (আল্লাহর স্মরণের অনুষ্ঠান) — সালাফিগণ বিরোধিতা করে।[১৮][১৯]
  • তাওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) নবী, পুন্যবান বা সুফি সাধকের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া পৌছানো, তারা হতে পারে জীবিত, বা মৃত। সালাফিদের মতে," কোন ব্যক্তি এবং আল্লাহর মাঝে যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে কোন মধ্যস্থতাকারীর উপর নির্ভর করা" হল ইসলাম হতে খারিজ হয়ে যাওয়া দশটি কাজের মধ্যে একটি। কিছু সালাফি বিশ্বাস করেন যে,কোন জীবিত পুণ্যবান ব্যক্তিকে তাওয়াসসুল হিসেবে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলা যেতে পারে।[২০]
  • উসীলা (মুহাম্মদ এর মধ্যস্থতাকারী ক্ষমতাবলী) — সালাফিগণ উসীলাকে শির্কের সমতুল্য মনে করে থাকে। তাদের মতে, নবী মুহাম্মাদ মরণশীল মানুষ তাই তিনি এখন আর জীবিত নেই, তাই তিনি এখন আর কোন পার্থিব জীবনের প্রার্থীর জন্য মধ্যস্ততা করতে সক্ষম নন। সুফিগণ বিশ্বাস করে শারীরিকভাবে পৃথিবীতে উপস্থিত না হলেও নবীগণ, শহীদগণ ও সুফি সাধকগণ মৃত্যুর পরও জীবিত। কিছু সালাফি বিশ্বাস করে কুরআন হাদীসে যে উসীলার কথা বলা হয়েছে তা ভালো কাজের উসীলা বা আল্লাহর গুণবাচক নামের উসীলা।[২০][২১]
  • জিয়ারত (নবী ও সুফি সাধকদের কবর পরিদর্শন) — পীর-আওলিয়ার কবর পরিদর্শনের সুফি চর্চাও সালাফিদের আপত্তির বিষয়। সালাফিরা বিশ্বাস করে যে, একজন মুসলিম কেবল ইসলামের তিনটি পবিত্রতম স্থান ভ্রমণ করতে পারে, এগুলো হল মক্কা, মদীনা ও জেরুজালেম মসজিদ, যেমনটি ইসলামী নবী মুহাম্মাদের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • ওয়াহদাতুল উজুদ - সুফিরা এ ধারনায় বিশ্বাস করে যে সকল বস্তুই আল্লাহর অস্তিত্বের অংশ, সালাফিরা এ মত প্রত্যাখ্যান করে।
  • হুলুল বা ইত্তিহাদ - সুফিরা জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনে বিশ্বাস করে, যা সালাফিরা করে না।
  • মোরাকাবা- সুফিরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য মোরাকাবা নামক ধ্যান করে, সালাফিরা একে বহির্ভূত ও পরিত্যাজ্য বলে মনে করে।
  • ফানা - সুফিরা ফানা হওয়ার মাধ্যমে নিজের দেহে আল্লাহকে অনুভব করে বলে দাবি করে, সালাফিরা একে ভ্রান্ত, শিরক ও কুফর বলে মনে করে।
  • বাকা - সুফিরা আত্মার মুক্তিকে বাকা বলে মনে করে, যা আল্লাহর সঙ্গে দেখা করে আসে বলে তারা দাবি করে, সালাফিরা এ ধারণাকেও ভুল বলে দাবি করে।
  • তানাসুখ - সুফিরা তানাসুখ নামে পুনর্জন্মকে বিশ্বাস করে, সালাফিরা এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।
  • মুজাহাদা- সুফিরা মুজাহাদা নামে শরিয়তের বাইরে নব উদভাবিত পদ্ধতিতে সাধনা করে, সালাফিরা তা করে না।
  • ইসালে সওয়াব - সুফিরা শরিয়ত বহির্ভূত বিভিন্ন পদ্ধতিতে মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পৌছানো যায় বলে দাবি করে, যাকে তারা ইসালে সওয়াব বলে, অপরদিকে সালাফিরা দাবি করে, শরিয়ত অনুযায়ী জীবদ্দশায় সদকায় জারিয়া, নেক সন্তান আর জীবদ্দশার নেক আমল ছাড়া মৃত ব্যক্তির কাছে নতুন সওয়াব পৌছানোর কোন সুযোগ নেই।
  • কাশফ - সুফিরা বিশ্বাস করে যে, কাশফের মাধ্যমে কোরআন ও সুন্নাহর সমান বা অধিক জ্ঞান অর্জন করা যায়, অপরদিকে সালাফরা একে প্রত্যাখ্যান করে।
  • বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য - সুফিরা বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে মনে করে থাকে, আর সালাফিরা বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যকে শরিয়তে নিষিদ্ধ বলে দাবি করে থাকে।
  • মাকাম - সুফিরা মাকাম সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধারণায় বিশ্বাস করে, এগুলো হলো তাদের দ্বারা শ্রেণীবদ্ধ কিছু অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আত্ম-গৌরব এবং শুদ্ধির বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়,[২২] কিন্তু সালাফিরা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত অনুশীলন ছাড়া আত্মশুদ্ধির বাকি সকল অভ্যাস প্রত্যাখ্যান করে।

আলেমদের অভিমত সম্পাদনা

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সুফি-সালাফি(ওহাবী) সম্পর্কের ব্যাপারে তার ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বইতে বলেন,

