শাহজাহান ভূঁইয়া
শাহজাহান ভূঁইয়া (২৬ মার্চ ১৯৫০ – ২৪ জুন ২০২৪) ছিলেন একজন বাংলাদেশি সৈনিক, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও জল্লাদ। ১৮৪ বছরের কারা ভোগের সাজা পাওয়া শাহজাহান আপিল ও ভাল আচরণের জন্য ৩১ বছরের বেশি সময় কারা জীবন কাটান। তার কারাজীবনের অধিকাংশ সময়, বিশেষ করে ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত, তিনি পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাটিয়েছেন। সাজারত অবস্থায় জল্লাদ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় ঘাতক, তিন যুদ্ধাপরাধী ও অন্যান্য হত্যা মামলার আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করেন।[৫][৬] তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দিন কারাবাস করা আসামি।[৭] এবং সবচেয়ে বেশি ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদ।[২] সাজা শেষে স্বাভাবিক জীবনে নিজ কারাজীবন নিয়ে আত্মজীবনী লিখেছেন।
শাহজাহান ভূঁইয়া সৈনিক (বরখাস্ত), জল্লাদ | |
---|---|
![]() | |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | [১] নরসিংদী জেলা, পূর্ববঙ্গ, পাকিস্তান অধিরাজ্য (বর্তমান পলাশ, নরসিংদী, বাংলাদেশ) | ২৬ মার্চ ১৯৫০
মৃত্যু | ২৪ জুন ২০২৪[২] শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ[৩] | (বয়স ৭৪)
মৃত্যুর কারণ | বুকে ব্যথা |
সমাধিস্থল | ইছাখালী, পলাশ, নরসিংদী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
দাম্পত্য সঙ্গী | সাথী আক্তার (বি. ২০২৩; বিচ্ছেদ. ২০২৪)[৪] |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | নরসিংদী সরকারি কলেজ |
জীবিকা | সৈনিক, জল্লাদ, চা–বিক্রেতা |
সামরিক পরিষেবা | |
আনুগত্য | ![]() |
শাখা | ![]() |
কাজের মেয়াদ | ?–১৯৮১ |
পদ | ![]() |
সবচেয়ে বেশি কারাবাস করা আসামি সর্বাধিক ফাঁসি দেওয়া জল্লাদ |
জীবনী
সম্পাদনাশাহজাহান ভুঁইয়া ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর এর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারে তিন বোন এবং এক ভাই ছিল। তার পিতার নাম হাসান আলী ভুঁইয়া এবং মাতার নাম মেহের। খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ও পারলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন[১][৭]
রাজনৈতিক ও সেনা জীবন
সম্পাদনাশাহজাহান ভুঁইয়া ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে নরসিংদী জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।[৭] তিনি একজন প্রাক্তন সেনাসদস্য। উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সিপাহি হিসেবে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ম–কানুন ও পরিশ্রম তার পছন্দ হয়নি। তিন বছর চাকুরির পর ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিতির জন্য ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হন।[৭][৮]
অপরাধ ও কারা জীবন
সম্পাদনাপরবর্তীতে বিভিন্ন অপরাধে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ডাকাতি ও খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। সেনাবাহিনী থেকে অনুপস্থিতির সময় ১৯৭৯ সালে তার প্রথমবার গ্রেপ্তারের সময় তার নামে ৩৬টি মামলা ছিল। দেরিতে বিচার শুরু হওয়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ১৭ বছর বিনা বিচারে হাজতবাস করেন।[৭] ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।[৮] ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর, ডাকাতির জন্য তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় ডাকাতি ও হত্যার জন্য ৩০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য তার মোট ১৮৪ বছরের সাজা হয়েছিল।[২] পরে তিনি আপিল করেন, ফলে তার সাজা ৪২ বছরে কমে আসে। তিনি মোট ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাবন্দি ছিলেন।[৯] যা বাংলাদেশী যেকোন সাজাপ্রাপ্ত আসামির সবচেয়ে বেশি দিন কারাবাস।[৭] কারাগারের মধ্যে ভালো আচরণ এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজা ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন মওকুফ (রেয়াত) করা হয়।[৮][৯] ২০২৩ সালের ১৮ জুন তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান।[২]
জল্লাদ হিসেবে পদার্পণ
সম্পাদনা১৯৮৯ সালে সহকারী জল্লাদ হিসেবে কাজ শুরু করেন।[৭] গফরগাঁওয়ের আসামি নূরুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে তার জল্লাদ হিসেবে প্রথম অভিজ্ঞতা হয়।[২] ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদ বানিয়ে দেয়।[৭] তিনি ১৯৯৭ সালে তিনি প্রধান জল্লাদ হিসেবে ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসানকে প্রথম মতো ফাঁসি কার্যকর করেন।[৭][১০]
জল্লাদ হিসেবে ভূমিকা
সম্পাদনাকারাগারের নথি অনুযায়ী, শাহজাহান ভূঁইয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় ঘাতক— বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মাজেদ–সহ আরও অনেকের ফাঁসি কার্যকর করেন; এদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাসেম আলী।[১১] তিনি ১৯৮৮ সালে সহকারী জল্লাদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমিন হত্যা মামলার আসামি মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, ২০০৪ সালে এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানিসহ আরও ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেন।[১২] তিনি নতুন জল্লাদদের প্রশিক্ষণ দিতেন।[৭]
শাহজাহান ভূঁইয়ার দাবি অনুযায়ী, তিনি ৬০ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছিলেন।[১৩] ২০১২ সালের মধ্যে তিনি ৩২টি ফাঁসির রায় কার্যকর করেন।[৭] কারা বিধি অনুসারে প্রতি ফাঁসি কার্যকরের জন্য জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়,[৭] বাংলাদেশে ১০ বছরের বেশি কারাদণ্ড রেয়াত করা হয়না।[২] ১০ বছর রেয়াতের জন্য কারানথিতে তাকে মোট ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে এটিও বাংলাদেশে একজন জল্লাদের জন্য সর্বোচ্চসংখ্যক ফাঁসি কার্যকরের রেকর্ড।[২]
পরবর্তী জীবন
সম্পাদনাকারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, ৬৬ বছর বয়সী শাহজাহান ভুঁইয়া ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকায় একটি চায়ের দোকান চালু করেন।[১২] ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর শাহজাহান ভুঁইয়া ২৩ বছর বয়সী সাথি আক্তারকে বিয়ে করেন। তবে বিয়ের ৫৩ দিনের মধ্যেই সাথি আক্তার তার সংসার ত্যাগ করেন এবং শাহজাহানের বিরুদ্ধে আদালতে যৌতুকের মামলা দায়ের করেন।[৪]
শাহজাহান তার কারাগারে কাটানো দিনগুলো নিয়ে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। ২০২৪ সালে অমর একুশের বইমেলায় কিংবদন্তী পাবলিকেশন কেমন ছিল জল্লাদ জীবন শিরোনামে তার আত্মজীবনী প্রকাশ করে।।[২]
মৃত্যু
সম্পাদনা২০২৪ সালের ২৩ জুন দিবাগত রাত ৩টার দিকে শাহজাহান ভূঁইয়ার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ২৪ জুন ভোর সাড়ে ৫টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[৩][১৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "কে এই জল্লাদ শাহজাহান?"। একাত্তর টিভি। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ রহমান, আশীষ উর (২০২৪-০৬-২৬)। "জল্লাদ শাহজাহানের বয়ানে জেলজীবনের অজানা কাহিনি"। দৈনিক প্রথম আলো। ২০২৪-০৮-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৭।
- ↑ ক খ "যেভাবে মৃত্যু হলো জল্লাদ শাহজাহানের"। যুগান্তর। ২০২৪-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৭।
- ↑ ক খ আসাদুজ্জামান (২০২৪-০৪-০১)। "৩২ বছর কারাবাসের পর মুক্ত শাহজাহান বিয়ে করে আবার মামলায়"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-০৩।
- ↑ "জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৮-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৭।
- ↑ "মারা গেছেন সেই 'জল্লাদ' শাহজাহান"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২৪-০৬-২৪। ২০২৪-০৮-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ সোহেল, এম. মিজানুর রহমান (২০১২-০৩-২০)। "পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি জল্লাদ শাহজাহানের প্রথম সাক্ষাতকার নিলাম আমি"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০২-০১।
- ↑ ক খ গ "তৃতীয় জীবনে 'জল্লাদ' শাহজাহান, দিন কাটছে চা বেচে"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২৪-০১-২৭। ২০২৪-০৮-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৭।
- ↑ ক খ "সাড়ে ৩১ বছর পর মুক্তি পেলেন 'জল্লাদ' শাহজাহান"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২৩-০৬-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৬।
- ↑ "তৃতীয় জীবনে 'জল্লাদ' শাহজাহান, দিন কাটছে চা বেচে"। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২৪-০১-২৭। ২০২৪-০৮-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮।
- ↑ "বিয়ে করে সর্বস্বান্ত হওয়া জল্লাদ শাহজাহানের গল্প"। Barta24 (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৬-২৪। ২০২৪-০৮-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮।
- ↑ ক খ "৬০ ফাঁসির জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া: ৪৪ বছর কারাভোগের পর জীবন যেমন যাচ্ছে"। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। ২০২৩-১০-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮।
- ↑ প্রতিবেদক,প্রতিনিধি, নিজস্ব (২০২৩-০৬-১৮)। "২৬ ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদ শাহজাহান মুক্তি পেলেন"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৬।
- ↑ "জল্লাদ শাহজাহান মারা গেছেন"। দৈনিক কালবেলা। ২০২৪-০৬-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮।