শরৎচন্দ্র মিত্র (১৫ নভেম্বর ১৮৬৩ ― ১৫ ডিসেম্বর ১৯৩৮) ছিলেন একজন বাঙালি  লোককথাবিদ এবং পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। ভারতে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ। আইন চর্চায় প্রশিক্ষিত হলেও পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ববিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

শরৎচন্দ্র মিত্রের পূর্বপুরুষ রামমোহন মিত্র তৎকালীন হুগলি নদীর পাশ্ববর্তী সুতানুটি অঞ্চলে বসবাস করতেন। মারাঠা বর্গিদের সম্ভাব্য আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে তার পূর্বপুরুষেরা  অধুনা কলকাতার বড়িশায় চলে আসেন। শরৎচন্দ্রের জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর বড়িশায়। আইনজ্ঞ পিতা নরসিংহচন্দ্র মিত্র ছিলেন তৎকালীন হাথওয়া রাজের আইনি উপদেষ্টা এবং মাতা নিস্তারিনী দেবী। শরৎচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অমূল্যচন্দ্র অল্প বয়সে মারা যান এবং ভগিনী সায়লাবালার বিবাহ হয় সিমলার পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর সাথে ।[১]

শরৎচন্দ্র ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমিতে পড়াশোনার পর কলকাতার সিটি স্কুল থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন হতে ইংরাজীতে অনার্স সহ বি.এ.পাশ করেন ও স্কলারশিপ পান। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজীতে এম. এ পাশ করেন। এরপর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে আইনবিদ্যায় স্নাতক তথা বি.এল হন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি পিতার পরামর্শে ছাপরা বারে যোগ দেন এবং ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। এইসময়ের মধ্যে অবশ্য তিনি বিচারবিভাগীয় পরিষেবায় গেজেটেড অফিসার হওয়ার প্রচেষ্টায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি হাথওয়া রাজে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি  হতে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত জরিপ ও বন্দোবস্ত অধীক্ষক হিসাবে কাজ করেন। তবে  কোর্ট অব ওয়ার্ডস বাতিল করা হলে,তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ছাপড়া বারে ফিরে আসেন, যেখানে তার পিতা কর্মরত ছিলেন। তার পিতা ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুলাই মারা যাওয়ার পরও শরৎচন্দ্র ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর তিনি হাথওয়া রাজের মহারাণীর সহকারী ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ শুরু হলে তিনিই প্রথম অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হন।[২] শারীরিক অসুস্থতা ও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণতার কারণে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। সেইপদে স্বল্প সময়ের জন্য যোগদেন হারভার্ডে প্রশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃবিজ্ঞানী বিরজাশঙ্কর গুহ।.[১]

রচনাবলী সম্পাদনা

লোককথা, ভ্রমণ, ইতিহাস, জীবনী এবং নৃতত্ত্ব বিষয়ে শরৎচন্দ্রের আগ্রহ ছিল অসীম। তিনি ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ জনপরিসংখ্যানবিদ হারবার্ট হোপ রিসলের তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া ভারতীয় নৃতত্ত্ব জরিপ এবং জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের নেতৃত্বে ভারতীয় ভাষা সর্বেক্ষণ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি নৃতত্ত্ব বিষয়ে বহু নিবন্ধ রচনা করেছেন, তন্মধ্যে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বোম্বাই ভিত্তিক 'ইষ্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট' পত্রিকায় প্রকাশিত দ্য লেজেন্ডস অব বুদ্ধ ইন ইন্দো-হেলেনিস্টিক আর্ট নিবন্ধটি অ্যাবারডিনের ইভনিং গেজেটের পর্যালোচনায় প্রশংসিত হয়েছিল । তিনি উত্তর বিহারে কর্মজীবনের সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় স্থানীয় মানুষ জনজাতি সম্পর্কে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলির উপর - বোম্বাইয়ের নৃবিজ্ঞানের জার্নালে ১৮৩ টি, মিথিক সোসাইটির ত্রৈমাসিক জার্নালে ৯৭টি, কলকাতার ন্যাশনাল ম্যাগাজিনে ৩৭টি, রাঁচির 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া'তে ৩৪ টি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এবং হিন্দুস্তান রিভিউ জার্নালে ২১ টি করে। এছাড়াও তার বিভিন্ন সময়ের লেখা দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি 'ক্যালকাটা রিভিয়ু'-এ নিজের ইংরাজী নামের আদ্যক্ষর 'এসসিএম' (SCM) বা "Aescyem" ছদ্মনাম হিসাবে ব্যবহার করতেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বোম্বাই এর নৃবিজ্ঞান সোসাইটির  সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সোসাইটি শরৎচন্দ্রের সংগৃহীত রচনাগুলিকে পুস্তকাকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। [১] ২০২১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের উদ্যোগে অধ্যাপক শরৎচন্দ্র মিত্রের বাংলায় লেখা কিছু নিবন্ধ ও জীবনীর সংকলন ― "পথিকৃৎ নৃতত্ত্ববিদ্ শরৎচন্দ্র মিত্র", ড.শতাব্দী দাশ ও দীপক কুমার দাঁ'র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।  

তিনি বিদ্যালয়ে বহিরঙ্গন প্রাকৃতিক ইতিহাস শিক্ষার প্রবর্তকও ছিলেন। [৩]

শরৎচন্দ্র তার রচনায় লোককথার মধ্যে লোকজ ছড়া, গল্প, ধাঁধা এবং বিশ্বাস ইত্যাদির অবতারণা করেছেন এবং এর পাশাপাশি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ঘিরে পৌরাণিক কথা-কাহিনী উপর নির্ভর করে বিষয়বস্তুকে শিক্ষামূলক এবং ইটিওলজিকাল পুরাণ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন । [১]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

শরৎচন্দ্র মিত্র গয়া জেলার অধস্তন বিচারক দীনেশচন্দ্র রায়ের কন্যা সরসীবালা রায়কে বিবাহ করেন। তাঁদের ছিল তিনটি সন্তান। [১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Gupta, Sankar Sen (১৯৬৫)। Folklorists of Bengal. Life-sketches and Bibliographical Notes। Indian Publications। পৃষ্ঠা 53–88।  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "folk" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  2. Iyer, L. K. Anantakrishna (১৯৩৪)। "Recent Advances in Anthropology, Ethnology and Ethnography in India": 236–238। 
  3. Mitra, S.C. (১৯১১)। "A plea for nature-study in Indian Schools": 48-64।