‘ওহাবী মতবাদ’-কে জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে অনেক গবেষক উল্লেখ করছেন। সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (১৭০৩-১৭৯২ খৃ) প্রচারিত মতবাদকে ‘ওহাবী’ মতবাদ বলা হয়। তিনি তৎকালীন আরবে প্রচলিত কবর পুজা, কবরে সাজদা করা, কবরে বা গাছে সুতা বেঁধে রাখা, মানত করা ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার, শিরক, বিদ‘আত ইত্যাদির প্রতিবাদ করেন। তাঁর বক্তব্য শুধু প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উপরন্তু তাঁর বিরোধীদের তিনি মুশরিক বলে অভিহিত করতেন। ১৭৪৫ খৃস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের অনতিদূরে অবস্থিত দিরইয়া্য নামক ছোট্ট গ্রাম-রাজ্যের শাসক আমীর মুহাম্মাদ ইবনু সাঊদ (মৃত্যু ১৭৬৫) তাঁর সাথে যোগ দেন। তাদের অনুসারীরা তাদের বিরোধীদেরকে মুশরিক বলে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালন শুরু করেন। ১৮০৪ সালের মধ্যে মক্কা-হিজায সহ আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ ‘সাউদী’- ‘ওহাবী’দের অধীনে চলে আসে। তৎকালীন তুর্কী খিলাফত এ নতুন রাজত্বকে তার আধিপত্য ও নেতৃত্বের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন। কারণ একদিকে মক্কা-মদীনা সহ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, অন্যদিকে মূল আরবে স্বাধীন রাজ্যের উত্থান মুসলিম বিশ্বে তুর্কীদের একচ্ছত্র নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তুর্কী খলীফা দরবারের আলিমগণের মাধ্যমে ওহাবীদেরকে ধর্মদ্রোহী, কাফির ও ইসলামের অন্যতম শত্রু হিসেবে ফাতওয়া প্রচার করেন। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারাভিযান চালানো হয়, যেন কেউ এ নব্য রাজত্বকে ইসলামী খিলাফতের স্থলাভিষিক্ত মনে না করে। পাশাপাশি তিনি তুর্কী নিয়ন্ত্রণাধীন মিসরের শাসক মুহাম্মাদ আলীকে ওহাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন। মিশরীয় বাহিনীর অভিযানের মুখে ১৮১৮ সালে সউদী রাজত্বের পতন ঘটে। এরপর সাউদী রাজবংশের উত্তর পুরুষেরা বারংবার নিজেদের রাজত্ব উদ্ধারের চেষ্টা করেন। সর্বশেষ এ বংশের ‘আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুর রাহমান আল-সাউদ (১৮৭৯-১৯৫৩) ১৯০১ থেকে ১৯২৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বর্তমান ‘সৌদি আরর’ প্রতিষ্ঠা করেন। খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মুসলিম বিশ্বের যেখানেই সংস্কারমূলক কোনো দাওয়াত বা আহবান প্রচারিত হয়েছে, তাকেই সৌদি ‘ওহাবীগণ’ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত বলে দাবি করেছেন। অপরদিকে তুর্কী প্রচারণায় ‘ওহাবী’ শব্দটি মুসলিম সমাজে অত্যন্ত ঘৃণ্য শব্দে পরিণত হয়। তাদেরকে অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের চেয়েও অধিকতর ঘৃণা করা হয়। ফলে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বৃটিশ বিরোধী আলিমদেরকে ওহাবী বলে প্রচার করতেন; যেন সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকে। এছাড়া মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরকে নিন্দা করার জন্য ‘ওহাবী’ শব্দের ব্যাপক ব্যাবহার করেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের সমসাময়িক ভারতীয় মুসলিম সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (১৭০৩-১৭৬২ খৃ)। তাঁর মত-প্রচারের প্রথম দিকে ১৭৩১ খৃস্টাব্দে তিনি মক্কায় গমন করেন এবং তিন বৎসর তথায় অবস্থান করেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি ভারতে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনিও কবর পূজা, পীর পূজা, কবরে মানত করা, কবরবাসী বা জীবিত পীর বা ওলীগণের কাছে বিপদমুক্তির সাহায্য চাওয়া ও অন্যান্য শিরক, বিদ‘আত, কুসংস্কার, মাযহাবী বাড়াবাড়ি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘ওহাবী’ বলে চিহ্নিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তবে ভারতের সর্বপ্রথম সংবিধিবদ্ধ ও সুপ্রসিদ্ধ ‘ওহাবী’ নেতা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীযের (১৩৪৬-১৮২৩ খৃ) অন্যতম ছাত্র সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (১৭৮৬-১৮৩১ খৃ)। তিনি সমগ্র ভারতে মাযার, দরগা, ব্যক্তি পূজা, মৃত মানুষদের নামে মানত, শিন্নি ইত্যাদি বিভিন্ন শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। এছাড়া তিনি বৃটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৮২১ খৃস্টাব্দে তিনি হজ্জে গমন করেন। প্রায় তিন বৎসর তথায় অবস্থানের পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৮২৬ খৃস্টাব্দে তিনি বৃটিশ ভারত থেকে ‘হিজরত’ করে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গমন করে সেখানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং নিজে সেই রাষ্ট্রের প্রধান হন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম সেখানে একত্রিত হয়ে বৃটিশ ও শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। কয়েকটি যুদ্ধের পরে ১৮৩১ খৃস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে তাঁর বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিনি শাহাদত বরণ করেন। পরবর্তী প্রায় ৩০ বৎসর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অনুসারীগণ বৃটিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার বিচ্ছিন্ন জিহাদ ও প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ১৮০৩-৪ সালে ‘‘ওহাবী’’-গণ মক্কা-মদীনা দখল করে এবং তথাকার প্রচাীন মাজার-কেন্দ্রিক সৌধগুলি ভেঙ্গে ফেলে। এতে সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর অনুসারীগণ ‘‘ওহাবী’’-দের মতই একইভাবে শিরক, কুফর, বিদ‘আত, কুসংস্কার ইত্যাদির প্রতিবাদ করতেন। এভাবে তাদের মতামতের সাথে ‘‘ওহাবী’’-দের মতামতের বাহ্যিক সাদৃশ্য ছিল। ১৮২৩ খৃস্টাব্দে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় গমন করেন। ইংরেজ শাসকগণ সুকৌশলে প্রচার করে যে, ‘স্বাধীনতার নামে যারা আপনাদের ধর্মের বাণী শোনাচ্ছে আসলে তারা ইসলামের শত্রু এবং নবী ও সাহাবাদের অপমানকারী দল, এদের নাম ওহাবী, এরাই আপনাদের প্রিয় রাসুলের (সাঃ) বংশধরদের কবরগুলি ধ্বংস করে দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে ... আর সৈয়দ আহমদ তাদেরই এজেন্ট নিযুক্ত হয়েছে এবং এরা সবাই ওহাবী তাই এরাও আপনাদের শ্রদ্ধেয় পীরবুজুর্গ ও পুর্বপুরুষদের কবর ভাঙ্গতে চায়...। এভাবে বৃটিশ সরকার বুঝান যে, প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ক্ষোভ নেই। প্রকৃত ইসলাম ও মুসলিমদেরকে তাঁরা খুবই ভালবাসেন। শুধু বিভ্রান্ত ওহাবী সম্প্রদায়ের মানুষদেরকেই তারা দমন করছেন ও শাস্তি দিচ্ছেন। কাজেই এতে সাধারণ ভাল মুসলিমরেদ বিরক্ত হওয়ার বা কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর শিষ্যদের থেকে ভারতে বিভিন্ন সংস্কারমুখী ধারার জন্ম নেয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্য থেকে অনেকে নির্ধারিত মাযহাব অনুসরণ অস্বীকার করে নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ বলে দাবি করেন। তাঁর শিষ্য জৌনপূরের পীর মাওলানা কারামত আলী একটি সংস্কারমুখী ধারার জন্ম দেন। ফুরফুরার পীর মাওলানা আবূ বাক্র সিদ্দীকীও সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর মতানুসারী ও তাঁর প্র-শিষ্য ছিলেন। দেওবন্দী আলিমগণও তাঁরই শিষ্যদের থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। এদেরর সকলকেই প্রতিপক্ষগণ ও ঔপনিবেশিক সরকার ‘ওহাবী’, ‘‘রঙিন ওহাবী’’ বা ‘‘বর্ণচোরা ওহাবী’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অন্যতম শিষ্য ও সমসাময়িক সংস্কারক মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমির (১৭৮২-১৮৩১) এবং সমকালীন অন্য সংস্কারক হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)। এদেরকেও ওহাবী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এদের আন্দোলন ও প্রতিরোধকে ওহাবী আন্দোলন বলা হয়েছে। ‘‘ওহাবী’’ শব্দের ব্যবহার বুঝতে একটি উদাহরণ পেশ করছি। মীর নিসার আলী ওরফে তীতু মীর ১৭৮২ খৃস্টাব্দে বাংলার ২৪ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮২৩ সালে হজ্জের সময় মক্কায় সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। তিনি তাঁর মুরীদ হন। দেশে ফিরে তিনি তাঁর এলাকার মানুষদের মধ্যে বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা প্রচার করেন। তিনি বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বললেও কখনোই হিন্দু ধর্ম, ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে কিছুই বলেন নি। কিন্তু তাঁর শিক্ষায় সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ধর্মপালন বৃদ্ধি পাওয়াতে এলাকার হিন্দু জমিদারগণ ক্ষুদ্ধ হন। তাঁরা সাধারণ মুসলিম প্রজাদেরকে জানান যে, প্রকৃত ইসলামকে তাঁরা খুবই ভালবাসেন। তবে ওহাবী মতবাদকে তারা দমন করতে চান। যুগযুগ ধরে মুসলিমগণ হিন্দুদের মতই নাম রেখেছেন, দাড়ি কেটেছেন, গোঁফ রেখেছেন, মসজিদ বানানোর জন্য ব্যস্ত হন নি এবং গোহত্যা করেন নি। তীতুমীর ওহাবী মতানুসারে দাড়ি রাখতে, গোঁফ কাটতে, মুসলমানী নাম রাখতে, মুসলমানদের গ্রামে মসজিদ বানাতে ও কুরবানীর নামে