লালসালু (উপন্যাস)

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ১৯৪৮ সালের উপন্যাস

লালসালু বাঙালি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত অভিষেক উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে রচিত এবং প্রকাশিত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচিত। এর পটভূমি ১৯৪০ কিংবা ১৯৫০ দশকের বাংলাদেশের গ্রামসমাজ হলেও এর প্রভাব বা বিস্তার কালোত্তীর্ণ। ধর্মভীরু গ্রামীণ মুসলিম সমাজে সাধারণ মানুষের সরলতাকে কেন্দ্র করে এক কল্পিত মাজারকে পুঁজি করে চতুর ধর্মব্যবসায়ী কীভাবে প্রতিষ্ঠা পায়, ধর্মকে ব্যবসার উপাদানরূপে ব্যবহার করে কিভাবে স্বার্থহাসিল করে তাই চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে।

লালসালু
বইয়ের প্রচ্ছদ
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ, ১৯৪৮
লেখকসৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
অনুবাদক
  • উর্দু - কলিমুল্লাহ
  • ফরাসি - অ্যান-মারি-থিবো
  • ইংরেজি - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
দেশপূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ)
ভাষাবাংলা
বিষয়পীর, সমাজ, ধর্ম
ধরনমনস্তাত্বিক উপন্যাস
প্রকাশককমরেড পাবলিশার্স
প্রকাশনার তারিখ
১৯৪৮
ইংরেজিতে প্রকাশিত
১৯৬৭
মিডিয়া ধরনছাপা (শক্তমলাট)
পৃষ্ঠাসংখ্যা১১০
পুরস্কারবাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১)
ওসিএলসি২৪৩০০৬২
এলসি শ্রেণীPK1729.W33 L3 1962

ওয়ালীউল্লাহ এই উপন্যাসের জন্যে ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।[১] উপন্যাসটি উর্দু, ফরাসি, ইংরেজি, জার্মানচেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

প্রকাশনা সম্পাদনা

ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারা প্রকাশের তিন বছরের মাথায়, ১৯৪৮ সালে লালসালু প্রকাশিত হয় ঢাকার কমরেড পাবলিশার্স থেকে। ১৯৬০ সালে কথাবিতান প্রকাশনী বের করে দ্বিতীয় সংস্করণ। পরে নওরোজ কিতাবিস্তান ১৯৬৩ সালে এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে কলকাতর চিরায়ত প্রকাশন থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছিল।[২] ২০০৬ সালে নওরোজ কিতাবিস্তান[৩], বিশ্বসাহিত্য ভবন,[৪] এবং ২০১২ সালে অ্যাডর্ন পাবলিকেশন এটি প্রকাশ করেছে।

পটভূমি সম্পাদনা

লালসালু মূলত একটি সামাজিক উপন্যাস। যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় ভীতি এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। মজিদ নামে এক স্বার্থান্বেষী, ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী গড়ে উঠেছে। স্বার্থান্বেষণে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অবশেষে সে মহব্বতনগর গ্রামে ঘাঁটি গাড়ে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে। সেই গ্রামের বাঁশঝাড়সংলগ্ন ছিল একটি পরিচয়বিহীন কবর‌। এরপর মজিদ প্রচার করতে শুরু করে কবরটি ‘মোদাচ্ছের’ (নাম না জানা) পীরের এবং স্বপ্নাদেশে মাজারের তদারকির জন্যই এ গ্রামে তার আগমন ঘটেছে। গ্রামবাসী তার স্বপ্নের বিবরণ শুনে ভীত হয় এবং একইসাথে বিশ্বাস করে। তারা কবরটি দ্রুত পরিষ্কার করে লালসালুতে ঢেকে সেটিকে একটি পীরের মাজারে পরিণত করে। আর মজিদ হয়ে উঠে মাজেরের খাদেম। এভাবে মজিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে মাজারটি। অল্পদিনের মধ্যেই মজিদ সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠে। ধর্মকর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে প্রচারের মাধ্যমে গ্রামের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন।

