শুনতে কি পাও!
শুনতে কি পাও কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ও সারা আফরীন প্রযোজিত একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র। মুক্তির পরপরই আলোচিত এই চলচ্চিত্রটি একাধারে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ২০১২ সালের ২৯শে অক্টোবরে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রামাণ্য উৎসব জার্মানির ডক-লাইপজিগের ৫৫তম আসরের 'উদ্বোধনী ছবির' আমন্ত্রণ পেয়ে ছবিটি প্রথম আলোচনায় আসে।[১] এরপর অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব ইডফা'র ২৫তম আসরে[২], এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ প্রামাণ্য উৎসব জাপানের ইমায়াগাতায় 'নিউ এশিয়ান কারেন্ট'[৩] প্রতিযোগিতাসহ প্রায় পঁচিশটি আন্তর্জাতিক উৎসবে আমন্ত্রিত হয় ছবিটি। ২০১৩ এর মার্চে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব সিনেমা দু্য রিলে'র ৩৫তম আসরে ছবিটি জিতে শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য সর্ব্বোচ্চ পুরস্কার 'গ্রাঁপ্রি'[৪]। ২০১৪ এর ফ্রেব্রুয়ারীতে এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রামাণ্য উৎসব 'মুম্বাই আন্তর্জাতিক উৎসবে জিতে নেয় শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য সর্ব্বোচ্চ পুরস্কার 'স্বর্ণশঙ্খ'[৫]। ২০১৬ এর আগস্টে ছবিটি প্রদর্শিত হয় সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের 'ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং' বিভাগে।[৬] ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আইলা নামক যে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়, এর পরবর্তী সমাজব্যাবস্থার উপর নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি। এ যাবৎ মোট নয়টি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরষ্কৃত ছবিটি ‘শুনতে কি পাও’ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালে এটি বাংলাদেশে মুক্তি পায় [৭] এবং দর্শকনন্দিত হয়ে চার সপ্তাহ প্রদর্শিত হয়। প্রামাণ্যছবির সিনেমা হলে বাণিজ্যিক মুক্তির এটা ছিলো এক বিরল ঘটনা, এর আগে তারেক মাসুদ নির্মিত 'মুক্তির গান' নির্মানের প্রায় দুই দশক পর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র হিসাবে এক সপ্তাহের জন্যে মুক্তি পেয়েছিলো সিনেমা হলে।
শুনতে কি পাও | |
---|---|
পরিচালক | কামার আহমাদ সাইমন |
প্রযোজক | সারা আফরীন |
চিত্রনাট্যকার | কামার আহমাদ সাইমন |
চিত্রগ্রাহক | কামার আহমাদ সাইমন |
সম্পাদক | সৈকত শেখরেশ্বর রায় |
পরিবেশক | ক্যাট ও ডক্স |
মুক্তি | ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ (বাংলাদেশ) |
স্থিতিকাল | ৯০ মিনিট |
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
কাহিনী সংক্ষেপ
সম্পাদনাশুনতে কি পাও নিয়ে আমাদের বন্ধুমহলে একটি বিতর্ক উঠেছে—ছবিটি কি ডকুমেন্টারি না ফিকশন? আমরা কিন্তু তাদের এই বিতর্ক বেশ উপভোগ করছি। কারণ, ছবি বানানোর সময় আমাদের মাথায় ডকুমেন্টারি কিংবা ফিকশনের চিন্তা ছিল না; কেবল চেয়েছি, আমরা একটি চলচ্চিত্র বানাব।[৮]
— এক সাক্ষাৎকারে "শুনতে কি পাও" আসলে প্রামাণ্যচিত্র না চলচ্চিত্র এই প্রশ্নের উত্তরে সারা আফরীন
ভদ্রা নদীর পারে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটি গ্রাম... নাম তার ‘সুতারখালি’। জলে জঙ্গলে লড়াই করে চার পুরুষের আবাদে প্রায় ১০০ পরিবারের বাস এই সুতারখালি গ্রামে। এখানেই ঘর বেঁধেছিলো রাখী আর সৌমেন, জন্ম হয়েছিলো তাদের ভালোবাসার সন্তান... রাহুলের। ২০০৯ সালের ২৫শে মে, রাহুলের বয়স যখন মাত্র চার... ‘আইলা’ নামের এক প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। আর সেই দিন থেকে শুরু হয় রাখী, সৌমেন এবং রাহুলের এক অন্য জীবন… দিন যায়, ঋতু বদলায়... সেইসাথে সর্ম্পকও বদলায়। তারপরও বৃষ্টি শেষে, কোদাল হাতে বেরিয়ে আসে ওরা… জীবনেরই ডাকে, জীবনকে ভালোবেসে।
সেই বদলানোর দিন থেকে ছবিটির গল্প আরম্ভ হয় এবং প্রায় দু'বছরের একটি যাত্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনে আরেকটি পরিবর্তন তারা সামগ্রিকভাবে নিয়ে আসে৷ এই দু'বছরের যাত্রায় তাদের ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে শুরু করে ঐ গ্রামের মানুষের সামষ্টিক যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রূপকার্থে সমগ্র বাংলাদেশেরই একটি গল্প।[৮][৯]
কলা কুশলী
সম্পাদনা- পরিচালনা - কামার আহমাদ সাইমন
- প্রযোজনা - সারা আফরীন
- চিত্রনাট্য - কামার আহমাদ সাইমন
- চিত্রগ্রাহক - কামার আহমাদ সাইমন
- সম্পাদনা - সৈকত শেখরেশ্বর রায়
- শব্দ সম্পাদনা - সুকান্ত মজুমদার
- প্রযোজনা ব্যবস্থাপক- দেলোয়ার হোসেন মারুফ, নিশিতচন্দ্র মিস্ত্রি
- গবেষণা- ওয়াসেক রহমান, সুলতানা ইসমেত জেরিন
আলোচনা, সমালোচনা
সম্পাদনা"সত্যজিৎ রায়ের অপু-উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয় "
বিশ্বের প্রাচীনতম প্রামাণ্য উৎসব জার্মানির ডক লাইপজিগের উদ্বোধনী ছবি হিসাবে বাছাই প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ডকুমেন্টারী নেটওয়ারক-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্র সমালোচক টু স্টিন মুলার
"জীবনের জয়গান, একটি সঙ্গীতময় উপাখ্যান "
প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব সিনেমা দ্যু রিলে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার ‘গ্রাঁপ্রি’ প্রদানকালে জুরি কমিটি
"প্রামাণ্য জীবনের অনবদ্য চিত্রায়ন... লোঅ্যাঙ্গেল ক্যামেরার অসাধারণ কাজ "
বিশ্বের বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসব আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত ২৫তম ইডফাতে ছবিটির আনুষ্ঠানিক বাছাই প্রসঙ্গে
"ধ্যানের কাছাকাছি... শ্রদ্ধাশীল, ধৈর্যশীল এবং ভালবাসার পর্যবেক্ষণ "
মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য সিনেমার পুরস্কার 'স্বর্ণশঙ্খ' দেওয়ার প্রাক্কালে জুরী কমিটি
"শক্তিশালী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বকীয় শৈল্পিক উপস্থাপনা... "
ইউরোপীয় ডকুমেন্টারি ম্যাগাজিনে দুবাই ভিত্তিক চলচ্চিত্র সমালোচক ওজগে ক্যালাফতে
তাছাড়া নানান জগতের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব এই চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেছেন। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান বলেন, "যেন গ্রিক পুরাণের আদিম মানুষ এক নাজুক প্রাণী হিসেবে রুদ্র প্রকৃতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার প্রকাণ্ড থাবা নেই, বিশাল দাঁত নেই, তীক্ষ নখ নেই, ওড়ার পাখা নেই। দুর্বল সেই প্রাণী প্রমিথিউসের চুরি করা আগুন দিয়ে ক্রমেই বশ করে ক্ষমতাধর এই প্রকৃতিকে এবং নিজেই তৈরি করে এক দ্বিতীয় প্রকৃতি। "[১০]
নাট্যপরিচালক ও চলচ্চিত্র আন্দোলন কর্মী মাহমুদ দিদার বলেন, "শুনতে কি পাও’ এর অতি বাস্তব প্যারাডকক্স এই যে গল্পটা পুঁজির লড়াইয়ের বাহাসটা বেশিক্ষণ ধরে থাকতে পারে না কারণ সে সিনেমার সমালোচনার অন্তর মহলে অনুপ্রবেশ করে ফেলে। "[১১]
লেখক ও গবেষক ফাহমিদুল হক বলেন, "ক্যামেরা এখানে লুকিয়ে অনুসরণ করা ‘ভয়্যার’ নয়, নয় জিগা ভের্তভের ‘কিনো আই’, বরং ‘সিনেমা ভেরিতে’র শান্ত-বিশ্বস্ত ক্যামেরা এখানে সাধারণ মানুষের অন্তঃপুরের কাহিনী তুলে ধরে। "[১২]
চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম বলেন, "নির্মাণগুণে সত্য দৃশ্যের কাব্যময়তা বাস্তবকে অতিক্রম করে যায়। জাতিসত্তা জেগে ওঠে। মাছ-ভাতের শান্ত বাঙালীর লড়াকু রূপ, আহা কি চমৎকার। "[১৩]
লেখক ও সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর বলেন, "...জীবনই শিল্প, জীবনের শৈল্পিক প্রকাশের জন্য মগ্ন-চৈতন্যে শিস দিতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। "[১৪]
কলাম লেখক আনিস পারভেজ বলেন, "Observing the observation of Kamar is a feast. (কামারের পর্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা হল একটি ভোজন।) "[১৫]
উৎসব, সম্মাননা ও পুরস্কার
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "বাংলাদেশি ছবি দিয়ে শুরু হবে ডক-লাইপসিশ"। DW.DE।
- ↑ "Are You Listening!"। IDFA। সংগ্রহের তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০১১।
- ↑ "New Asian Currents"। ইয়ামাগাতা আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র চলচ্চিত্র উৎসব। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ ক খ "প্যারিসে গ্রাঁ প্রি জিতল 'শুনতে কি পাও'"। ২০১৭-০৩-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৭-০২।
- ↑ "মুম্বাইয়ে স্বর্ণশঙ্খ পেয়েছে 'শুনতে কি পাও!'"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "লোকার্নো উৎসবে বাংলাদেশের ছবি"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-১৫।
- ↑ "২১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাবে 'শুনতে কি পাও'"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৪।
- ↑ ক খ "একটি পানতোয়ার গল্প"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ ক খ "বাংলাদেশি ছবি দিয়ে শুরু হবে ডক-লাইপসিশ"। DW.DE।
- ↑ "শুনতে কি পাও: টুকরো ভাবনা"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ "'শুনতে কি পাও'-এর অগ্রযাত্রা"। দৈনিক জনকণ্ঠ। ২০১৪-০৭-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মার্চ ২০১৪।
- ↑ "শুনতে কি পাও: নৃতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা"। বাংলানিউজ ২৪.কম। ২ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ "শুনতে কি পাও!"। দৈনিক সমকাল। ১ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ "হ্যাঁ, শুনতে পাই"। প্রথম আলো। ২০১৪-০৩-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "SHUNTE KI PAO Magnificence of Ordinary People"। দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ৩, ২০১৪।
- ↑ ক খ "মুম্বাইয়ে স্বর্ণশঙ্খ পেয়েছে 'শুনতে কি পাও!'"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ "শুনতে কি পাও! এর ফিল্ম সাউথ এশিয়া জুরি অ্যাওয়ার্ড অর্জন"। ২৬ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০১৪।