সপ্তস্বর্গ
সপ্তস্বর্গ, ধর্মীয় বা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বে, বলতে স্বর্গের সাতটি স্তর বা বিভাগকে বোঝায়। ধারণাটি, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ধর্ম সহ ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামে; এবং হিন্দুধর্মের মতো অন্যান্য ধর্মেও পাওয়া যায়। জৈনধর্ম সহ এই ঐতিহ্যগুলির মধ্যে কয়েকটিতে সাতটি পৃথিবী বা সাতটি পাতাল-উভয়ই দেবতাদের আধিভৌতিক রাজ্যের সাথে এবং ধ্রুপদী গ্রহ এবং স্থির নক্ষত্রের মতো পর্যবেক্ষিত মহাকাশীয় বস্তুর ধারণা রয়েছে।[১]
সাতটি স্বর্গের প্রত্যেকটি সাতটি ধ্রুপদী গ্রহের একটির সাথে মিল রয়েছে যা প্রাচীনকালে পরিচিত। প্রাচীন পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছেন যে এই স্বর্গীয় বস্তুগুলি (চন্দ্র, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি) একে অপরের থেকে এবং তাদের বাইরের স্থির নক্ষত্র থেকে আকাশে বিভিন্ন গতিতে চলে গেছে। ধূমকেতুর বিপরীতে, যেগুলো কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল, তারা নিয়মিত প্যাটার্নে চলেছিল যা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে।[২] তারা আরও লক্ষ্য করেছে যে আকাশের বস্তুগুলি পৃথিবীর বস্তুকে প্রভাবিত করে যেমন সূর্যের গতিবিধি উদ্ভিদের আচরণ বা চাঁদের গতি সমুদ্রের জোয়ারকে প্রভাবিত করে। অন্যরা বিশ্বাস করে যে সাতটি স্বর্গ প্রাচীন পশ্চিমা জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে কালপুরুষ, বিগ ডিপার, লিটল ডিপার এবং প্লেইডস/সেভেন সিস্টারের সাথে সম্পর্কিত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মেসোপটেমীয় ধর্মমতসম্পাদনা
মেসোপটেমিয়ায় সপ্ত স্বর্গের যে ধারণার বিকাশ ঘটেছিল তা নৈসর্গিক ও আধিবিদ্যক দুইই ছিল।[৩] সুমেরীয় ভাষায় স্বর্গ (আসমান বা আকাশ) ও পৃথিবীকে (জমিন) বলা হত "আন" এবং "কি"।[৪] খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে সুমেরীয় জাদুমন্ত্রে সপ্তস্বর্গের উল্লেখ আছে, যেমন একটিতে এরকম লেখা "আন-ইমিনবি কি-ইমিনবি" ("স্বর্গ সাতটি, পৃথিবী সাতটি")।[৫] মেসোপটেমীয় ধর্মে সাধারণত স্বর্গ মানুষের জন্য কোন স্থান নয়। যেমন গিলগামেশের মহাকাব্যে বীর গিলগামেশ তার বন্ধু এনকিদুকে বলছেন, "স্বর্গে কে যেতে পারে বন্ধু? শুধু দেবতারাই শামাশের (সূর্যদেবের) সঙ্গে চিরকাল থাকবে।"
ইসলামসম্পাদনা
ইসলাম ধর্মের প্রধান গ্রন্থ কোরআনে উল্লেখ আছে সাতটি 'সামাওয়াত' (আরবি: سماوات; সামা' -এর বহুবচন) সম্পর্কে। "সামা" (আরবি: سماء যা আক্ষরিকভাবে "আকাশ" বা "নভোমণ্ডল" বুঝায়)-র প্রচলিত অনুবাদ ভারতবর্ষের ভাষাবলীতে "আসমান"। উদাহরণস্বরূপ সূরা "হা-মীম সেজদাহ্"-র (বা সূরা "ফুস্সিলাত") ১২ নম্বর আয়াত (কুরআন ৪১:১২), সূরা "আত-তালাক"-এর ১২ নম্বর আয়াত (কুরআন ৬৫:১২) ও সূরা "নূহ"-এর ১৫ নম্বর আয়াতে (কুরআন ৭১:১৫) এর উল্লেখ রয়েছে। এই আসমান বা স্বর্গ ইসলামে ন্যায়পরায়ণদের পরলৌকিক চিরস্থায়ী আবাস 'জান্নাত' (যা আক্ষরিকভাবে "বাগান" বা "কানন" বুঝায়) থেকে ভিন্ন, যাকে বাংলায় সাধারণত "বেহেশত" বলা হয়ে থাকে।([কুরআন ১৩:৩৫ (ইউসুফ আলী)], [কুরআন ১৮:৩১ (ইউসুফ আলী)], [কুরআন ৩৮:৪৯–৫৪ (ইউসুফ আলী)]) একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী সব গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথ প্রথম আসমানের অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য আসমানসমূহ এর অতীত বিদ্যমান।[৬]
হাদিস গ্রন্থ অনুযায়ী ইসলামের নবী তার উর্ধ্বগমনের (মিরাজের) রাতে বিভিন্ন আসমানে বিভিন্ন নবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। দুনিয়ার আসমানে আদাম এবং অন্যান্য আসমানে ইদরীস, মূসা , ঈসার সাক্ষাৎ পান। ইব্রাহীমকে তিনি ষষ্ঠ আসমানে পেয়েছেন।[৭]
হিন্দু ধর্মসম্পাদনা
কিছু পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মাণ্ড চৌদ্দটি জগতে বিভক্ত। সাতটি হল ঊর্ধ্বজগৎ, ভুলোক (পৃথিবী), ভুবরলোক, স্বরলোক, মহরলোক, জনলোক, তপোলোক ও সত্যলোক এবং সাতটি হল নিম্ন জগত, অতল, বিতল, সুতল, তালাতল, মহাতল, রসাতল এবং পাতাল।[৮]
খ্রিস্টান ধর্মসম্পাদনা
নূতন নিয়মে তৃতীয় স্বর্গের একটি স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। ৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের অধীন ম্যাসেডোনিয়ায় লিখিত একটি পৌলীয় পত্র এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাটি তুলে ধরে:
আমি খ্রীষ্টে আশ্রিত একটি লোককে জানি, চোদ্দ বছর আগে যে তৃতীয় স্বর্গে ধরা পড়েছিল, সশরীরে না অশরীরে তা জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ এই লোকটির ব্যাপার আমি জানি, সশরীরে কি অশরীরে, তা আমি জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ সে স্বর্গোদ্যানে ধরা পড়ায় এমন সব বিস্ময়কর কথা শুনেছিল, যা নিয়ে মানুষের কথা বলা উচিত নয়৷ (২য় করিন্থীয় ১২.২-৪)
বর্ণনাটি ধরা হয় লেখকের নিজের সম্পর্কেই একটি তির্যক উল্লেখ হিসেবে। প্রথম খ্রিষ্টাব্দে ইহুদী-খ্রিস্টানদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বর্গ বা আসমান ব্যতীত অন্য স্বর্গ বা আসমানে স্বর্গোদ্যান বা বেহেশত অবস্থিত এমন বিশ্বাসই এই অনুচ্ছেদটি প্রতিফলিত করছে বলে দৃশ্যত হয়। মূল গ্রীক ভাষ্যে (যার অর্থ "ধরা পড়েছিল"-এর চেয়ে "ধরে নেয়া হয়েছিল"-এর কাছাকাছি) এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যেতে পারে।[৯] দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে ইরেনিয়াসেরও সপ্ত স্বর্গের ব্যাপারে জানা ছিল (তার "Demonstration of Apostolic Preaching" ৯; "বৈধর্মের বিরুদ্ধে (Against Heresies)" অধ্যায়টি দেখুন)।
মধ্যযুগীয় কালক্রমে খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা মূল সপ্ত স্বর্গের দশ স্বর্গ করে ফেলেন। এই সৃষ্টিতত্ত্ব, যা ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শেখানো হত, তার সর্বোচ্চ সাহিত্যিক অভিব্যক্তি ঘটে দান্তের ডিভাইন কমেডিতে।
ইহুদি ধর্মসম্পাদনা
ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদ অনুসারে মহাবিশ্ব সপ্ত স্বর্গ বা সাত আসমানসমূহ (হিব্রু ভাষায়: שָׁמַיִם "শামাইম"; এই শব্দেরই আরবি স্বগত্রীয় শব্দ "সামাওয়াত") সমন্বয়ে গঠিত।[১০][১১] এগুলির নাম:
- বিলোন (וילון)
- রাকিয়া (רקיע)
- শেহাকিম (שחקים)
- যেবুল (זבול)
- মা'ওন (מעון)
- মাখোন/মাকোন (מכון)
- আরাবথ (ערבות) - সপ্তম স্বর্গ যেখানে 'ওফানিম' (যিহিষ্কেলের পুস্তকে বর্ণিত ঈশ্বরের স্বর্গীয় রথের চক্ররূপী রক্ষী), সরাফগণ ('সেরাফিম' - উচ্চপদের স্বর্গদূত বা ফেরেশতা অথবা এক জাতের আগ্নেয় স্বর্গীয় সত্তা), 'হায়োথ' বা 'খায়োৎ' (আরশ বহনকারী ফেরেশতা বা ঈশ্বরের আসনবাহক স্বর্গদূত) এবং প্রভূর সিংহাসন অবস্থিত
ইহুদিদের 'মেরকাবাহ' (স্বর্গীয় রথ) ও 'হেখালৎ' ("প্রাসাদসমূহ") সাহিত্যে সপ্তস্বর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হনোকের ৩য় পুস্তকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়।[১২]
আরো পড়ুনসম্পাদনা
গ্রন্থাবলীসম্পাদনা
- ডেভিডসন, গুস্তাভ।Dictionary of Angels: Including the Fallen Angels. নিউইয়র্কঃ দ্যা ফ্রি প্রেস, ১৯৬৭ (পূনঃ মুদ্রণ ১৯৯৪)। আইএসবিএন ০-০২-৯০৭০৫২-X ।
- গিঞ্জবার্গ, লুইস, হেনরিয়েট্টা সজোল্ড। The Legends of the Jews. ফিলাডেলফিয়াঃ দ্য জিউইশ পাবলিকেশন সোসাইটি অফ আমেরিকা, ১৯০৯-৩৮। আইএসবিএন ০-৮০১৮-৫৮৯০-৯।
তথ্য উৎসসম্পাদনা
- ↑ Hetherington, Norriss S. (২০১৪) [1st. pub. 1993]। Encyclopedia of Cosmology (Routledge Revivals) : Historical, Philosophical, and Scientific Foundations of Modern Cosmology। Routledge। পৃষ্ঠা 267, 401। আইএসবিএন 978-1-306-58055-7। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৫।
- ↑ Campbell, Robert। "Aristotle's 'On the Heavens'"। World History Encyclopedia।
- ↑ বার্নার্ড, জোডি এ (২০১২)। হিব্রুদের অতীন্দ্রবাদ: 'এপিস্টল টু দ্য হিব্রুস'-এ ইহুদীধর্মের রহস্যোন্মোচক অতীন্দ্রবাদের একটি গবেষণা (The Mysticism of Hebrews: Exploring the Role of Jewish Apocalyptic Mysticism in the Epistle to the Hebrews)। Mohr Siebeck। পৃষ্ঠা ৬২। আইএসবিএন 3-16-151881-0। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৫।
- ↑ "সুমেরীয় শব্দাবলী ও তার ইংরেজি অনুবাদ (Sumerian Words And Their English Translation)"। হিস্ট্রি ওয়ার্ল্ড। ৮ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০১৫।
- ↑ হরোউইটজ, ওয়েইন (১৯৯৮)। মেসোপটেমীর মহাজাগতিক ভূগোল (Mesopotamian Cosmic Geography)। Eisenbrauns। পৃষ্ঠা ২০৮। আইএসবিএন 0-931464-99-4। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৫।
- ↑ "‘সাত আসমান’ দ্বারা কি বুঝানো হচ্ছে?", Al-Islam.org
- ↑ আল লু'লু ওয়াল মারজান ১০২, iHadis.com
- ↑ Dalal, Roshan (২০১০)। Hinduism:An Alphabetical Guide। Penguin Books। পৃষ্ঠা 224। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6।
- ↑ ই ডাব্লিউ বুলিঙ্গার ইংরেজি ও গ্রিক ভাষার একটি সমালোচনামূলক শব্দকোষ ও মতৈক্য (A Critical Lexicon and Concordance to the English and Greek) "2, 14, To this "Third heaven" and "Paradise" Paul was caught away, 2 Cor. xii. 2, 4, (not "up", see under "catch") in "visions and revelations of the Lord", 2 Cor. xii. 1. One catching away—with a double revelation of the New heaven and the..."
- ↑ তালমুদে সপ্ত স্বর্গ (The Seven Heavens in the Talmud. see Ps. lxviii. 5).
- ↑ ইহুদি এনসাইক্লোপিডিয়া
- ↑ গেরশম শখোলেম ইহুদী জ্ঞানবাদ, মেরাকাবাহ অতীন্দ্রবাদ, এবং তালমুদীয় সংস্কৃতি (Jewish Gnosticism, Merkabah Mysticism, and the Talmudic Tradition), ১৯৬৫।