স্বাধীন ত্রিপুরার ইতিহাসে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মা বাহাদুরের রাজত্বকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৪৩ সালের রিয়াং বিদ্রোহ। রতনমনির নেতৃত্বে সংঘটিত এই বিদ্রোহ ছিল তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ধুম্রজাল থেকে সাধারণ প্রজা রিয়াং জনগোষ্ঠীর মুক্তির আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্যই ছিল সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটানো। মূলত সমাজপতি ও ঠকবাজ ব্রাহ্মণদের অত্যচার নিপীড়ন ও শোষণের হাত থেকে সাধারণ রিয়াং প্রজাদেরকে রক্ষা করার জন্য রতনমনি রোয়াজা সাধু তার শিষ্য খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা (বলংরায়) ও চৈত্রসেন সাধুসহ আরো অনেক সাধু করে সামন্তপ্রথা বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

তৎকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

রিয়াং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৩৬ টি দফার মধ্যে অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম, মনিপুর ও বাংলাদেশে তাদের বসবাস। ‘ককবরক’ ভাষাভাষী এই জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় শোষণ বঞ্চনার শিকার হলেও মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্যের শাসন আমলে প্রথম রিয়াং বিদ্রোহ এবং মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য দেববর্মার শাসনকালে দ্বিতীয় রিয়াং বিদ্রোহ ব্যতীত আর কোন বড় ধরনের বিদ্রোহ রিয়াং সমাজে পরিলক্ষিত হযনি। মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের শাসনকালের প্রথম রিয়াং বিদ্রোহ তার মহীয়সী গুণবতী মহারাণী দেবীর মধ্যস্থতায় অবসান ঘটে। কিন্তু সপ্তদশ শতকের প্রথম রিয়াং বিদ্রোহের দীর্ঘ প্রায় তিনশত বছর পর ত্রিপুরা রাজ্যে রিয়াং সমাজে পুনরায় সমাজপতিদের শোষণের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে দ্বিতীয় রিয়াং বিদ্রোহের উন্মেষ ঘটে। দ্বিতীয় রিয়াং বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যে কারষণগুলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল।

প্রথমত, রিয়াংদের মাঝে ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি ছিল ‘রায়’ । অর্থাৎ রায় হল রিয়াংদের সর্দার বা রাজা। রায়ের অধীনে কতিপয় চৌধুরী থাকতেন। এছছাড়াও রিয়াং সর্দারদের মাঝে কাচক ও কাঞ্চন পদবীও প্রচলিত ছিল। সাধারণত রিয়াং সমাজপতি বা সর্দারগণ এই উপাধি গ্রহণ করতেন। রিয়াং সমাজপতিগণ রাজ আদেশে এই উপাধি গ্রহণ করতেন বলে তারা কিছু ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারীও হয়েছিলেন। সমাজপতিগণ ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী রিয়াং প্রজাদের নিকট থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। এর বিনিময়ে সমাজপতিদের কোন রাজস্ব দিতে হতো না।

রিয়াংদের প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী একজন রায় মৃত্যুবরণ না করলে অন্য কোন রায় নিয়োগ প্রদান করা যায় না। একজন রায় মহারাজার অধীনস্থ একজন সামন্ত প্রভূর মতো ভূমিকা পালন করতেন। ত্রিপুরা রাজ্যের রিয়াং সমাজের সমাজপতি হিসেবে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত চৌধুরী দেবী সিং ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক প্রদত্ত ‘রায়’ উপাধিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু বিলোনিয়া মহকুমার বগাফা অঞ্চল নিবাসী খগেন্দ্র চৌধুরী রিয়াং নামে একজন রিয়াং সমাজপতি তখন বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। ফলে তিনি নানা উপায় অবলম্বন করে চৌধুরী দেবী সিং রিয়াংকে উৎখাত করে মহারাজার দরবার থেকে রায় উপাধি গ্রহণ করেন। অর্থাৎ তিনি রিয়াংদের প্রচলিত রীতিনীতি ভঙ্গ করেন। যা সাধারণ রিয়াং প্রজাগণ খুব সহজে মেনে নিতে পারেন নি। উপরন্তু খগেন্দ্র চৌধুরী রাজ কর্মচারীদের উৎকোচ প্রদান করে রাজ সৈনদের জন্য সংগৃহীত ধান চালের সিংহভাগ নিজের গোলায় মমজুদ করে রাখেন। এ খবর তখন দ্রুত প্রজা সাধারণের কানে চলে যায়।

