লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী

লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী (জন্ম: জানুয়ারি ১১, ১৮৬৬ - মৃত্যু: নভেম্বর ৮, ১৯৩৩) ভারত উপমহাদেশের প্রথম পেশাদার আলোকচিত্রী-চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তিনি ১৮৬৬ সালে লাহোর শহরে রায়চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি - ফোটোগ্রাফার্স অ্যাণ্ড আর্টিস্টস নামে একটি সংস্হা স্হাপন করেন যা বর্তমানে তার তৃতীয় পুত্র রঞ্জিত রায়চৌধুরীর পৌত্র হৃদয়েশ রায়চৌধুরী কর্তৃক ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা শহরে অবস্হিত।

লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী
লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর আলোকচিত্র
লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, ১৯২৯ সালে
জন্ম
লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী

(১৮৬৬-০১-১১)১১ জানুয়ারি ১৮৬৬
ভারত
মৃত্যু৮ নভেম্বর ১৯৩৩(1933-11-08) (বয়স ৬৭)
সমাধিভারত
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বভারতীয়
পেশাআলোকচিত্রী
দাম্পত্য সঙ্গীঅপূর্বময়ীর
সন্তান
  • প্রমোদ
  • সুশীল
  • রঞ্জিত
  • অনিল
  • সুনীল
  • বিশ্বনাথ
  • কমলা
পিতা-মাতা
  • যদুনাথ
  • মাতঙ্গিনী
আত্মীয়
  • হরিনারায়ণ (ভাই)
  • বৈকুন্ঠনারায়ণ (ভাই)

লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর জন্ম ১১ই জানুয়ারি ১৮৬৬ সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের উত্তরপাড়া কোতরং শাখায় রত্নেশ্বর রায়চৌধুরীর পরিবারে। তার বাবা যদুনাথ এবং মা মাতঙ্গিনী। যদুনাথের তিন পুত্রের তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ । তার ভ্রাতাদ্বয়ের নাম হরিনারায়ণ এবং বৈকুন্ঠনারায়ণ। সাবর্ণ রায়চৌধুরীগণ ব্রাহ্মণ; রায়চৌধুরী পদবি তারা পেয়েছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর কর্তৃক। ১৬৯৮ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরীরদের নিকট হতে কলকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুরের ইজারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করার পর পরিবারটির আর্থিক অবস্হা খারাপ হয়ে যায়। সম্রাট কর্তৃক প্রদত্ত স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা খরচ হয়ে যাবার পর অষ্টদশ শতক থেকে পরিবারের সস্যগণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জীবিকা সন্ধানের জন্য ছড়িয়ে পড়েন। তার পিতা ষোলো বছর বয়সে লক্ষ্মীনারাণের বিবাহ তেরো বছর বয়সী কলকাতার পটুয়াটুলি নিবাসী মুখোপাধ্যায় পরিবারের অপূর্বময়ীর সঙ্গে দেবার পর লক্ষ্মীনারায়ণ কলকাতার তদানীন্তন বুদ্ধজীবী সমাজের সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ছবি আঁকতে শেখেন। প্রখ্যাত লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অপূর্বময়ীর জেঠামশায়ের ছেলে। পিতার সংসারে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে লক্ষ্মীনারায়ণের আত্মসম্মানে লাগছিল বলে তিনি ছবি আঁকার মাধ্যমে রোজগারের প্রয়াস করতে থাকেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কর্মজীবন

সম্পাদনা

ব্যবসায়িক কার্যব্যপদেশে সে সময়ে বাহওয়ালপুরের (বর্তমানে পাকিস্তানের অনতর্গত) আমিরের প্রতিনিধি কলকাতায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন এবং তার সঙ্গে লক্ষ্মীনারায়ণের পরিচয়ের সুযোগ হয়। আমিরের প্রতিনিধি লক্ষ্মীনারায়ণের অঙ্কণপ্রতিভায় মুগ্ধ হন এবং তাকে বাহাওলপুর রাজ্যে রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য স্সত্রীক অতিথিরূপে যাবার আমন্ত্রণ জানান। লক্ষ্মীনারায়ণ ছয় মাস পর বাহাওলপুর পৌঁছান; আমির তার আঁকা প্রতিকৃতি দেখে লক্ষ্মীনারায়ণেকে প্রশংসাপত্র দেন যাতে তিনি চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ইত্যাদি রাজপরিবারের গিয়েও ছবি এঁকে রোজগার করতে পারেন। লক্ষ্মীনারায়ণের পৌত্র মলয় রায়চৌধুরীর আত্মজীবনী অনুযায়ী বাহাওলপুরের দুটি ডাকটিকিটের ড্রইং লক্ষ্মীনারায়ণের তৈরি। রাজপরিবারের সদস্যদের মুখাকৃতি আঁকার সূত্রে লক্ষ্মীনারায়ণ আফাগানিস্তানের রাজপরিষদের সদস্যদের ছবি আঁকার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজদরবারের পরিভ্রমণকালে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হন এবং লক্ষ্মীনারায়ণ লাহোর শহরে কিছিদিনের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা মন্স্হ করেন। লাহোর শহরে কর্মানুসন্ধানকালে তিনি তদানীন্তন মেয়ো কলেজ অফ আর্টসের (বর্তমানে পাকিস্তানের ন্যাশানাল কলেজ অফ আর্টস) অধ্যক্ষ জন লকউড কিপলিংয়ের স্টুডিওয় কর্মচারীর চাকুরি পান। জন লকউড কিপলিং পরে লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

জন লকউড কিপলিংয়ের নিকট কর্মসূত্রে লক্ষ্মীনারায়ণ পরিচিত হন নতুন উদ্ভাবিত ফোটো তোলার ক্যামেরার সঙ্গে। ১৮৩০ সালে লুই ড্যাগোরো ক্যামরা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেটিতে একবারে কেবল একটিই ফোটো তোলা যেত। ১৮৪১ সালে ফক্স ট্যালবট আবিষ্কার করেন ক্যালোটাইপ প্রক্রিয়া। ক্যালোটাইপের মাধ্যমে একাধিক ফোটো প্রিন্ট করা সম্ভব হয়। ১৮৮০ নাগাদ ভারতে জিলেটিন প্রক্রিয়ার আগমন ঘটে, প্রধানত ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফারদের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় কোলোডিয়ান প্রক্রিয়ার পরিবর্তে জিলেটিনের শুষ্ক প্লেট ব্যবহার করা হতো— কাচের প্লেটের উপর লাগানো সিলভার হ্যালিডেসের ফোটোর রসায়ন। নূতন বেলোলেন্স ক্যামেরার আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। ফোটোগ্রাফির জন্য ডার্করুমের প্রয়োজন অনুভূত হল। লক্ষ্মীনারায়ণ একটি বেলোলেন্স ক্যামরা কিনে ১৮৮৬ সালে লাহোরে ব্যবসার সূত্রপাত করলেন। বাড়িতে একটি ছোটো ঘরকে ডার্করুম হিসাবে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়িক সংস্হার নাম রাখলেন রায়চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি - ফোটোগ্রাফার্স অ্যাণ্ড আর্টিস্টস [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ইতোপূর্বে মুখাকৃতি এঁকে তা থেকে তিনি তৈলচিত্র তৈরি করতেন। রাজপরিবারের সদস্যদের বেশ কিয়ৎক্ষণ তার সামনে বসে থাকতে হতো এবং সেকারণে তারা বিরক্ত হতেন। পর্দাপ্রথার কারণে রাজপরিবারগুলিতে মহিলাসদস্যদের তৈলচিত্র আঁকতে লক্ষ্মীনারায়ণের অসুবিধা হতো। ক্যামেরা কেনার পর আর তার সামনে বসে থাকার সমস্যা রইল না। অন্যান্য ধনীদের ফোটোতোলারও সুযোগ পেলেন তিনি। প্রথম সন্তান প্রমোদের পর লাহোরে সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল, বিশ্বনাথ এবং একমাত্র কন্যাসন্তান কমলার জন্ম হয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফোটো তোলার আমন্ত্রণ পেলে সেই সমস্ত মহারাজা, রাজা, রাজে, দেশমুখ, নবাব, বেগ, খান প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলতে যেতেন। প্রতিবার দুর্গাপুজায় দেশের বাড়ি উত্তরপাড়ায় গিয়ে ছেলেদের একে একে বিয়ে দিতেন। তার পিতা যদুনাথ তার সম্পত্তি তিন সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া মনস্হ করলে লাহোরের সংস্হা গুটিয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ উত্তরপাড়ায় সংস্হাটিকে নিয়ে যান। দ্বারভাঙ্গা মহারাজার আমন্ত্রণে লক্ষ্মীনারায়ণ অনিলের ওপর উত্তরপাড়ার ভার দিয়ে প্রমোদ, সুশীল ও রঞ্জিতকে নিয়ে পাটনা চলে যান।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

মৃত্যু

সম্পাদনা

পাটনা শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ ৮ই নভেম্বর ১৯৩৩ সালে মারা যান। তার মৃত্যুতে পরিবারটি দিশাহারা হয়ে যায়, কেননা ব্যবসায়ের জন্য যোগাযোগ পদ্ধতি ও বৈভবশালী ক্রেতাদের সঙ্গে আদান-প্রদানের কৌশল তখনও তার পুত্ররা রপ্ত করতে পারেনি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তারা একটি চালাবাড়ি ভাড়া নিয়ে অপূর্বময়ী এবং ভাইদের ও বোনকে পাটনায় নিয়ে আসেন। অপূর্বময়ীর জেঠতুতো ভাই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে প্রমোদ পাটনা মিউজিয়ামে 'কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কল্পচার'-এর চাকুরি পান। সুশীল স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ বিহারের ছাপরায় একটি শাখা খুলেছিলেন, কিন্তু চালাতে না পেরে ফিরে যান পাটনায়। অনিলও পাটনায় ফিরে যান। রঞ্জিত তখন পাটনায় একটি স্টুডিও স্হাপন করেন। সুশীল ও অনিলের ওপর ফোটো থেকে তৈলচিত্র তৈরির কাজ বর্তায়। লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্রদের মৃত্যু হয়েছে; তার প্রতিষ্ঠিত একজন ভারতীয়ের প্রথম প্রতিষ্ঠিত স্টুডিওটি সময়ের সঙ্গে তাল রেখে প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  • মলয় রায়চৌধুরী, 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা', চর্চাপদ প্রকাশনী, ১৩ বি রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা ৭০০ ০১২ । আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮০৪৮৯-০০-১
  • ভবানী রায়চৌধুরী । 'বঙ্গীয় সাবর্ণকথা - কালীক্ষেত্র কলিকাতা' । মান্না পাবলিকেশান, কলকাতা। আইএসবিএন ৮১-৮৭৬৪৮-৩৬-৮
  • পূর্ণেন্দু পত্রী । 'পুরানো কলকাতার কথাচিত্র' । দেজ পাবলিশিং। ১৯৯৫ । কলকাতা । আইএসবিএন ৮১-৭০৭৯-৭৫১-৯
  • দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় । 'পুরানো কলকাতার ঘরবাড়ি' । আনন্দ । ২০০২ । কলকাতা। আইএসবিএন ৮১-৭৭৫৬-১৫৮-৮
  • Atul Krishna Roy. 'A Chapter in Social History of Bengal.' Sabarna Roychoudhury Paribar Parishad, Kolkata. 1928.
  • অমরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । 'বংশ পরিচয়' । চৌধুরীপাড়া স্ট্রিট । ১৯১১ । উত্তরপাড়া ।
  • Malay Roy Choudhury. Contemporary Authors Autobiography Series No 14. Farmington, Ohio, USA. 1980.
  • সমীর রায়চৌধুরী, 'অপূর্বময়ী স্মৃতি পাঠাগার । কবিতা ক্যাম্পাস, ৪৮/২ ভৈরব দত্ত লেন, সালকিয়া, হাওড়া ৭১১১০৬ । ২০১১

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা