শখের হাঁড়ি

বাংলার সুপ্রাচীন মৃতশিল্প

শখের হাঁড়ি বলতে বোঝানো হয় চিত্রিত মৃৎপাত্র। আকার-আকৃতির দিক থেকে সাধারণ হাঁড়ির মতো হলেও এর গায়ে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে দৃষ্টি নন্দন চিত্র আঁকা হয়।[১][২] বাঙালি লোকজ এবং সামাজিক উৎসব-পার্বণে ব্যবহার হয় এই পাত্রটি। শৌখিন কাজে ব্যবহৃত হয়, তাই এর নাম শখের হাঁড়ি।[২]

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প শখের হাঁড়ি

ইতিহাস সম্পাদনা

হরপ্পা মোহেঞ্জোদারোর সভ্যতার নিদর্শন হিসাবে ধূসর রঙিন মৃৎপাত্র পাওয়া যায় যা একপ্রকার শখের হাঁড়িই।[৩] ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের ভ্রমণসাহিত্যে প্রথম এই শখের হাঁড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।[১]

রকমারি শখের হাঁড়ি সম্পাদনা

লাল,নীল,হলুদ সবুজ রঙ করা এসব হাঁড়িতে ফুল, পাতা, পদ্মফুল, মাছ, প্রজাপতি, পানপাতার নকশা এবং সহযোগী সরাতে নকশা আকা হয়। গড়ন ও ব্যবহার ভেদে যেমন মঙ্গল হাঁড়ি, সাপুড়ে হাঁড়ি, বালির হাঁড়ি, ঝরা হাঁড়ি, ফুল হাঁড়ি, জাগরণ হাঁড়ি, গর্ভ হাঁড়ি, আইবুড়ো হাঁড়ি, বাকু হাঁড়ি ইত্যাদি হাঁড়ির রকমফের রয়েছে।[৪]

অঞ্চলভেদে নকশার ভিন্নতা দেখা যায়। রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায় তৈরিকৃত হাঁড়িতে হলদে জমিনের ওপর লাল, নীল, সবুজ ও কালো রঙে আঁকা হয় হাতি, ঘোড়া, মাছ, শাপলা, পদ্ম, দলদাম, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, পেঁচা, কবুতর ইত্যাদি। নওগাঁর বাঙ্গালপাড়ার তাদের হাঁড়িগুতে লাল রঙের ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, চিরুনি, পাখি, পদ্মফুল। [১] রাজশাহীর পবা থানার বসন্তপুরের হাঁড়িগুলোতে হাতি, ঘোড়া, পাখি, মাছ, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নকশী লতাপাতা, শাপলাফুল, প্যাঁচা, কবুতর, চড়ুই পাখি ইত্যাদির প্রাধান্য থাকে। আবার গোয়ালন্দের হাঁড়িগুলোতে নকশী লতাপাতা, ফুল এর প্রাধান্য থাকে। রাজশাহীতে লাল রঙের, ঢাকা, কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে হলুদ রঙের, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুরের হাঁড়িতে লাল রঙের প্রাধান্য বেশি থাকে। পাবনা, রাজশাহী, যশোর, রংপুর এবং ময়মনসিংহ জেলারশিল্পীদের চিত্রণ বেশি উন্নত ও সমাদৃত। [৪]

রঙ সম্পাদনা

অতীতে যখন আধুনিক রঙ ছিলনা তখন আতপ চালের গুঁড়ার তৈরি সাদা রঙ, চুলার কালো কয়লা, হাঁড়ি-পাতিলের নিচের কালো রঙ, লাল ইটের রঙ এবং সিঁদুর রঙ ব্যবহৃত হত। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জিগা গাছের আঠা, বহেরা ফলের আঠা ব্যবহার করা হত রঙের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও চকচকে করে তোলার জন্য। [৪]

ব্যবহার সম্পাদনা

উত্‍সব, পালা-পার্বণ-পূজাতে গ্রামীণ মেলাগুলোতে শখের হাঁড়ির পসরা দেখা যায়। বিয়ে ও আচার-অনুষ্ঠানে মিষ্টি, পিঠাসহ শখের হাঁড়ি আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে উপহার হিসাবে পাঠানো হয়।[২] গর্ভবতী নারীকে স্বাদভক্ষণের জন্য পাঠানো সাত ধরনের মাছ, সাত ধরনের ফল, সাত ধরনের মিষ্টি সহ নানা জিনিস শখের হাড়িতে করে পাঠানো হয়।[৪] চাঁপাইনবাবগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময়ও প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় শখের হাঁড়ি দেয়ার রেওয়াজ ছিল। একে শখের চুকাই ও ঝাঁপিও বলা হয়।[১]

প্রাপ্তিস্থান সম্পাদনা

বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া গেলেও রাজশাহীর সিন্দুরকুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম এবং বসন্তপুর, চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, ঝিানাইগাতি থানা, ঢাকার নয়ারহাট, কুমিল্লা, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরের কোয়েলজুড়ি ও হাসরা, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, জামালপুরের বজরাপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানার ইদ্রিলপুর, ময়মনসিংহের বাঙ্গাসুর ইত্যাদি স্থান উল্লেখযোগ্য।[৪] রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঙ্গালপাড়া, নাটোর সদরের পালপাড়া, গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরেও এসব হাঁড়ি তৈরি ও বাজারজাত করা হয়।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "প্রাচীনতম লোকশিল্পের অনুষঙ্গ চিত্রিত শখের হাঁড়ি"dailyjanakantha.com। দৈনিক জনকণ্ঠ। এপ্রিল ৬, ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২২ জানুয়ারি ২০১৯ 
  2. "শখের হাঁড়ি"bd-pratidin.com। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। জানুয়ারি ১১, ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ 
  3. "রাজশাহীর শখের হাঁড়ি: ইতিহাস ও বিবর্তন"kanakpkfolk.info। ২০১৯-০১-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-২৩ 
  4. "বিচিত্র চিত্রিত শখের হাঁড়ি"priyo.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-২৩ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]