গোহাত্যা করতে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। এজন্য ওহাবী মতবাদ দমন করা অতীব জরুরী। এদের দমনের কারণে ‘‘ভাল’’ মুসলমানদের বিক্ষুদ্ধ হওয়ার বা কষ্ট পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। এজন্য তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ন বাবু, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, নগরপুরের জমিদার গৌড়প্রসাদ চৌধুরী ও অন্যান্য প্রখ্যাত জমিদার সমবেতভাবে ৫টি বিষয়ে নোটিশ জারি করেন: ‘‘(১) যাহারা তীতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া ওহাবী হইবে, দাড়ি রাখিবে, গোঁফ ছাটিবে, তাদের প্রত্যেককে ফি দাড়ির উপর আড়াই টাকা এবং ফি গোঁফের উপর পাঁচ সিকা খাজনা দিতে হইবে। (২) মসজিদ প্রস্ত্তত করিলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক সহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হইবে। (৩) পিতা-পিতামহ বা আত্মীয়- স্বজন সন্তানের যে নাম রাখিবে সে নাম পরিবর্তন করিয়া ওহাবী মতে আরবী নাম রাখিলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হইবে। (৪) গোহত্যা করিলে হত্যাকারীর দক্ষিণ হস্ত কাটিয়া নেওয়া হইবে, যেন সে ব্যক্তি আর গোহত্যা করিতো না পারে। (৫) যে ব্যক্তি ওহাবী তীতুমীরকে নিজ বাড়ীতে স্থান দিবে তাহাকে তাহার ভিটা হইতে উচ্ছেদ করা হইবে।’' বস্ত্তত, তুর্কী খিলাফাত ও বৃটিশ সরকারের ব্যাপক প্রচারের কারণে ‘‘প্রকৃত ইসলাম’’ ও ‘‘ওহাবী ইসলামের’’ এ বিভাজন পাশ্চাত্য গবেষকদের কাছে সার্বজনীনতার রূপ পেয়েছে। বিশ্বের যে কোনো স্থানে সংস্কার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, উপনিবেশ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বা পাশ্চাত্য বিরোধী আন্দোলনে ধার্মিক মুসলিম, আলিম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা পীর-মাশাইখের সম্পৃক্ততা থাকলেই তাকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। ওহাবী ইসলাম ও প্রকৃত ইসলামের এ বিভাজনের ক্ষেত্রে অনেক পাশ্চাত্য গবেষক প্রকৃত ইসলামকে ‘‘সূফী ইসলাম’’ বলে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে, সূফী ইসলাম অসাম্প্রদায়িক, অরাজনৈতিক ও উদার। প্রমাণ হিসেবে তারা বলেন যে, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার মুসলিম ও অমুসলিম সমাজের অগণিত সূফী দরবারে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষ একত্রিত হচ্ছেন, যিক্র, ওযীফা, সামা-কাওয়ালী ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন এবং তবারুক ও দুআ গ্রহণ করছেন। এ সকল দরবারে আত্মশুদ্ধি ও আধ্ম্যাত্যিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি আলোচনা করা হয় না। আমাদের দেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা সূফী ইসলামের দুটি পর্যায় দেখতে পাই। আমরা দেখি যে, অনেক মুসলিম তাসাউফ ও সূফীবাদের নামে পীর-মাশাইখকে আল্লাহর অবতার বা বিশেষ ‘‘ঐশ্বরিক’’ সম্পর্ক বা ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করেন, তাদেরকে সাজদা করেন, তাদের কবর-মাযার বা সমাধি সাজদা করেন, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি শরীয়তের আহকাম পালনকে গুরুত্বহীন মনে করেন এবং গান-বাজনা ও নৃত্যগীতিকে সূফী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে গণ্য করেন। এরা নিজেদেরকে প্রকৃত সূফী ও প্রকৃত সুন্নী বলে দাবি করেন। যারা পীর সাজদা, করব সাজদা, গানবাজনা, ধুমপান ইত্যাদির প্রতি আপত্তি প্রকাশ করেন বা শরীয়ত পালনের বাধ্যবাধকতার কথা বলেন তাদেরকে এ পর্যায়ের সূফীগণ ‘‘ওহাবী’’ এবং ‘‘ওলীগণের দুশমন’’ বলে কঠোরভাবে নিন্দা করেন। অনেকে তামাক, গাজা ইত্যাদি সেবন বা ধুমপানকে সুন্নী ইসলাম ও সূফী ইসলামের মৌলিক পরিচয় বলে গণ্য করেন এবং ধুমপান বিরোধীদেরকে ওহাবী ও ওলীগণের দুশমন বলে নিন্দা করেন। অন্য অনেক মুসলিম পীর-সাজদা, করব-সাজদা, গান-বাজনা ইত্যাদি কর্মকে কঠিনভাবে নিন্দা করেন, শরীয়ত প্রতিপালনকে সূফী ইসলামের মূল বিষয় বলে গণ্য করেন এবং শরীয়ত প্রতিপালনের পাশাপাশি পীর-মাশাইখের নিকট তরীকত শিক্ষা করেন ও পালন করেন। প্রথম পর্যায়ের সুফী ও মারফতীগণের মতানুসারে এরা ওহাবী ও সূফী ইসলামের দুশমন। তবে এরা নিজেদেরকে প্রকৃত সূফী ও সুন্নী বলে দাবি করেন এবং প্রথম পর্যায়ের মানুষদেরকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন। এ পর্যায়ের তাসাউফ-পন্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ওরস, ঈসালে সাওয়াব, মীলাদুন্নবী, সীরাতুন্নবী, যিকরের