শ্রী শ্রী গণেশ পাগল
শ্রী শ্রী গণেশ পাগল (জন্ম: ১৮৪৮) ছিলেন একজন হিন্দু সিদ্ধপুরুষ। তিনি গণেশ পাগল নামেই লৌকমুখে পরিচিত। হিন্দুধর্মানুশারীদের নিকট গণেশ পাগল পূজনীয় ব্যাক্তিত্ব। তিনি দেহত্যাগের পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কদমবাড়ী আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন। বাবা গণেশ পাগল সেবাশ্রম মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীতে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থভূমি। বিশেষত বাঙালি হিন্দুর কাছে এটি একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।[১]
গণেশ পাগল | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | গণেশ ২৮ এপ্রিল ১৮৪৮ পোলসাইর, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ |
মৃত্যু | ১ জুন ১৯২৮ (বয়স ৮০) |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
গুরু | বিন্দু দাস |

জীবনী
সম্পাদনাজন্ম ও বাল্য জীবন
সম্পাদনা১৮৪১ সালে (১২৫৫ বঙ্গাব্দ) কোটালীপাড়া উপজেলার পোলসাইর গ্রামে সাধু পুরুষ গনেশ পাগল জন্মগ্রহণ করেন। গনেশ পাগলের পিতা শিরোমনি এবং মাতা নারায়ণী দেবী উভয়েই শ্রী শ্রী নারায়ন দেবের উপাসক ছিলেন। কথিত আছে, আনুমানিক ১২০০ বঙ্গাব্দের শুরুর দিকে বরদা চতুর্থীর শুক্রবারের ব্রাহ্মমুহূর্তে শুভ লগ্নে নারায়ণী দেবীর কোল আলোকিত করে এক মহাসুলক্ষণযুক্ত পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। শ্রী শ্রী নারায়ন ঠাকুরের আশির্বাদে গণেশ পূজার দিনে জন্ম হওয়ায় পিতামাতা পুত্রের নাম রাখেন ‘গণেশ’। পরবর্তীকালে তিনি গণেশ পাগল নামে খ্যাত হন।
বর্তমানে গণেশ পাগলের আবির্ভাব স্থানে একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির দেখা যায়, যার ফটকে নির্মাণ সাল খোদাই করা রয়েছে ১২২৫ বঙ্গাব্দ। কথিত আছে, এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এ থেকেই অনুমান করা যায়, তিনি ১২২৫ তিনিই নাকি বঙ্গাব্দেরও আগে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন পর এমন পুত্র লাভে পোলসাইরবাসীও আনন্দে মেতে ওঠে। গ্রামবাসীরা এরূপ দিব্যভাবাপন্ন শিশুপুত্রের জন্মের খবর পেয়ে সকলেই দলে দলে দেখতে আসে। যেহেতু তারা স্বাভাবিকভাবেই ভগবানের অনুরক্ত ছিলেন, তাই গণেশের পিতামাতাও সকলের প্রিয় ছিলেন। ধীরে ধীরে শিশুপুত্র বড় হতে থাকে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও একটি দুঃখ তাঁদের পীড়া দিচ্ছিল। সাধারণত যে বয়সে শিশুরা কথা বলা শুরু করে, সেই বয়সেও গণেশ কথা বলা শুরু করেনি। তাই সবার মনে অনেক কষ্ট। মা-বাবার ভয়, আমার ছেলে বোবা হবে নাতো! কিন্তু মা নারায়ণী স্বপ্নাদেশে জানতে পারলেন, দুঃখের কোনো কারণ নেই, এই পুত্র গোবিন্দের কৃপায় বাক্সিদ্ধ পুরুষ হবে। মাতা নারায়ণী গণেশকে নিয়েই ভগবানের সেবায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু গণেশ একটু দুষ্ট প্রকৃতির হওয়ায়, মাকে সে সারাক্ষণ সেবা-পূজায় বিরক্ত করে। তবে একটু বড় হলে সমস্ত সেবা পূজায় গণেশ অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠে। এভাবে নারায়ণী দেবী ভগবানের সেবা-পূজার মাধ্যমে খুব আনন্দে সংসারজীবন অতিবাহিত করছিলেন।[২]