সাহিত্য-সমালোচনা সম্পাদনা

কবি আহসান হাবীব লালসালুকে বলেছিলেন তৎকালীন "বাঙালি মুসলিম রচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস"।[৫]

অনুবাদ সম্পাদনা

১৯৬০ সালে পাকিস্তান লেখক সংঘ কর্তৃক করাচি থেকে Lal Shalu নামে উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয়।[১] অনুবাদ করেছিলেন কলিমুল্লাহ। একই বছর প্যারিস থেকে এর ফরাসি অনুবাদ বের হয়।[১] লাহব সঁ হাসিনস (L Arbre sans racines) শিরোনমে ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল Editions du Seuil প্রকাশনী থেকে। এটি অনুবাদ করেছিলেন ওয়ালীউল্লাহর সহধর্মিণী অ্যান-মারি-থিবো।[৬] লালসালু উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেন অ্যান-মারি-থিবো, জেফ্রি ডিবিয়ান, কায়সার সাঈদ এবং মালিক খৈয়াম। তবে ওয়ালীউল্লাহ নিজে এতে সম্প্রসারণের কাজ করেন।[৭] ১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের Chatto অ্যান্ড Windus লিমিটেড থেকে ট্রি উইদাউট রুটস (Tree Without Roots) শিরোনামে প্রকাশিত হয়।[৮] পরবর্তীতে উপন্যাসটি আরবি, জার্মান, চেক, ইন্দোনেশীয়, জাপানী ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।[১]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা

২০০১ সালে তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় উপন্যাসটি চলচ্চিত্ররূপ লাভ করে। এতে মজিদ চরিত্রে অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ[৯] ২০০১ সালে চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সহ আটটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।[১০] পাশাপাশি দর্শকদের বিচারে এটি শ্রেষ্ঠ ১০টি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান পেয়েছে।[১১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. নুরুল আমিন (২০১২)। "লালসালু"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. সৈয়দ, ওয়ালিউল্লাহ (১৯৮৯)। লালসালুকলকাতা: চিরায়ত। আইএসবিএন 9788185696157ওসিএলসি 769534573। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০২১ 
  3. ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ (২০০৬)। লালসালুঢাকা: নওরোজ কিতাবিস্তান। আইএসবিএন 9844000165। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০২১ 
  4. ওয়ালীউল্লাহ্‌, সৈয়দ (২০০৬)। লালসালুঢাকা: বিশ্বসাহিত্য ভবন। আইএসবিএন 98483091638 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: length (সাহায্য) 
  5. হাবীব, আহসান। "লালসালু"। আহসান হাবীব রচনাবলী (প্রবন্ধ)। 
  6. অ্যান-মারি-, থিবো (১৯৬৩)। L Arbre sans racines (ফরাসি ভাষায়)। প্যারিস: Éditions du Seuil। ওসিএলসি 14939959। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০২১ 
  7. আখতার ২০০১, পৃ. ১০।
  8. সাঈদ, কায়সার (১৯৬৭)। Tree Without Roots (ইংরেজি ভাষায়)। লন্ডন: Chatto & Windus। ওসিএলসি 2430062। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০২১ 
  9. "Lalsalu hits cinema halls"The Daily Star। জুন ২৮, ২০০৩। মার্চ ১৫, ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৪, ২০১৬ 
  10. Rashed Shawon (আগস্ট ১৪, ২০১২)। "চার দশকে আমাদের সেরা চলচ্চিত্রগুলো"bdnews24.com। জানুয়ারি ২৭, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৪, ২০১৬ 
  11. "ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট"। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জানুয়ারি ২০১৭ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • অ্যান-মারি-থিবো (২০১০) [2006]। আমার স্বামী ওয়ালীউল্লাহ। ঢাকা: প্রথমা প্রকাশনী। 
  • আখতার, সৌদা (২০০১)। সৈয়দ ওয়ালীল্লাহর লালসালু ও অন্যান্য প্রবন্ধ। ঢাকা: বাংলা একাডেমীআইএসবিএন 984-07-4198-5 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা