সরল স্পন্দন গতি
বলবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞানে, সরল স্পন্দন গতি বা সরল ছন্দিত গতি (ইংরেজি: Simple Harmonic Motion সংক্ষেপে SHM) একটি বিশেষ ধরনের পর্যায়বৃত্ত গতি যা (বস্তুর সাম্যাবস্থা থেকে দূরত্বের সমানুপাতিক ও সাম্যাবস্থানের দিকে ক্রিয়াশীল) প্রত্যয়নী বলের ফলে উদ্ভুত হয়। এতে বস্তুটিতে স্পন্দন গতির সৃষ্টি হয় যাকে ত্রিকোণমিতিক সাইন (অথবা কোসাইন) অনুপাতের লেখ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। সরল স্পন্দন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য চলতে থাকে যেহেতু ঘর্ষণ বা অন্য কোনো কারণে সিস্টেমের শক্তি ক্ষয় হয়।
বিভিন্ন প্রকার গতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সরল স্পন্দন গতির ক্রিয়াকৌশল প্রয়োগ করা হলেও হুকের সূত্রের ফলে স্প্রিং-এ উদ্ভুত রৈখিক স্থিতিস্থাপক প্রত্যয়নী বলের ফলে উদ্ভুত স্পন্দনকে আদর্শ সরল স্পন্দনের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। এ প্রকার গতি সময়ের সাপেক্ষে ত্রিকোণমিতিক সাইন আপেক্ষক অনুসরণ করে এবং একটিমাত্র অনুনাদিত কম্পাঙ্ক প্রদর্শন করে। অন্যান্য কিছু ঘটনাও সরল স্পন্দন গতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন সরল দোলকের গতি, যদিও তা সম্পূর্ণভাবে সরল স্পন্দন গতির গাণিতিক ক্রিয়াকৌশল অনুসরণ করে না; সরল স্পন্দন হতে হলে বস্তুতে কার্যকর বল সাম্যাবস্থা হতে সরণের সমানুপাতিক হতে হয়। (তথাপি দোলক ক্ষুদ্র কোণে স্পন্দিত হলে ক্ষুদ্র-কোণ অনুমানের সাহায্যে সরল স্পন্দন গতির গাণিতিক ক্রিয়াকৌশল সরল দোলকের গতিকে বেশ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। আণবিক স্পন্দনও সরল স্পন্দন গতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়।
ফুরিয়ার বিশ্লেষণ এর সাহায্যে জটিলতর পর্যায়বৃত্ত গতিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও সরল স্পন্দন গতি ভিত্তিগতভাবে সহায়ক।
পরিচিতি সম্পাদনা
একটি সরলরেখার ওপর গতিশীল বস্তুকণার গতি যদি এমন হয় যে, ঐ সরলরেখার ওপর অবস্থিত একটি স্থির বিন্দুর দিকে বস্তুটির উপর একটি ত্বরণ থাকে যার মান ঐ স্থির বিন্দু থেকে বস্তুকণাটির দূরত্বের সমানুপাতিক, তবে তাকে সরল স্পন্দন গতি বলে।[১]
চিত্রে একটি স্প্রিং-এর এক প্রান্তে একটি ভার যুক্ত করে তৈরি একটি সরল স্পন্দক দেখানো হয়েছে। স্প্রিংটির অপর প্রান্ত একটি দৃঢ় অবলম্বন, যেমন একটি দেয়ালে সংযুক্ত। যদি সিস্টেমটি এরূপ সাম্যাবস্থায় স্থির থাকে তবে স্পষ্টত এর ওপর কোনো কার্যকর বল নেই। তবে যদি ভরটিকে সাম্যাবস্থা থেকে সরানো হয়, তবে স্প্রিংটি ভরটির ওপর একটি স্থিতিস্থাপকতাজনিত প্রত্যয়নী বল প্রয়োগ করে, যা হুকের সূত্র মেনে চলে।
গাণিতিকভাবে, এই প্রত্যয়নী বল F,
যে কোনো সরল যান্ত্রিক স্পন্দনগতিসম্পন্ন বস্তুর ক্ষেত্রে:
- যখন সিস্টেমটিকে এর সাম্যাবস্থা থেকে সরানো হয়, হুকের সূত্র অনুসারে প্রযুক্ত একটি প্রত্যয়নী বল সিস্টেমটিকে সাম্যাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করানোর জন্য প্রযুক্ত হয়।
যখন ভরটিকে এর সাম্যাবস্থা থেকে সরানো হয়, এটিতে একটি কার্যকর প্রত্যয়নী বল ক্রিয়া করে। ফলশ্রুতিতে, এটি ত্বরণ লাভ করে এবং সাম্যাবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। যখন ভরটি সাম্যাবস্থানের নিকটবর্তী হয়, প্রত্যয়নী বলের মান হ্রাস পেতে থাকে। সাম্যাবস্থানে, কার্যকর প্রত্যয়নী বলের লুপ্তি ঘটে। তবে, x = 0, অবস্থানে, ঐ ভরটির একটি ভরবেগ থেকে যায় যেহেতু প্রত্যয়নী বলের ফলে এটি ত্বরণ, তথা বেগ, তথা গতি জড়তা লাভ করেছিল। তাই সাম্যাবস্থানে উপনীত হয়েও ভরটি সাম্যাবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়। এবার কার্যকর প্রত্যয়নী বল ভরটির বেগ হ্রাস করে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শূণ্য হয়, যেখান থেকে তা আবার সাম্যাবস্থার দিকে অগ্রসর হয়।
যতক্ষণ পর্যন্ত সিস্টেমটির শক্তি ক্ষয় না হবে, ততক্ষণ ভরটি স্পন্দিত হতে থাকবে। তাই সরল স্পন্দন এক প্রকার পর্যায়বৃত্ত গতি। যদি সিস্টেমটির শক্তি ক্ষয় হয়, তবে ভরটি দমিত স্পন্দন গতি প্রদর্শন করবে।
লক্ষণীয় যে, বাস্তব স্থান ও দশা স্থান একই রেখায় অবস্থিত না হলে, দশা স্থানে গতিটি উপবৃত্তাকার হয়। এর আবদ্ধ ক্ষেত্র বিস্তার ও সর্বোচ্চ ভরবেগের উপর নির্ভরশীল।
গতিবিদ্যা সম্পাদনা
নিউটনীয় বলবিদ্যায়, একমাত্রিক সরল স্পন্দন গতির ক্ষেত্রে, নিউটনের ২য় সূত্র এবং স্প্রিং-এ স্পন্দনশীল ভরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হুকের সূত্র - এই দুটির মাধ্যমে সরল স্পন্দন গতির সমীকরণ পাওয়া যায় যা একটি second-order সরলরৈখিক সাধারণ ব্যবকলনীয় সমীকরণ, যাতে ধ্রুব সহগ বিদ্যমান।
পার্স করতে ব্যর্থ (সম্ভব হলে ম্যাথএমএল (MathML) (পরীক্ষামূলক): "http://localhost:6011/bn.wikipedia.org/v1/" সার্ভার থেকে অবৈধ উত্তর ("Math extension cannot connect to Restbase."):): {\displaystyle F_\mathrm{net} = m\frac{\mathrm{d}^2 x}{\mathrm{d}t^2} = -kx,} যেখানে m হলো স্পন্দনরত বস্তুর জড়তাজনিত ভর, x হলো সাম্যাবস্থা থেকে সরণ অথবা অবস্থান, এবং k হলো স্প্রিং-এ স্পন্দনরত ভরটির জন্য একটি ধ্রুবক (স্প্রিং ধ্রুবক)। সুতরাং,
এই ব্যবকলনীয় সমীকরণটির সমাধান একটি ত্রিকোণমিতিক সাইন (অথবা কোসাইন) ফাংশন: যেখানে । ধ্রুবকদ্বয়ের অর্থ সহজেই বোঝা যায়: ওপরের সমীকরণে বসালে আমরা পাই , যেখানে হলো কণাটির আদি অবস্থান, ; সমীকরণটি ব্যবকলন করে তাতে শূণ্য বসালে আমরা পাই, , যেখানে হলো কণাটির প্রারম্ভিক বেগ ও কৌণিক কম্পাঙ্কের ভাগফল, । তাই আমরা লিখতে পারি:
সমীকরণটিকে এভাবেও লেখা যায়:
অথবা,
এর সমাধানে, c1 এবং c2 হলো দুটি ধ্রুবক যা সিস্টেমটির প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে নির্ণীত হয় (অর্থাৎ, প্রারম্ভিক t = 0 সময়ে অবস্থান c1, যেখানে প্রারম্ভিক বেগ c2ω), এবং মূলবিন্দু বলতে সাম্যাবস্থাকে বোঝায়।[A] এখানে প্রতিটি ধ্রুবকই একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ বহন করে: A হলো বিস্তার (সাম্যাবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সরণ), ω = 2πf কৌণিক কম্পাঙ্ক, এবং φ দশা.[B]
ক্যালকুলাসের কৌশল ব্যবহার করে সময়ের আপেক্ষক হিসেবে বেগ ও ত্বরণ নির্ণয় করা যায়:
- দ্রুতি:
- সর্বোচ্চ দ্রুতি: v = ωA (সাম্যাবস্থায়)
- সর্বোচ্চ ত্বরণ: Aω2
সংজ্ঞানুযায়ী, যদি কোনো ভর m সরল স্পন্দন গতিতে গতিশীল থাকে তবে এর ত্বরণ সরণের সমানুপাতিক।
যেহেতু ω = 2πf,
এই সমীকরণগুলো থেকে বোঝা যায় সরল স্পন্দন গতি মূলত "সমসময়ান্তরী" (isochronous) (গতির পর্যায়কাল এবং কম্পাঙ্ক, বিস্তার বা আদি দশার উপর নির্ভরশীল নয়)।
শক্তি সম্পাদনা
ω2 কে km দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে পাই, t সময়ে সিস্টেমটির গতিশক্তি K,
উদাহরণ সম্পাদনা
নিম্নবর্ণিত ভৌত ব্যবস্থাগুলো সরল স্পন্দন গতিতে গতিশীল বস্তুর কিছু উদাহরণ।
স্প্রিং এ ভর সম্পাদনা
একটি ভর m একটি স্প্রিং এর প্রান্তে যুক্ত, যার স্প্রিং ধ্রুবক k। এটি একটি আবদ্ধ স্থানে সরল স্পন্দন গতির উদাহরণ। এর পর্যায়কালের সমীকরণ
সুষম বৃত্তীয় গতি সম্পাদনা
সরল স্পন্দন গতিকে সুষম বৃত্তীয় গতির একমাত্রিক অভিক্ষেপ হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। যদি একটি বস্তু xy-সমতলের মূলবিন্দুকে কেন্দ্র করে r ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার পথে ω কৌণিক দ্রুতিতে গতিশীল থাকে, তবে যে কোনো অক্ষ বরাবর বস্তুটির গতি একটি সরল স্পন্দন গতি যার বিস্তার r এবং কৌণিক কম্পাঙ্ক ω।
স্পন্দন গতি সম্পাদনা
যখন কোনো বস্তু এর গতিপথের নির্দিষ্ট একটি বিন্দুর দুইপাশে গতিশীল থাকে, তখন তার গতিকে স্পন্দন গতি বলে। একে দোলন গতিও বলা যায়। এর পর্যায়কাল,
সরল দোলক সম্পাদনা
ক্ষুদ্র-কোণ অনুমান করার মাধ্যমে সরল দোলকের গতিকে কার্যত সরল স্পন্দন গতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। l দৈর্ঘ্যের একটি দোলকে একটি ভর যুক্ত থাকলে এবং অভিকর্ষজ ত্বরণকে দ্বারা প্রকাশ করলে দোলকটির পর্যায়কাল,
এখান থেকে দেখা যায় দোলকটির পর্যায়কাল দোলনের বিস্তার বা স্তুটির ভরের ওপর নির্ভর করে না, তবে অভিকর্ষজ ত্বরণ এর ওপর নির্ভর করে। তাই চাঁদে একই দৈর্ঘ্যের একটি দোলক চাঁদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র প্রাবল্য কম হওয়ার দরুণ তুলনামূলক ধীরে দোল খাবে। আবার পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে এর মান সামান্য ভিন্নতা প্রদর্শন করে, ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠের স্থানভেদে ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে দোলকের পর্যায়কালেরও অতি সামান্য পরিবর্তন হয়।
উপরিউক্ত সমীকরণটি কেবল ক্ষুদ্র কোণে দোলনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কারণ হলো এই যে, কৌণিক ত্বরণ α কৌণিক সরণের সাইন অনুপাতের সমানুপাতিক:
স্কচ জোয়াল সম্পাদনা
স্কচ জোয়াল হলো একটি কৌশল যার সাহায্যে ঘূর্ণনগতিকে রৈখিক স্পন্দন গতিতে পরিণত করা যায়। জোয়ালটির খাপ-এর অবস্থানের পার্থক্যের ভিত্তিতে এর রৈখিক গতির ভিন্নতা হতে পারে, তবে মৌলিকভাবে জোয়ালটির সুষম বৃত্তীয় গতি মূলত সরল স্পন্দন গতির জন্ম দেয়।
আরও দেখুন সম্পাদনা
টীকা সম্পাদনা
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
- Fowles, Grant R.; Cassiday, George L. (২০০৫)। Analytical Mechanics (৭ম সংস্করণ)। থমসন ব্রুকস/কোল। আইএসবিএন 0-534-49492-7।
- Taylor, John R. (২০০৫)। Classical Mechanics। ইউনিভার্সিটি সায়েন্স বুকস। আইএসবিএন 1-891389-22-X।
- Thornton, Stephen T.; Marion, Jerry B. (২০০৩)। Classical Dynamics of Particles and Systems (৫ম সংস্করণ)। ব্রুকস কোল। আইএসবিএন 0-534-40896-6।
- Walker, Jearl (২০১১)। Principles of Physics (৯ম সংস্করণ)। হোবোকেন, নিউ জার্সি: ওয়াইলে। আইএসবিএন 978-0-470-56158-4।