পদ্ধতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এ পর্যায়ের সূফীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ সকল মতভেদের ভিত্তিতে এ পর্যায়ের সূফীগণের একদল আরেকদলকে ওহাবী, নবীর দুশমন বা ওলীগণের দুশমন বলে নিন্দা করেন এবং নিজেদেরকে প্রকৃত সুন্নী ও প্রকৃত সূফী বলে দাবি করেন, যদিও সকলেই পীর-মুরিদী ও তাসাউফে বিশ্বাস করেন ও বিভিন্ন তরীকা অনুসরণ করেন। পাশ্চাত্যের খৃস্টানগণ প্রকৃতিগতভাবেই প্রথম পর্যায়ের সূফী ইসলাম ও এর অনুসারীদের ভালবাসেন। কারণ তাদের ‘‘মানসিকতার’’ সাথে এদের ‘‘মানসিকতার’’ খুবই মিল। ইউরোপ-আমেরিকা ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশে এরূপ সূফীদের মাজলিস- দরবার ও খানকা-মাজারে তারা আগমন করেন, গান-বাজনা ও আধ্ম্যাতিক চর্চায় অংশ নেন। এ সকল সূফীও এদেরকে অত্যন্ত ভালবেসে গ্রহণ করেন। স্বভাবতই পাশ্চাত্যের মানুষেরা বিশ্বের সকল মুসলিম দেশে এরূপ সূফী ইসলামের প্রসার কামনা করেন। এরূপ সূফী ইসলামের প্রসারই সকল ধর্মের ও ধর্মহীন মানুষদের মধ্যে অনাবিল শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে বলে তারা বিশ্বাস করেন। ‘‘সভ্যতার সংঘাতের’’ নামে ইসলামী দেশগুলিতে আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রথমে ঢালাওভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কিন্তু তারা দেখেন যে, এতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ছে। তখন তারা মুসলমানদেরকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে কাউকে পক্ষে ও কাউকে বিপক্ষে নিতে চান। এজন্য প্রথমে তারা লিবারেল (liberal) বা উদার ও (fundamentalist) অর্থাৎ মৌলবাদী বা কট্টরপন্থী বলে ভাগাভাগি করেন। এরূপ ভাগাভাগি মুসলিম দেশগুলিতে তেমন কোনো বাজার লাভ করে না। এজন্য বিগত কয়েক বছর যাবত তারা নতুন একটি ভাগাভাগি বাজারজাত করতে চেষ্টা করছেন, তা হলো সূফী ইসলাম ও ওহাবী ইসলাম। মুসলিম দেশগুলিতে সূফীগণের প্রভাব ও ‘‘ওহাবী’’ শব্দটির প্রতি মুসলিমদের ঘৃণার বিষয়টি তারা জানেন। বৃটিশ সরকার ও হিন্দু জমিদারগণ যেভাবে সাইয়েদ আহমদ, তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ ও অন্যান্য সকল ধর্মীয় সংস্কার ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিত্রিত করে সাধারণ মুসলিমদের কাছে ঘৃণিত করার চেষ্ঠায় অনেকটা সফলতা লাভ করেছিলেন, তেমনি তারা তাদের স্বার্থের সাথে সাংঘষিক সকল ইসলামী কর্মকান্ড ও ব্যক্তিত্বকে ‘‘ওহাবী’’ রূপে চিত্রিত করতে চেষ্টা করছেন। অন্তত সুন্নীওহাবী বা সূফী-ওহাবী বিতর্ক ও সঙ্ঘাত উস্কে দিতে পারলে ইসলামী দাওয়াত, শিক্ষা বিস্তার, অশ্লীলতা-মাদকতার প্রতিবাদ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আলিম বা ইসলামপন্থীদের উত্থান নিশ্চিতরূপেই ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হবে।তারা মূলত সূফী ইসলাম বলতে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বুঝছেন। কারণ, দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীদের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রমুখের মত ব্যক্তিত্বর আবির্ভাব ঘটতে পারে, যাদের ক্ষমতায়ন তাদের স্বার্থ রক্ষা করে না। তারা বিশ্বাস করেন যে, প্রথম পর্যায়ের সূফীদের উত্থানই মুসলিম মানসিকতা থেকে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করতে সক্ষম এবং এ পর্যায়ের সূফী ইসলামই বিশ্বের মানুষদেরকে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে রক্ষা করে সকল ধর্মের শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, এদের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের প্রধান দুটি ধর্ম: খৃস্টধর্ম ও ইসলামকে একেবারেই কাছাকাছি করে দিতে পারে। বস্ত্তত প্রথম পর্যায়ের সূফীগণ এবং পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীগণকে ‘‘প্রকৃত ওহাবী’’ বা ‘‘বর্ণচোরা ওহাবী’’ বলে বিশ্বাস করেন। এদের হাতে তাদের স্বার্থ নিরাপদ নয় বলেও তারা জানেন। তবে মুসলিম দেশগুলিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের সূফীগণের প্রভাব সম্পর্কেও তারা সচেতন। এজন্য তার ‘‘সূফী ইসলামের’’ নামে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের নেতৃত্বাধীনে ও তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থেকে উভয় পর্যায়ের সূফীগণকে একত্রিত করে তাদেরকে ‘‘ওহাবী’’-দের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। তারা বুঝাচ্ছেন যে, যারা ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র, বিচার, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন তারা মূলত ওলীগণের মাজারভাঙ্গা সৌদী ওহাবীগণের দালাল ও তাদের মতের অনুসারী। এরা ক্ষমতা লাভ করলে এরাও পীর-মাশাইখ ও কবর-মাজার ধ্বংস করবে। কাজেই এদেরকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। একথা নিশ্চিত যে, সাধারণ মুসলিম, আলিম ও পীর-মাশাইখ তাদের এরূপ প্রচারণায় প্রভাবিত হবেন। এছাড়া এ অযুহাতে ওহাবী-সুন্নী বির্তর্ক ও হানাহানির প্রসার ঘটিয়ে মুসলিমদেরকে সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রচারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন। বস্ত্তত ‘‘ইসলাম’’ নামের যেমন ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়েছে এবং ইসলামের নামে ইসলাম বিরোধী কর্ম করা হয়েছে ও হচ্ছে, তেমনি ‘‘সূফী’’ শব্দেরও ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়েছে। তাসাউফ, সূফী, পীর, দরবেশ ও ওলীগণের নামে অনৈসলামিক কর্মকান্ডও ঘটেছে অনেক। তবে সর্বজন স্বীকৃত সূফী-দরবেশগণের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, তাঁরা সকলেই সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। প্রায় সকল সূফী ‘‘তরীকা’’-র মূল সূত্র হিসেবে আবূ বাকর সিদ্দীক (রা) ও আলী (রা)-কে উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত অমান্যকারী, ধর্মত্যাগী, ধর্মীয় অনাচারে লিপ্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁরা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর পথিকৃতি। হাসান বসরী, ইবরাহীম আদহাম, জুনাইদ বাগদাদী, আব্দুল কাদির জীলানী, আবূ হামিদ গাযালী, মুজাদ্দিদ-ই আলফিসানী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, এমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কী, কারামত আলী জৌনপুরী, আবূ বকর সিদ্দীকী ফুরফুরাবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও অন্যান্য সকল সুপ্রসিদ্ধ সূফী-সাধক আত্মশুদ্ধি ও আধ্ম্যাত্মিকতার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন, শাসকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, কারাবরণ করেছেন বা শাহাদাত লাভ করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে এদের কর্মপদ্ধতির পার্থক্য হলো ক্ষমতায় না যেয়ে ক্ষমতাসীনদের সংশোধনের চেষ্টা করা। এরা নিজেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেন নি বরং ক্ষমতাসীনদেরকে নসীহত করেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, ন্যায়ের পক্ষে উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, জনগণকে সচেতন করেছেন, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধে শরীক হয়েছেন এবং এ সকল কর্মকান্ডে যে সকল ব্যক্তি বা দলকে অপেক্ষাকৃত ভাল বলে মনে করেছেন তাদেরকে সমর্থন করেছেন বা উৎসাহ দিয়েছেন।

তথাকথিত ‘‘জঙ্গি’’ কর্মকান্ড বা উগ্রতার সাথে তাদের কর্মপদ্ধতির পার্থক্য হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কিন্তু শাস্তি বা বলপ্রয়োগের চেষ্টা না করা। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, নসীহত করেছেন, ক্ষমতাসীন ও অন্যান্য সকলকে অন্যান্য দমন করতে, প্রতিবাদ করতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কিন্তু নিজে অন্যায় দমনের নামে শক্তি প্রয়োগ করেন নি, আইন অমান্য করেন নি, আইন নিজের হাতে তুলে নেন নি এবং আইন অমান্য করার ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রকৃত সূফীগণ কখনোই সমাজ-বিমুখ বা রাজনীতি-বিমুখ ছিলেন না। ‘‘সূফী ইসলাম’’-কে সমাজ, রাষ্ট্র ও জগৎ-বিমুখ বলে চিহ্নিত করা ও সকল সংস্কার আন্দোলনকে ‘‘ওহাবী’’ বলে চিত্রিত করার কোনো ভিত্তি নেই। তথাকথিত ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ বা জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে উসামা বিন লাদেনের মত সৌদি বংশোদ্ভুত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন বলে শোনা যায়। সৌদি আরবের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এদের অর্থায়ন করেন বলে দাবি করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত উপমহাদেশে আহলে হাদীস ও দেওবন্দী-পদ্ধতির কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত দু-চার ব্যক্তির এর সাথে সংশি­ষ্টতার কথা শোনা যায়। এছাড়া এদের মধ্যে কবর-মাযার ইত্যাদির বিরোধিতা দেখা যায়। সর্বোপরি এরা নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য মৌখিক প্রচার ছাড়াও অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। এজন্য অনেক গবেষক মনে করেন যে, ওহাবী মতবাদের প্রসারই বর্তমান জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ। তবে লক্ষণীয় যে, উসামা বিন লাদেন-এর আন্দোলনের গোড়া পত্তন হয় সৌদি-ওহাবী রাষ্ট্রের বিরোধিতার মাধ্যমে। তার অনুসারীরা তথাকার রাজতন্ত্র, মার্কিন সৈন্য, অনাচার ইত্যাদির বিরোধিতা করেন এবং সৌদি রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের বংশধরসহ সকল সৌদি আলিম বিন লাদেনের আন্দোলন ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার। সর্বোপরি, বিভিন্ন দেশের সংস্কার বা প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত করার কোনো ভিত্তি নেই। বস্ত্তত মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব ও তাঁর আদর্শ প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করেছে তুর্কি খিলাফতের প্রচার ও বৃটিশ সরকারের সুযোগসন্ধানের কারণে। ওহাবী মতবাদ ও আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একান্তই একটি আঞ্চলিক বিষয় ছিল। অন্যান্য মুসলিম দেশের সংস্কার-প্রতিরোধ ও ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মতই ভালমন্দ মেশানো একটি বিষয়। অন্যান্য দেশে মুসলিমগণ তাদের পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুসারে অনুরূপ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। যেহেতু ওহাবীগণ ও অন্যান্য দেশের মুসলিমগণ সকলেই একই সূত্র, অর্থাৎ কুরআন, হাদীস, ইসলামী ফিক্হ ও ইসলামের ইতিহাস থেকে নিজেদের মতামত সংগ্রহ করেছেন, সেহেতু তাদের মতামত ও কর্মের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। এ জন্য সকল কৃতিত্ব মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবকে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আফগানিস্থান ও ইরাকে বিন লাদেনের মতবাদ প্রসার লাভ করেছে। আর এ দুটি দেশই ঘোর ওহাবী বিরোধী। আফগানিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী হানাফী মাযহাবের কঠোর অনুসারী, পীর মাশাইখদের ভক্ত এবং ওহাবীদের বিরোধী। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ শাসনামলে ওহাবী বা অন্য যে কোনো সংস্কারমুখী আলিম ও মতবাদকে কঠোরভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শুধুমাত্র সূফীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোরতা অবলম্বন করা হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দুই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার থেকে বুঝা যায় যে, জঙ্গিবাদের কারণ অন্য কোথাও নিহিত রয়েছে।

আমরা আগেই দেখেছি যে, সন্ত্রাসীদের জাতি, ধর্ম গোত্র ইত্যাদিকে ঢালাওভাবে ‘সন্ত্রাসের’ কারণ বা চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সঠিক নয়। এতে সন্ত্রাস দমনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, কোনো, জাতি, ধর্ম বা গোত্রের সকল মানুষকে তো আর ঢালাওভাবে বিচার করা যায় না। জঙ্গিবাদের দায়িত্ব ‘ওহাবী মতবাদের’ উপর চাপানোর বড় বিপত্তি হলো, এতে সমস্যা সমাধানের পথ হারিয়ে যাবে। কেননা, সৌদি ওহাবীদের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন, কারণ জঙ্গিবাদ তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত। আর অন্য কোনো দেশের কেউ নিজেকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না, কিন্তু প্রায় সকল ধর্মীয় দলই বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত। প্রত্যেকেই দাবি করেন যে, তাঁরা সরাসরি কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও পূর্ববর্তী ইমামগণের মতের ভিত্তিতে তাদের মত ও দল গঠন করেছেন; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিজস্ব কোনো মত তারা মানেন না। এমনকি সৌদি আরবের আলিমগণ কখনোই নিজেদেরকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবকে একজন সংস্কারক হিসেবে মনে করেন এবং তাঁর সকল মতামতই কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্ববর্তী ইমামগণের থেকে গৃহীত বলে দাবি ও প্রমাণ করেন।[২৩]

দেশ অনুযায়ী সম্পর্ক সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Akbar Ahmed Journey Into America: The Challenge of Islam, 2010, page 261 "The relationship between Salafis and Sufis, in particular, is complicated and reflects some of the changes and current conflicts in the Muslim world."