গণেশের বয়স যখন দেড় বছর তখন তার পিতা শিরোমনি ধরাধাম ত্যাগ করে চলে যান। এরপর থেকেই তার ও তার মায়ের উপর পারিবারিক বৈশ্বয্য চরমে পৌঁছায়। এসব সহ্য করতে না পেরে নারায়ণী দেবী শিশু পুত্রকে সাথে নিয়ে স্বামীর ভিটা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন কোটালীপাড়ার ডৌয়াতলী বাপের বাড়িতে। নারায়ণী দেবীর পিতা গোলক বাগচী বড় কন্যা ও নাতিকে পরম যত্নে গ্রহণ করলেন। কিন্তু গণেশের কপালে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই অল্পদিনের ব্যবধানে মাতামহ ও মাতামহী দুজনই দেহত্যাগ করে।
সাধন-ভজন
সম্পাদনাকৈশর থেকেই গণেশ খুব মনোযোগের সাথে তার গুরু বিন্দু দাস ও অন্যান্যদের সেবা করতে থাকেন। একইসাথে গোবিন্দের প্রতিও তাঁর অনুরাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে। সবসময় কৃষ্ণের প্রতি ভাবোন্মত্ত থাকায় লোকে তাকে কেউখ্যাপা বলে ডাকতো। গুরু বিন্দু দাস গণেশের সেবার মনোভাব দেখে তাঁর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। গুরুবিন্দু দাস, কেষ্টখ্যাপা গণেশ এবং দুলি ও ফুলি নামে দুই শিষ্যাসহ অন্যান্য ভক্তরা মিলে তাঁদের আশ্রমজীবন খুব সুখেই কাটতে লাগল । বিন্দু দাস গ্রামে গ্রামে গিয়ে টহল দিতেন অর্থাৎ হরিনাম সহযোগে কীর্তন করতেন এবং সেই কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে অনেকেই মেতে উঠতেন। এছাড়া ভগবানের ভোগরন্ধন করে সকলের মাঝে তিনি প্রসাদ বিতরণ করতেন, সবাইকে গীতা ভাগবত পাঠ করে শোনাতেন এবং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তন করার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৈষ্ণবধর্মের শুদ্ধভক্তির ধারা ধরে রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত।
মৃত্যু
সম্পাদনাশ্রী বিন্দু দাস গোসাই-এর অনুচর মহামানব গনেশ পাগল ১৯২৮ সালে (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) মহাপ্রয়াণ করেন।
জানা যায়, দেহত্যাগের মাস ছয়েক আগে পাগল তার পাগলামী ছেড়ে দেন। তার ভক্ত কবি মনোহরের বাড়ি থেকে আর বের হতেন না। সামান্য আহার করতেন। কাথাবার্তা বিশেষ বলতেন না। তার এই শান্ত মূর্তি দেখে ভক্তকুল বুঝতে পারলেন পাগল আর বেশি দিন থাকবেন না ধরাধামে।
একদিন তার ভক্ত মনোহরকে ডেকে তিনি বললেন, “মনোহর! আমার যাওয়ার রথ তাড়াতাড়ি আসবে, আর বেশিদিন থাকব না। আগামী দোল পূর্ণিমা ভালো দিন, ঐ দিন আমি চলে যাব। আমার দেহটা পুড়িয়ে মাটিতে মিশিও দিও।”
বাংলা ১৩৩৫ সনের দোল পূর্ণিমায় সকল ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে পাগল দেহত্যাগ করলেন। পাগলের ইচ্ছানুযায়ী ভক্ত মনোহরের বাড়িতে পাগলের মরদেহ সৎকার করে ভক্তরা। সদকারের পর মনোহরের বাড়ি মহোৎসবের আয়োজন করে। ভক্তকুলের কাছে আজও কদমবাড়িতে আছেন পাগল। পাগলের অস্তিত্ব তারা খুঁজে পায় সর্বত্র। আজো পাগলের লীলা অব্যহত আছে। দূরদূরান্তের মানুষজন মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার অভিলাশে পাগলের আশ্রমে আসে। পাগলকে ভক্তি দেয়।
গণেশ পাগলের মূল মন্ত্র:
১. দুলিতে ফুলিতে বিন্দুতে ঠিক।
২. ভালো হ তবেই ভালো থাকবি।
৩. গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরু মহেশ্বর,
গুরু কৃষ্ণ, গুরু হরি, গুরুই ঈশ্বর।
আশ্রম প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনাগনেশ পাগলের অনুসারীদের জন্য ১৯০৫ সালে (১৩১২ বঙ্গাব্দে) মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী দিঘীরপাড় এলাকায় প্রায় ৩৬৫ বিঘা জমিতে গনেশ পাগল সেবাশ্রম গড়ে তোলা হয়।
আশ্রমের মন্দিরসমূহ
সম্পাদনাআশ্রমে মোট মন্দিরের সংখ্যা একশত আটটি। তবে আশ্রমের প্রধান ফটক অতিক্রম করে পাশেই দেখা মিলবে গুচ্ছ মন্দিরের। যেখানে আটটি সমন্বিত মন্দির একত্রে রয়েছে। সেগুলো হলো- লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, দূর্গা মন্দির, শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির, গৌর নিতাই মন্দির, রাম মন্দির, হরি মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, মনসা মন্দির।
সমাধি মন্দিরের উত্তর পাশে রয়েছে মনসা মন্দির ও দক্ষিণে রয়েছে শিব মন্দির। এছাড়া পূর্বে রয়েছে শ্মশান কালী মন্দি ও পশ্চিমে রয়েছে সরস্বতী মন্দির।
উৎসব
সম্পাদনা১৩৭ বছর আগে ১৩ জন সাধু মিলিত হয়ে ১৩ কেজি চাল ও ১৩ টাকা নিয়ে ১৩ ই জ্যৈষ্ঠ ভারতের কুম্ভমেলার আদলে সেবাশ্রমে কুম্ভমেলার আয়োজন করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ মেলার সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে। শ্রী শ্রী গনেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘের এই মেলা উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ কুম্ভমেলা হিসাবে স্বীকৃত। প্রায় ১৬৭ একর জমি অর্থাৎ ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত থাকে মেলার আয়তন। অতীতে মাত্র একদিনের জন্য মেলা অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমানে এই মেলার চলে প্রায় সপ্তাহ ব্যাপী।[৪]
প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই কুম্ভমেলার আয়োজনে দেশ-বিদেশের প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। ভারত, নেপাল ও ভূটান থেকেও বহু লোক এই কুম্ভমেলায় অংশ নেন। [৫] জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মেলায় আগত মানুষেরা বিশ্বাস করেন মেলায় আসলে এবং গণেশ পাগলের মন্দির দর্শন করলে সকল ধরণের বিপদ আপদ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "আজ মহামানব গণেশ পাগলের কুম্ভ মেলা"। সময় জার্নাল। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২৩।
- ↑ মহামানব শ্রীগনেশ পাগল, গণেশ, শ্রীতাপস বিশ্বাস, বিন্দু দাস মেমরিয়াল ক্লিনিক প্রেস, ২০২২, পৃষ্ঠা ১০
- ↑ Monoranjon Bala (২০০৯)। Ganesh Pagol Geetikavya। Ramon Publisher। পৃষ্ঠা 3–5। আইএসবিএন 978-81-89091-09-5।
- ↑ "গণেশ পাগলের কুম্ভ মেলা শুর"। কালের কন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২৩।
- ↑ "মাদারীপুরে শুরু হয়েছে গণেশ পাগলের কুম্ভমেলা"। সময়নিউজ.টিভি। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মে ২০২৩।