শ্রীচন্দ্র (শাসনকাল আনু. ৯৩০–৯৭৫)[২] দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের চন্দ্র রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা ছিলেন। পাঁচ প্রজন্মের চন্দ্র বংশে শ্রীচন্দ্র সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজা ছিলেন।[২] তিনি চন্দ্র রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃত করেন। এছাড়া চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদির জন্য চন্দ্র রাজাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।[৩]

শ্রীচন্দ্র
রাজত্ব৯৩০ - ৯৭৫[১]
পূর্বসূরিত্রৈলোক্যচন্দ্র
উত্তরসূরিকল্যাণচন্দ্র
মৃত্যু৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ
বংশধরকল্যাণচন্দ্র
রাজবংশচন্দ্র
রাজবংশচন্দ্র
পিতাত্রৈলোক্যচন্দ্র
ধর্মবৌদ্ধ[২]

রাজত্ব সম্পাদনা

রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পর রাজা শ্রীচন্দ্র "পরমসৌগত",[৪] "পরমেশ্বর", "পরমভট্টারক" ও "মহারাজাধিরাজ" উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে বসেন।[১] চন্দ্র রাজাদের মধ্যে শ্রীচন্দ্রই সবচেয়ে বেশি ৪৫ বছর রাজ্য শাসন করেন।[২][৩] ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুল মোমিন চৌধুরী তাঁর "ডাইন্যাস্টিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল" (বাংলার রাজবংশীয় ইতিহাস) বইয়ে শ্রীচন্দ্রের শাসনকাল ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[৫] আবার রমেশচন্দ্র মজুমদার "বাংলাদেশের ইতিহাস" গ্রন্থে শ্রীচন্দ্রের শাসনামল ৯০৫ থেকে ৯৫৫ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেন।[৬][৭] বর্তমান মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুরের পদ্মার তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্টকুমিল্লা শ্রীচন্দ্রের রাজত্বেত অধীনে ছিল।[৬] শ্রীচন্দ্র চন্দ্র রাজ্যের রাজধানী দেবপর্বত থেকে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে স্থানান্তর করেছিলেন।[১]

এখন পর্যন্ত চন্দ্রবংশের বারোটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে আটটিই রাজা শ্রীচন্দ্র প্রণীত। শাসনগুলো আবিষ্কারের আগে চন্দ্র রাজাদের মধ্যে কেবল শ্রীচন্দ্র সম্পর্কেই জানা যেত।[২] এই শাসনগুলো আবিষ্কারের পর চন্দ্র বংশের অন্যান্য রাজাদের শাসন সম্পর্কে জানার পাশাপাশি শ্রীচন্দ্র সম্পর্কেও ব্যাপকভাবে জানা সম্ভব হয়। ময়নামতিতে প্রাপ্ত তাম্রলিপি থেকেই রাজা শ্রীচন্দ্র সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায়। এছাড়া মৌলভীবাজারে প্রাপ্ত পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে তাঁর সম্পর্কে এবং কামরূপের বিরুদ্ধে তাঁর সফল অভিযানের সম্পর্কে জানা যায়। তিনি তাঁর পিতা ত্রৈলোক্যচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত চন্দ্র রাজবংশের সীমানা বঙ্গসমতট পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।[৮] শ্রীচন্দ্র পুণ্ড্রবর্ধনের সীমানা শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।[৯]

তাঁর অধীনে হরিকেল সেনাবাহিনী পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এবং সম্ভবত উত্তরবঙ্গের কম্বোজদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেন। তবে পরবর্তী পাল রাজা তৃতীয় গোপালের পক্ষে পাল সাম্রাজ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।[২] এছাড়া কম্বোজদের সাথে সংঘাত প্রথম মহীপালের রাজত্বের প্রথম দিকে পালদের পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রেখেছিল।[৮] শ্রীচন্দ্র দেবপর্বত থেকে তাঁর রাজ্যের রাজধানী নবপ্রতিষ্ঠিত বিক্রমপুরে স্থানান্তর করেন।[২]

ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পাদনা

তাম্রশাসনগুলো থেকে শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে জানা যায়। ধর্মবিশ্বাসের কারণে শ্রীচন্দ্র তাঁর প্রজাদের ধর্মবিশ্বাসেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। চন্দ্রদের হাতে লালমাই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি নতুন শক্তি লাভ করে।[২] তবে শ্রীচন্দ্রের প্রণীত শাসনে শ্রীহট্ট অঞ্চলে বাস্তুত্যাগী ব্রাহ্মণদের মধ্যে জমিবণ্টনের নজির পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, শ্রীচন্দ্র ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।[২]

মঠ প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

শ্রীচন্দ্র ৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিষয়ে নয়টি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। একটিতে দেবতা ব্রহ্মা পূজিত হতেন। এ মঠে তিনি পনেরো জন বাদক ভূমিসহ নিয়োগ করেন। "ব্রহ্মপুর" নামে পরিচিত মঠটিকে তিনি নিজের নামে "শ্রীচন্দ্রপুর" মঠ নামকরণ করেন। সেইসাথে বসতিটি ব্রহ্মপুর-চন্দ্রপুর বসতি নামে পরিচিত হয়।[১০] বাকি আটটি মঠে অগ্নিদেবতা বা বৈশ্বানর, মহাদেবের দুই রূপ যোগেশ্বর ও মহাকাল এবং জমনি বা জৈমিনির পূজা করা হতো।[১০] এই আটটি মঠের মধ্যে চারটি বঙ্গাল (স্থানীয় বা দেশীয়) ও চারটি দেশান্তরীয় (বহিরাগত বা বিদেশী)। একই সমাজের একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়।[১০] তবে এখানে ভূমি বণ্টনেও ব্রাহ্মণ, কায়স্থদের থেকে বৈদ্যজাতীয় শ্রেণিকে অধিক ভূমি প্রদানজনিত অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়।[১০]

শ্রীচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এই মঠগুলোতে চতুর্বেদসহ মূলত হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করানো হতো। মঠের ছাত্ররাও ছিলেন মূলত ব্রাহ্মণ। এ থেকে শ্রীচন্দ্রের ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ভিত্তি লাভ করে।[১০] তবে এর সাথে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোও প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে যেভাবে স্থানীয়দের চেয়ে বহিরাগতদের সুবিধা দিয়ে ভূমি বণ্টন করা হয়েছে, তা থেকে রাজাদের ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়া একে অনাবাসিক এলাকাকে জন-অধ্যুষিত এবং অকর্ষিত ভূমিকে চাষের অধীনে আনার প্রচেষ্টাও মনে করা হয়।[১০] এছাড়া এই মঠগুলো রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা যেমন লাভ করত, তেমনি রাজার ক্ষমতা সংহত করতেও কাজ করত।[১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "দ্বিতীয় অধ্যায়: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস: প্রাচীনকাল থেকে বঙ্গভঙ্গপূর্ব পর্যন্ত (অনুচ্ছেদ: দক্ষিণ–পূর্ব বাংলার স্বাধীন রাজ্য: চন্দ্র রাজবংশ )"। বাংলাদেশ ও প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস, নবম-দশম শ্রেণী। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা। ২০১১। পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯। 
  2. চৌধুরী, আবদুল মমিন। "চন্দ্র বংশ"বাংলাপিডিয়া। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  3. রাসেল, তানজির আহমেদ (১৯ জুলাই ২০২০)। "মৌলভীবাজারে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের চেয়েও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়: পরিদর্শনে যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ"। মানব জমিন। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  4. কাসেম, আবুল (৭ নভেম্বর ২০১৪)। "অতীশ দীপঙ্করের রাজবংশ পরিচয়"। ইত্তেফাক আর্কাইভ। ১৩ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  5. চৌধুরী, দ্বোহা (৭ আগস্ট ২০২০)। "পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন: তাম্রফলকে খোদিত ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত অধ্যায়"। দ্য ডেইলি স্টার। 
  6. শাকিল, মাহফুজ (২০ জুলাই ২০২০)। "জুড়ীতে হাজার বছর আগের বিশ্ববিদ্যালয়? অনুসন্ধানে যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের দল"। কুলাউড়া, মৌলভীবাজার: কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  7. ইসলাম, সাইফুল (২৭ জুলাই ২০২০)। "মৌলভীবাজারে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজে প্রত্নতাত্ত্বিক দল"। মৌলভীবাজার: ঢাকা ট্রিবিউন। ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০২০ 
  8. "ইতিহাস"বাংলাপিডিয়া। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  9. ঘোষ, সুচন্দ্রা। "পুন্ড্রবর্ধন"বাংলাপিডিয়া। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  10. "মঠ"। বাংলাপিডিয়া। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। 

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • Singh, Nagendra Kr. (২০০৩)। Encyclopaedia of Bangladesh। Anmol Publications Pvt Ltd। পৃষ্ঠা 7–21। আইএসবিএন 81-261-1390-1 
  • Chowdhury, Abdul Momin (১৯৬৭)। Dynastic History of BengalDacca: The Asiatic Society of Pakistan। 
পূর্বসূরী
ত্রৈলোক্যচন্দ্র
চন্দ্রবংশীয় রাজা
৯৩০ - ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ
উত্তরসূরী
কল্যাণচন্দ্র