  2. Dr Abdul Haqq Baker, Extremists in Our Midst: Confronting Terror, Palgrave Macmillan, 2011
  3. An Introduction the Modern Middle East: History, Religion, Political Economy ... ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে By David S. Sorenson
  4. Salafi Ritual Purity: In the Presence of God By Richard Gauvain, p.305
  5. Princeton Readings in Islamist Thought: Texts and Contexts from Al-Banna to ... By Roxanne Leslie Euben, Muhammad Qasim Zaman
  6. Encyclopedia of Islam By Juan Eduardo Campo, p.601 ("Salafists have ... promote[d] their message that Islam, as well as Muslim society, is in crisis, having been corrupted from within by backward-thinking Ulama, Sufism, a spurious innovations.")
  7. Werbner, Pnina (২০০৬)। "Learning the lessons from the neorevivalist and Wahhabi movements"। Jamal Malik, John Hinnells। Sufism in the West। Routledge। Even back in 1971, [J. Spencer] Trimingham argued that the Sufi tariqas were in decline and danger of disappearing altogether under the dual threat of modernization and the Wahhabi/Salafi critique heavily supported by propaganda materials funded by the superior wealth of the Saudi regime. ... However, this has not materialized: during the decades of the 1980s and the 1990s, tariqas have revived themselves as they have begun to fight back against the Wahhabi/Salafi critique, and the twenty-first century dawn with battle lines drawn up between these two conflicting groups within the world of Sunni Islam. 
  8. as of 2007
  9. Knysh, Alexander (২০০৭)। Contextualising the Salafi-Sufi ConflictMiddle Eastern Studies43। পৃষ্ঠা 503–30 at p.507। আইএসবিএন 9781136446931The rift between the Salafis/Wahhabis and the Sufis is not unique to the Caucasus. It is found in practically every Muslim country today (as well as the Muslim diasporic communities of the West), 
  10. al-Makki, Abd al-Hafiz (জানুয়ারি ২০১১)। "Shaykh Muhammad bin 'Abd al-Wahhab and Sufism"। Deoband.org। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৭I studied each volume page by page and never came across any place in which Shaykh Muhammad bin ‘Abd al-Wahhab criticizes, refutes or rejects Tasawwuf or any one of the Sufi shaykhs on account of his Tasawwuf. 
  11. ইবন তাইময়ামাজমুআ ফাতাওয়াখন্ডঃ ৫, পাতা ৪৯১
  12. Kepel, Gilles, Jihad: The Trail of Political Islam Belknap Press of Harvard University Press (31 March 2003)|2002|pp=69–75
  13. How Saudi petrodollars fuel rise of Salafism| france24.com 30 September 2012
  14. documentary The Qur'an aired in the UK, The Qur'an review in The Independent
  15. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; violence নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  16. Keller, Nuh Ha Mim (১৯৯৫)। The Concept of Bid'a in the Islamic Shari'a। Muslim Academy Trust]। পৃষ্ঠা 1–2। আইএসবিএন 978-1-902350-02-8 
  17. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Mir নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  18. Salafi intolerance threatens Sufis
  19. "What Is the Difference Between Sunni, Shiite and Sufi Muslims?"। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ মে ২০১৯ 
  20. "Intercession - Tawassul"। sunnah.org। ২৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১৩ 
  21. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; indianmuslims.in নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  22. Campo, Juan Eduardo (২০০৯)। Encyclopedia of Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 457। আইএসবিএন 978-1-4381-2696-8। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ 
  23. http://www.hadithbd.com/books/link/?id=6889

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা