রায়বাহাদুর শিবচন্দ্র নন্দী (জুন ১৮২৪—৬ এপ্রিল ১৯০৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় বাঙালি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যিনি বৃটিশ ভারতে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ সংক্রান্ত প্রযুক্তির প্রয়োগের অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ভারতে প্রথম কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন প্রতিষ্ঠায় সফল হন। এছাড়াও তিনি প্রথম বাঙালি প্রযুক্তিবিদ যিনি নতুন উদ্ভাবনী উপায়ে আগ্রা হতে কলকাতা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনার ব্যয়ে সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন।[১]

বৃটিশ ভারতের কলকাতার এক বিনয়ী পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন শিবচন্দ্র। তিনি উচ্চশিক্ষা তেমন না পেলেও ইংরাজী শিখে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার টাঁকশালে রিফাইনারি বিভাগে কেরানির চাকরিতে প্রবেশ করেন। এখানে কাজের সূত্রে পরিচয় হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম রসায়ন ও মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপক উইলিয়াম ব্রুক ও'সাগনেসির সাথে। ও'সাগনেসি যখন বৃটিশ ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ যন্ত্র স্থাপনার ভারপ্রাপ্ত হন, কলকাতা টাঁকশালে শিবচন্দ্রের কারিগরি দক্ষতায় মুগ্ধ হন এবং তিনি শিবচন্দ্রকে তার সহকারী করে নেন। শিবচন্দ্র টেলিগ্রাফ সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থাদি পাঠ করে টেলিগ্রাফের কাজে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতা হতে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত পরীক্ষামূলক প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে সফলকাম হন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে শিবচন্দ্রই ডায়মণ্ড হারবার থেকে প্রথম বার্তাটি প্রেরণ করেন কলকাতায়। অন্য প্রান্তে তখন ও-শাগনেসির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং লর্ড ডালহৌসি। বড়লাট লর্ড ডালহৌসি সাংকেতিক ধ্বনিতে তাঁকে অভিনন্দিত করেন। এরপর তিনি প্রথমে টেলিগ্রাফ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর হন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণের আগে বৃটিশ সরকার তাঁর কাজে  অসামান্য অবদানের জন্য রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে।[২]

শিবচন্দ্র নন্দীর অবদান সম্পাদনা

 
শিবচন্দ্র নন্দীর তালগাছের গুঁড়ি ব্যবহার করা পোস্টের নকশা
কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন-

কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বিস্তারের উদ্দেশ্যে জীবন বিপন্ন করে কম খরচে জেলে ডিঙি নিয়ে পদ্মায় সাত মাইল 'সাবমেরিন কেবল' বসাবার দায়িত্ব নেন এবং মাটির নিচ থেকে লাইন তোলবার জন্য এক চমকপ্রদ উপায়ে তালগাছের লম্বা লম্বা গুঁড়িকে খুঁটি হিসাবে ব্যবহারের করে সেকাজ সম্পন্ন করেন। এই অসাধ্যসাধন কাজে তিনি বৃটিশ সরকারের দশ হাজার টাকার সাশ্রয় করান।[৩]

কলকাতা থেকে আগ্রা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন-

১৮৫২-৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে পূর্ব বরাকর, বরাকর-এলাহাবাদ, বারাণসী ও বারাণসী থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত ৯০০ মাইল টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন করার সময় শোন নদীতেও অনুরূপভাবে তালগাছের গুঁড়িকে খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন।[৪] শিবচন্দ্র নন্দীর দেশীয় উদ্ভাবনী কৌশলে তালগাছের গুঁড়িকে খুঁটি হিসাবে ব্যবহারের নির্দেশিকা টেলিগ্রাফি ম্যানুয়ালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।[৫] তিনি ১৮৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।

স্যার রোপার লেথব্রীজ রচিত গ্রন্থ দ্য গোল্ডেন বুক অফ ইন্ডিয়া-তে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় শিবচন্দ্রের কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল দিল্লিতে টেলিগ্রাফ বিদ্রোহ স্মারক উদ্বোধনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল কলকাতায় মহামারী চলাকালীন প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সেদিন শহরের স্থানীয় টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ ছিল।[৬][৭]

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মহানগরীর বড়বাজারের অঞ্চলের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে একটি লেনের নামকরণ করা হয় "শিব নন্দী লেন"।[৪][৮]

‘কলের শহর কলকাতা’ নামক গ্রন্থে সিদ্ধার্থ ঘোষ বলেছেন, "ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরেই ব্যাপকভাবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং বৃত্তিরও জন্ম হয় তখনই। শিবচন্দ্র নন্দীকে সঙ্গত কারণেই 'প্রথম' ভারতীয় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলে অভিহিত করা যায়, ডিগ্রির দৌলতে নয়, কৃতিত্বের জন্য ও পেশাগত কারণে।"[৯]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Metals, Indian Institute of (১৯৫৩)। Transactions of the Indian Institute of Metals (ইংরেজি ভাষায়)। Indian Institute of Metals.। 
  2. Kochhar, R.K. (১৯৯৩)। "Science in British India. II. Indian response" (পিডিএফ): 55–62। জেস্টোর 24095556 [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. Prohor। "১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার - Prohor"১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার - Prohor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-০৪ 
  4. Krishnalal, Shridharami (১৯৫৩)। Story Of The Indian Telegraphs: A Century Of Progress। Posts and Telegraphs Department। পৃষ্ঠা 11–15। 
  5. O'Shaughnessy, W.B. (১৮৫৮)। The Electric Telegraph in British India। পৃষ্ঠা 35 
  6. Prohor। "১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার - Prohor"১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার - Prohor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-০৪ 
  7. "পুরোনো কলকাতার বাঙালি কারিগর"www.swastikaonline.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৫-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-০৪ 
  8. Shridharani, Krishnalal (১৯৫৬)। Sibu Nandy Lane, CalcuttaAmrita Bazar Patrika। পৃষ্ঠা 151–152, 160। 
  9. ঘোষ, সিদ্ধার্থ (১৯৫৯)। কলের শহর কলকাতা। ৫ শঙ্কর ঘোষ লেন, কলকাতা ৬: রীডার্স কর্নার। পৃষ্ঠা ১১০।