সরাসরি সম্প্রচার
সরাসরি সম্প্রচার বলতে আন্তর্জালে (ইন্টারনেটে) বাস্তব বিশ্বের কোনও ঘটনার শ্রাব্য (অডিও) ও চলমান দৃশ্য-সম্বলিত (ভিডিও) বিষয়বস্তুর এমনভাবে সম্প্রচার করার প্রক্রিয়াটিকে বোঝায়, যে প্রক্রিয়াতে ঐ বিষয়বস্তুটি যে সময়ে কোনও যোগাযোগ যন্ত্রে ধারণ করা হয়, ঠিক সেই সময়েই যন্ত্রটি থেকে সেটিকে তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি আন্তর্জালের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।[১][২] সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য আন্তর্জালের সাথে সার্বক্ষণিক সংযুক্ত একটি যোগাযোগ যন্ত্র যেমন বুদ্ধিমান মুঠোফোন (স্মার্টফোন) বা ট্যাবলেট থাকতে হয় ও আন্তর্জালে অবস্থিত একটি সম্প্রচার মঞ্চের (প্ল্যাটফর্ম) গ্রাহক হতে হয়। সম্প্রচারকারী তার যোগাযোগ যন্ত্রের অবস্থিত ঐ সম্প্রচারমঞ্চের একটি গ্রাহক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে মঞ্চটিতে ধারাবাহিকভাবে শ্রাব্য ও চলমান দৃশ্য-সম্বলিত বিষয়বস্তুগুলি প্রেরণ করতে থাকেন এবং ঐ সম্প্রচার মঞ্চটিতে অবস্থিত একটি সম্প্রচার কেন্দ্র (চ্যানেল) থেকে সেই বিষয়বস্তুটি সম্প্রচার হতে থাকে। এ অবস্থায় আন্তর্জালের অন্যান্য ব্যবহারকারীরা ঐ সম্প্রচারমঞ্চে গিয়ে বিষয়বস্তুটি তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে ও শুনতে পারেন। এই ঘটনাটিকে ইংরেজিতে "লাইভস্ট্রিমিং" (Livestreaming) বলে।
আন্তর্জালে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা (বিশেষত কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা) আর অন্য স্রষ্টাদের সৃষ্ট বিষয়বস্তুর নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করে না, বরং তারা তাদের নিজস্ব সৃষ্ট বিষয়বস্তু নিজেই উপস্থাপন করার সুযোগ পায়। যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে সম্প্রচার করা হয়, তাই সেখানে সম্পাদনার কোনও সুযোগ থাকে না, ফলে বিষয়বস্তুটি অনেক বেশি "আসল" বলে মনে হয়। বেশিরভাগ মঞ্চেই সাধারণত বিষয়বস্তু সম্প্রচারের সময় শ্রোতা-দর্শকদের সরাসরি তাৎক্ষণিক আবেগিক প্রতিক্রিয়া (আবেগী অণুচিত্র তথা ইমোজি কিংবা আবেগী পাঠ্য তথা ইমোটের মাধ্যমে) ও সাধারণ পাঠ্য মন্তব্য প্রকাশের সুযোগ থাকে। সরাসরি সম্প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বার্তাভিত্তিক আলাপকক্ষের (চ্যাটরুম) মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনের সুযোগ প্রদান। এছাড়া প্রায়শই সম্প্রচারমঞ্চগুলিতে দর্শক ও সম্প্রচারকারী ব্যক্তির মধ্যে বার্তাভিত্তিক আলাপ (চ্যাট) করার সুযোগ থাকে।
প্রথমের ইউনাও, লাইভমি ও পেরিস্কোপের মত সম্প্রচারমঞ্চগুলি এই সেবাটি প্রদান করত। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মঞ্চগুলি যেমন ইউটিউব, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামও এই সেবা সরবরাহ করছে। সরাসরি সম্প্রচার সেবাগুলি বহু বিভিন্ন ধরনের বিষয়ে করা হতে পারে, যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ভিডিও খেলা ও পেশাদার ক্রীড়াও অন্তর্ভুক্ত। ফেসবুক লাইভ, পেরিস্কোপ, কুয়াইশৌ, টিকটক (চীনে তৌইন নামে পরিচিত), ভারতের বিলিবিলি, ১৭ (সেভেন্টিন), ইত্যাদি অ্যাপ্লিকেশন মঞ্চগুলিতে পূর্বনির্ধারিত প্রচারণামূলক ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে করা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে সরাসরি সম্প্রচারের (যেমন ভিডিও-দূরালাপন) সুবিধা থাকে। টুইচ জাতীয় ওয়েবসাইটগুলি ভিডিও খেলায় অংশগ্রহণকারী মানুষদের দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে।
সরাসরি সম্প্রচারের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলির মধ্যে একটি হল এগুলির বিষয়বস্তু সংযত বা দমন করা সম্ভব নয়, ফলে এগুলিতে যখন কোনও ক্ষতিকর বা অপব্যবহারমূলক আচরণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, তখন ঐসব আপত্তিকর বা অশোভব বিষয়বস্তু থেকে দর্শকদের (বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের) রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সম্প্রচারকারী বাস্তব জীবনে মানুষের মুখোমুখি হয়ে যেসব কাজ করার সাহস পেত না, ক্যামেরার পেছনে থেকে সে নিরাপদে সেগুলি করতে পারে। এছাড়া যেহেতু সরাসরি সম্প্রচার অনেক সময় তাৎক্ষণিক আবেগের তাড়নায় ঘটতে পারে, যাতে ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়বস্তু সম্প্রচার করে দেয়ার জন্য পরবর্তীকালে সম্প্রচারকারী অনুশোচনায় ভুগতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে বারংবার দর্শকদের নেতিবাচক মন্তব্য পড়ে সম্প্রচারকারীর আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে।
করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এর (কোভিড-১৯) বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ২০২০ সাল থেকে আন্তর্জালে সরাসরি সম্প্রচারের ঘটনাটির ব্যাপক প্রসার ঘটে। অন্তরণ, সঙ্গনিরোধ, অবরুদ্ধকরণ বা সান্ধ্য আইনের কারণে বহু মানুষ বিদ্যালয় বা কার্যালয়ে যেতে না পেরে দীর্ঘ সময় নিজগৃহে অবস্থান করতে বাধ্য হয়, ফলে তাদের মধ্যে এই সেবাটি ব্যবহার করার প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
মার্কা সচেতনতা ও ভাবমূর্তি
সম্পাদনাশিল্পী ও অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা বেশ কিছু কারণে আন্তর্জালে সরাসরি সম্প্রচার পছন্দ করে থাকেন। বাস্তব বিশ্বের একটি অনুষ্ঠানে যেখানে একটি মিলনায়তনে কয়েক শত দর্শকের সমাগম হয়, সেখানে আন্তর্জালে সম্প্রচার করলে আরও বেশি দর্শকের কাছে অনুষ্ঠানের খবর সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে, ফলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ শ্রোতা-দর্শকের কাছে অনুষ্ঠান আয়োজক ও শিল্পীদের সম্পর্কে সচেতনতা (মার্কা সচেতনতা) ও আকর্ষণীয়তা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা কিনা অনেক আগ্রহী ব্যক্তির কাছে ঐ অনুষ্ঠান সম্পর্কে পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমে বা আন্তর্জালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অপেক্ষা বেশি পছন্দনীয়। এছাড়া এটি একটি নতুন প্রযুক্তি বলে এগুলি নতুন প্রজন্মের কাছে আয়োজক ও শিল্পীদেরকে আধুনিকমনস্ক ও প্রযুক্তি-সচেতন হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে ও তাদের ভাবমূর্তি সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধি করতে পারে।
৫ম প্রজন্মের যোগাযোগ প্রযুক্তি
সম্পাদনা২০২০-এর দশকে এসে ৫ম প্রজন্মের ভ্রাম্যমাণ দূরালাপন প্রযুক্তির (5G Mobile telephony) প্রসারের ফলে সরাসরি সম্প্রচার প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হয়ে উঠবে। এই প্রজন্মের যন্ত্রগুলিতে তথ্য ১ মিলিসেকেন্ড বা তার কম সময়ে স্থানান্তরিত হবে, ফলে সরাসরি সম্প্রচার আরও দ্রুত, চোখের নিমিষে দর্শকের কাছে পৌঁছে যাবে। দর্শক নিজেও ভ্রাম্যমাণ অবস্থাতেই ঘরের ভেতরে বা বাইরে যেকোনও অবস্থানে নির্ভরযোগ্য গুণমানে সরাসরি সম্প্রচার উপভোগ করতে পারবে। ৫ম প্রজন্মের যোগাযোগ যন্ত্র ও অবকাঠামোগুলির উন্নততর তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা ও উচ্চগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে যেকোনও সাধারণ ব্যক্তি সহজেই ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলির মতো কোনও ব্যয়বহুল অবকাঠামোতে (যেমন ট্রাক, ক্যামেরা, বিশেষায়িত সম্প্রচার কেন্দ্র) বিনিয়োগ করা ছাড়াই যেকোনও স্থানে বহনযোগ্য মুঠোফোনের আলোকচিত্রগ্রাহকে ধারণকৃত বিষয়বস্তু খুব সহজেই সরাসরি আন্তর্জালে সম্প্রচার করতে পারবেন।
ই-বাণিজ্য
সম্পাদনাসরাসরি সম্প্রচারের একটি অন্যতম ক্ষেত্র হল সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে কেনাকাটা (ইংরেজিতে লাইভস্ট্রিম শপিং বা সংক্ষেপে লাইভ শপিং)। এটি মূলত একটি বিপণন কৌশল যাতে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা বিখ্যাত ব্যক্তি একটি সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিও আয়োজনের মাধ্যমে কোনও পণ্যের হয়ে প্রচারণা চালান। এসময় দর্শকেরা তথা সম্ভাব্য ক্রেতারা সরাসরি ঐ আয়োজক ব্যক্তিটিকে মন্তব্য বা প্রশ্ন পাঠাতে পারে এবং তিনি পণ্যটি বর্ণনা ও সেটির গুণাগুণ পর্যালোচনা করার সময়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারেন। এই ধরনের আয়োজনগুলি সাধারণত চীনে আলিবাবা-র থাওপাও মঞ্চ, ফেসবুক লাইভ, আমাজন লাইভ, ইত্যাদি সম্প্রচার মঞ্চগুলিতে ঘটে থাকে। এই ক্ষেত্রটি প্রথমে চীনে জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রায়শই এইসব বিপণন প্রচারণামূলক সরাসরি সম্প্রচারের সময় অংশগ্রহণকারী দর্শকদের জন্য সীমিত সময়ের জন্য বিশেষ ছাড় ও ভাগ্যের খেলাভিত্তিক বিনামূল্যে পণ্য বিতরণের মতো ব্যাপারগুলি আয়োজন করা হতে পারে।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Livestream"। Cambridge Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুন ২০২২।
- ↑ "Livestream"। Merriam-Webster.com Dictionary। Merriam-Webster। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুন ২০২২।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- উইকিমিডিয়া কমন্সে সরাসরি সম্প্রচার সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।