দ্বিতীয়ত, তদবছরে ১৯৪৩ সালের বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অঞ্চলে ব্যপকভাবে পড়েছিল। তছাড়া জুমচাষে ফসলহানির কারণে প্রজাসাধারণের মাঝে প্রায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তাই সাধু রতন মনি ও তার শিষ্যগণও দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণের মাঝে খাবার বিতরণের জন্য ধর্মগোলা প্রতিষ্ঠা করে ধান চাল সংগ্রহ করেন। তখন খগেন্দ্র চৌধুরী রতন মনি রোয়াজার কার্যকলাপকে প্রতিদ্বন্দ্বি বিবেচনা করে এবং বিভিন্নভাবে রতন মনি সাধুসহ তার শিষ্যদের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা এমনকি রতন মনির শিষ্যদেরকে বিনা দোষে বা সামান্য অপরাধে কঠোর দৈহিক নির্যাতন অথবা সামাজিক জরিমানা করতে থাকে। জরিমানার পরিমাণ ১০ (দশ) টাকা থেকে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা পর্যন্ত ছিল। এইভাবে খগেন্দ্র চৌধুরী ও তার সমর্থক চৌধুরী গণ ২০,০০০ (বিশ হাজার ) টাকা জরিমানা আদায় করে।

তৃতীয়ত, ইতিপূর্বে গঙ্গাপূজা বা বাসী পূজার চাঁদা ছিল ঘরপ্রতি ২ (দুই ) টাকা মাত্র। কিন্তু খগেন্দ্র চৌধুরী রায় নিযুক্ত হওয়ার পর তা বৃদ্ধি করে ৪ (চার) টাকা চাাঁদা আদায় করা শুরু করেন। ‘ঘরচুক্তি’ কর আদায়ের জন্য রিয়াং সর্দারদের উপর রাজার নির্দেশ ছিল। তার উপর রাজ কর্মচারীদের শোষণ এবং অত্যচারের ফলে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন সময়ে জুম চাষে ফসল ভাল না হলেও অনাদায়ী কর আদায়ের নামে রাজ কর্মচারীরা প্রজাদের উপর প্রতিনিয়ত জুলুম ও নির্যাতন চালাতো। তাছাড়া ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের প্রভাব ত্রিপুরা রাজ্যেও প্রবল ছিল।

চতুর্থত, তৎকালীন সময়ে সারা বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় বিশ্বযুদ্ধে সৈন দিয়ে সহযোগীতা করার জন্য মহারাজার নির্দেশে ‘ত্রিপুরা রাজ্যরক্ষী বাহিনী চতুর্দশ দেবতার দল’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বগাফার সৈন্য সংগ্রহের দায়িত্ব খগেন্দ্র চৌধুরীর উপর ন্যস্ত করা হলে বহু যুবককে অনিচ্ছা সত্বেও জোর করে সৈন বিভাগে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয় । যুবকেরা সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনীহা প্রকাশ করলে খগেন্দ্র চৌধুরী রাজ্য রক্ষী বাহিনীতে সৈন বা স্বেচ্ছা সেবক সংগ্রহ করতে না পেরে সাধু রতনমনির প্রভাবকেই এর জন্য দায়ী করেন এবং সেই ভাবেই রাজ্য সরকারে অভিযোগ প্রেরণ করতে থাকেন। শুরু হয় দরিদ্র রিয়াংদের উপর নানা নির্যাতন ।

এমতাবস্থায় রিয়াং প্রজারা নিরুপায় হয়ে আধ্যাত্বিক ধর্মগুরু সাধু রতনমনি রোয়াজার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করলে রতনমনি কয়েকজন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খগেন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য আলোচনায় বসতে অনুরোধ জানান। কিন্তু খগেন্দ্র চৌধুরী কোন প্রকার মীমাংসায় যেতে রাজি হননি বরং বিভিন্ন উপায়ে মহারাজার নিকট রিপোর্ট করেন যে, রতন মনি সাধুর নেতৃত্বে¦ রিয়াং প্রজারা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবে তিনি আক্রমণের নাম নিয়ে মিথ্যে মামলা করলে খুশী কৃষ্ণ ত্রিপুরা, হান্দাই সিং ও কান্ত রায়কে গ্রেফতার করা হয় এবং আগরতলায় ৪৮ দিন আটক রাখা হয়। ব্রজলাল কর্তা তাদের ছেড়ে দেন এবং নিজেরা নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মীমাংসা করার জন্য পরামর্শ দেন। এতে খগেন্দ্র রিয়াং ক্ষুব্ধ হন, কারণ তিনি দেখেছিলেন রতনমনি সাধুর শিষ্য সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রিয়াং দফায় একজন অন্য দফার লোক এসে গুরুর আসনে বসে সুপরামর্শ দিচ্ছে। যা খগেন্দ্র চৌধুরীর অসহ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পঞ্চমত, ডুম্বুর তীর্থ ত্রিপুরা জনগণের অন্যতম প্রধান তীর্থক্ষেত্র । পৌষ সংক্রান্তিতে রিয়াংরা এবং রতন মনি সাধুর শিষ্যগণ সেখানে উপস্থিত থেকে মেলায় অংশগ্রহণ করে। ত্রিপুরাগণ পূণ্য ¯œানের জন্য এ তীর্থে সমবেত হয়ে থাকে। অনেকেই মৃত আত্মীয় স্বজনের পূণ্য অস্থি তীর্থে বিসর্জন দিয়ে থাকে। এ সময় তীর্থস্থানে যাগ-যজ্ঞাদি হয়ে থাকে। সন্ন্যাসি রতন মনি এই তীর্থ স্থানে দেখতে পেয়েছিলেন যে, ব্রহ্মণগণ যাগ-যজ্ঞাদি করার নামে নিরীহ মাননুষের নিকট থেকে অর্থ ও দ্রব্যাদি অন্যায়ভাবে আদায় করছে। ফলে সাধু রতনমনি অন্যায় মাথা পেতে নিতে না পেরে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ব্রাহ্মণদের সাথে বিরোধ বেধে যায়। ফলে তিনি ব্রাহ্মণদের বিরাগভাজন হন এবং ব্রাহ্মণগণ সাধু রতনমনি রিয়াং ও তাঁর শিষ্যদের নামে মহারাজার নিকট বিভিন্ন কুমন্ত্রণা দিলে মহারাজা সাধু রতনমনির প্রতি ক্ষুব্ধ হন।

এরূপ সমাজপতিদের অত্যাচার , ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম, সরকারী কর্মচারী ও থানার দারোগার অত্যাচার, মহাজনের সুদের দাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি সাধারণ রিয়াং প্রজাদের জনজীবনে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হতে দেখলে সাধু রতন মনি ও সাদু খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার সচেতন হৃদয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তখন তারা এই প্রতারক ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম হ্রাস করাসহ রাজ বাহিনীর নির্যাতন থেকে রিয়াং শিষ্যদেরকে মুক্তি দেওয়া তথা তাদের জীবনে শান্তি ও সঠিক পথে ধর্মচর্চার পথ তৈরি করতে শুরু করলেন অহিংস উপায়ে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ। সাধু রতন মণি, সাধু খুসী কৃষ্ণ ও সাধুু চৈত্রসেনের অগণিত শিষ্য এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হলেন।

রতনমনি সাধু সম্পাদনা

রিয়াং বিদ্রোহের নেতা রতনমনি রোয়াজা পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন রামগড় মহকুমা এবং বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার অযোধ্যা নগরস্থ দেওয়ান বাজার এলাকার রামসিরা নামক ত্রিপুরা গ্রামে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নীল কমল রোয়াজা এবং মাতার নাম সিলাই লক্ষী ত্রিপুরা । তাঁর পিতামহের নাম রামদয়াল রোয়াজা । রতনমনি রোয়াজার পিতা ছিলেন গ্রামের একজন অচাইরিউং(ওঝা)। গ্রামবাসীর নিকট তিনি সাধু নামেও পরিচিত। রতনমনিরা চার ভাই চার বোন। পিতার ন্যায় রতন মনি রোয়াজাও একজন শিব সাধক ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা সমাজের বিভিন্ন মাঙ্গলিক পূজা-পার্বন করতেন। একসময় তিনি তান্ত্রিক বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। এভাবে তিনি আধ্যাত্ম্যিক জ্ঞানার্জন করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় চেতনায় জাগ্রত করে তোলেন।

রতনমনি সাধু আনুমানিক ১৯৩২ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অমরপুর অঞ্চলে গিয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর গলায় ছিল রুদ্রাক্ষ ও মালা। তিনি শিষ্যদেরকেও রুদ্রাক্ষ ধারণ করার পরামর্শ দিতেন। তিনি হরিনামের মন্ত্র দিতেন “ওঁ প্রাণ: রাম” বলে। প্রেমের অবতার চৈতন্যের বিষয়ে উপদেশ দিতেন। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ থেকে গল্প বলে উপদেশ দিতেন। বিভিন্ন তথ্যের আলোকে জানা যায়, সাধু রতনমনি ১৯৩২ সালে খুশী কৃষ্ণ ত্রিপুরা, গোলাকৃষ্ণ চৈত্রসেন ও অন্যান্য শিষ্যসহ অমরপুরের(চলাগং নতুন বাজারের মাঝামাঝি) একছড়ি মৌজায় ‘তাওফম’ এ প্রথম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ডম্বুরে প্রেমতলী আশ্রম , সামখুমছড়া আশ্রম ও উদয়পুরের দক্ষিণ মহারাণীসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রম তৈরি করেন। তখন সাধু রতনমনির অমায়িক আচার-আচরণ, পরোপকার, ধ্যান-সাধনা ইত্যাদি কার্যকলাপের প্রতি মুগ্ধ হয়ে রিয়াংগণ দলে দলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।

বিদ্রোহের ঘটনাবলী সম্পাদনা

যখন রিয়াং শিষ্যরা বুঝতে সক্ষম হলেন যে , খগেন্দ্র রিয়াং তাদের রিয়াং সমাজের মঙ্গল কামণা করেনা। তখন ধীরে ধীরে সাধু রতনমনির নেতৃত্বে রিয়াংগণ একত্রিত হতে থাকেন। সাধু রতনমনি শিষ্যদের নিয়ে সাধুসঙ্গ করতেন এবং রিয়াং প্রজাদেরকে বিভিন্ন প্রকার সুপরামর্শ প্রদান করে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বোদ্ধ করে সচেতন করে তোলেন । জানা যায় সাধু রতনমনি ভারতীয় জনগণের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি স্বদেশী দলও গঠন করেছিলেন। শিষ্যদের কোন অনুষ্ঠানে কোন কিছু বলার আগে “বন্দে মমাতরম ত্রিপুরেশ^রী” উচ্চারণ করতেন। ত্রিপুরা রাজ্যকে ত্রিপুরেশ^রী জ্ঞানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে একথা উচ্চারণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি ১৩৫৩ ত্রিপুরাব্দে শিষ্যদের নিয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তৈছারুবুহা তুইনানিছড়ায় ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। সাধু রতনমনি তার সংগঠন পরিচালনার জন্য মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেছিলেন। তবে তিনি নিজ কক্ষে মহারাজার ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতেন। অর্থাৎ তিনি মহারাজাকে মান্য করতেন। কিন্তু বিভিন্নজনের কুমন্ত্রণায় ক্ষুব্ধ মহারাজা শ্রীযুত বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মা বাহাদুর সাধু রতনমনি ও তাঁর শিষ্যদের দমন করার জন্য ১৪/০৪/১৩৫৩ ত্রিং (১৯৪৩ ইং) একটি রাজ আজ্ঞা জারি করেন। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য উদয়পুর বিলোনিয়া ও অমরপুরে তিনটি বাহিনী প্রেরণ করেন। উদয়পুরে মনোরঞ্জন দেববর্মা, বিলোনিয়ায় ল্যাফটেনেন্ট হরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা এবং অমরপুরে ল্যাফটেনেন্ট নগেন্দ্র দেববর্মা বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। মহারাজার এই রাজ্যরক্ষী বাহিনীরা সাধু রতনমনির দলকে কখনো ডাকাত দল, কখনো দস্যু দল আবার কখনো স্বদেশী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই রাজ্যরক্ষী বাহিনীরা নিরীহ রিয়াং প্রজাদের উপর চালায় অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন। রিয়াং প্রজাদের ঘর বাড়িয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুট করা হয়। অনেকজনকে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হয়। রতনমনির শিষ্যরা প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করে। রাজ্য রক্ষী বাহিনী বগাফা ও লক্ষীছড়া দখলে করে ফেললে বিদ্রোহীরা পিছু হটতে থাকে। রিয়াং প্রজারা এক এক জন এক এক দিকে অথবা দলবদ্ধ হয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।

দীনেশ চন্দ্র সাহা তাঁর ‘ত্রিপুরায় গণ আন্দেলনের বিচিত্র ধারা’ (প্রকাশকাল: রাইটার্স পাবলিকেশন্স, বইমেলা-২০০৫) গ্রন্থের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় রিয়াং বিদ্রোহের বর্ণনায় লিখেছেন-

“আকস্মিক আক্রমনে লাঠি, বল্লম ও টাক্কাল ইত্যাদি অস্ত্রধারী রিয়াং বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল । অমরপুর ও বিলোনিয়ায় খন্ডযুদ্ধ হল। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে আদিম জাতির বিদ্রোহীরা বেশিক্ষণ প্রতিরোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারল না। বহু বিদ্রোহী গুলিতে নিহত হন। ২ মহিলা এবং ১২ জন শিশুসহ তিন হাজার বিদ্রোহী বন্দী হল। ৫০ টি গ্রাম পুরিয়ে দেওয়া হল।”

১ আগস্ট ১৯৪৩ তারিখে রতন মনির ভাই সকামলা ত্রিপুরাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বগাফা ও লক্ষীছড়ায় রাজ্যরক্ষী বাহিনীর আক্রমনের খবর তুইছারুবুহা ক্যাম্পে অবস্থানরত রতন মনির নিকট এসে পৌঁছালে রতন মনি সাধু রাজ্যরক্ষী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না দেখে আত্মরক্ষার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড় মহকুমার রামসিরা নামক স্থানে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং শিষ্যগণকে অন্যস্থানে গিয়ে আত্মরক্ষা করার নির্দেশ দেন। ঐদিন শেষ রাতে সর্পজয়, কৃষ্ণরাম, চন্দ্রমনি, বিচিত্র প্রভৃতি শিষ্যগণ গুরু রতনমনির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যাত্র করেন। তারা সাধু রতন মনিকে সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে রতনমনির সঙ্গে মিলিত হন বালাফা, চৈত্রসেন, দাবারায়, বিচিত্র মুকুন্দ, কান্ত রায় ও তবিয়াসহ অনেককে গুলি করা হয় এবং ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু খুশীকৃষ্ণ পালিয়ে যান পূর্ব দিকে। আর রতন মনি পালিয়ে যান দীঘিনালায়। তিনি দীঘিনালার পোমাং পাড়ায় অশ^ীনি কুমার ত্রিপুরার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ৬ মাস পর দীঘিনালা থেকে ধৃত হন। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আগরতলা রাজ্যরক্ষী বাহিনীর হাতে নির্মম শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যবরণ করেন। এভাবে সাধু রতনমনি ও তাঁর দলের বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রতন মনি সাধুসহ অনেকের মৃত্যু ও ফাঁসি হয়। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেউবা অন্যত্র পালিয়ে গিয়ে নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। যদিও পরাজিত স্বদেশী দলের সদস্য হিসেবে লেখা হয়ে যায় রতন মনি, খুশী কৃষ্ণ, তাইন্দা রায়, শিলারাম, কানাই চন্দ্র, নিধিরাম, বিশ^মনি, মান্তিরায়, কৃষ্ণরাম, রামপ্রসাদ, কান্তরায়, বাহাদুর রায়, স্বর্পজয়, হান্দাই সিং প্রভৃতি নাম।

বিদ্রোহে শ্রী খুশী কৃষ্ণ ত্রিপুরার অবদান সম্পাদনা

রিয়াং বিদ্রোহ চলাকালে সাধু রতনমনির শিষ্য শ্রী খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা সাধুর স্বরচিত গানগুলো বেশ অবদান রেখেছিল। তিনি ১৯৩৬ সালে আগরতলার বিএল প্রেস থেকে ৩৩ টি গান সংবলিত একটি গ্রন্থ ছাপিয়ে তা শিষ্যদের মাঝে বিলি করেন। তাঁর রচিত ককবরক ভাষায় গানগুলো ছিল ধর্মীয় ভক্তিমূলক এবং পাপ ও অন্যায়-অত্যাচার বিরোধী।

ত্রিপুরা রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী তড়িৎ মোহন দাশগুপ্ত তাঁর ‘বিদ্রোহী রিয়াং নেতা রতনমনি’ (উপজাতি গবেষণা অধিকার, ত্রিপুরা সরকার কর্তৃক মে, ১৯৯৩ ইং প্রকার্শিত) নামক গ্রন্থেও ৬৮ নং পৃষ্ঠার ‘খুশী কৃষ্ণের গান ও বিদ্রোহে তার প্রভাব’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- “খুসীকৃষ্ণ ছিলেন মূলত কবি, গায়ক এবং ধার্মিক ব্যক্তি। তাহার রচিত ধর্ম মূলক গানগুলি প্রার্থণা সভায় গীত হত। পাহাড়ী লোকসঙ্গীতের সুরে লয়ে তালে খুসীকৃষ্ণের গানগুলির অবদান ছিল মর্মস্পর্শী।”

রিয়াং বিদ্রোহ কি রাজার বিরুদ্ধে নাকি সমাজপতিদের বিরুদ্ধে?

সাধু রতনমনি অথবা সাধু খুশীকৃষ্ণ কেউই রিয়াং দফার লোক ছিলেন না। তাঁরা তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড় মহকুমার নাইতং দফার লোক ছিলেন। কিন্তু নিরীহ, পশ্চাৎপদ ও রাজভক্ত রিয়াং সম্প্রদায়ের প্রতি রিয়াং সমাজপতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতিনিয়ত শোষণ , নির্যাতন, অত্যাচার দেখে সাধু রতনমনি ও তাঁর শিষ্যগণ ব্যথিত হন এবং পরবর্তীতে ঐ সমাজপতিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাই অনেক ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলতে নারাজ । কেননা তাঁদের মতে এই বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণ শুধুমাত্র রিয়াং অসৎ অত্যাচারী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, কোন মহারাজ বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়।

তাই দীনেশ চন্দ্র সাহা তাঁর “ত্রিপুরা গণ আন্দোলনের বিচিত্র ধারা” নামক গ্রন্থের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় নি¤œরূপ উল্লেখ করেছেন-

“ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রিয়াং বিদ্রোহের উপর এক তদন্ত রিপোর্টের বিববরণ থেকে জানা যায় যে, রিয়াং বিদ্রোহের পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ ছিল না। এই বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও ছিল না। চরম দারিদ্র্য এবং সর্দারদের অত্যচারই বিদ্রোহের প্রধান কারণ।”[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ত্রিপুরায় গণ আন্দোলনের বিচিত্র ধারা, পৃষ্ঠা: ৩৪, প্রকাশকাল: ২০১৫, আগরতলা, ত্রিপুরা

ত্রিপুরার ইতিহাস রিয়াং আদিবাসীদের কল্পমুখে