রামধন তর্কবাগীশ ছিলেন ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের একজন বাঙালি পুরাণ কথক এবং সংস্কৃত পদাবলীকার। বাংলায় কথকতার যে লৌকিক পদ্ধতি, তার প্রধান উদ্ভাবক ছিলেন তিনি৷ রামধনের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় প্রথম বিধবা বিবাহ করেছিলেন।[১]

পরিচয় সম্পাদনা

রামধন ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙা-খাঁটুরা-ইছাপুর ( প্রাচীন কুশদ্বীপ বা কুশদহ পরগনা) অঞ্চলের সংস্কৃত পণ্ডিতসমাজের একজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর কথকতাকে তিনি জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেন। তার দুই পুত্র: গণেশচন্দ্র ও শ্রীশচন্দ্র। কনিষ্ঠ শ্রীশচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করে 'বিদ্যারত্ন' উপাধি পান এবং প্রথম বিধবা বিবাহ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ আইন সামাজিক ক্ষেত্রে প্রচলন করেন। শ্রীশচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত খাঁটুরার বামোড়-তীরের ঘাট ও পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দুটি শিবমন্দির এখনো বিদ্যমান। ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র রামধন তর্কবাগীশকে স্মরণ করে লিখেছিলেন:[১]

এই স্থানে রাম ধন কথক রতন
কলকণ্ঠ কলে কল করিত কলন।
সুললিত পদাবলী বিরচিত তাঁর,
সকল কথক সুরে করিছে বিহার।।

প্রতিভা সম্পাদনা

খাঁটুরা অঞ্চলে রামধনের কথকতার পাণ্ডিত্য মাধুর্য সুললিত ভঙ্গি সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। শোনা যায়, একবার ভট্টপল্লীতে ( এখনকার ভাটপাড়া) রামধন সাধারণ মানুষদের দিকে লক্ষ্য রেখে সহজভাষায় পুরাণ ব্যাখ্যা করছিলেন; পাঠশেষে সেখানকার পণ্ডিতরা তার পাণ্ডিত্য নিয়ে বিদ্রূপ করে। ক্ষুব্ধ রামধন পণ্ডিতদের মনোভাব বুঝতে পেরে পরদিন থেকে পুরো একপক্ষকাল কথকতার আসরে অনর্গল সংস্কৃতে কথা বলেন; পণ্ডিতেরা বিস্মিত হয়ে তাদের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। কথকতাবৃত্তি থেকে রামধন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তিনি সহজভাষায় কিছু উৎকৃষ্ট মানের পদাবলীও রচনা করেছেন:[১]

কেশব কৃপানিধান। করুনাবলোকয় কুরু
করুনাং ময়ি দীনহীন জনে। তব পদ ভজন
যজন যাজন পূজন বন্দন মননবিহীনে।।

পীত বসন বনচারী। সুললিত নটবর রাস-
বিহারী। রমণীমথকৃত মুরলী কূজিত গোপিত
গোপীসত প্রেম বিতারি।।

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

রামধনের ভ্রাতুষ্পুত্র ধরনীধর কথক, পরিবারের এই কথকতার উত্তরাধিকার আজীবন যোগ্যতার সাথে বহন করেছিলেন; পুরাণপাঠে ও পদাবলী সঙ্গীতে তিনি রামধনের রচিত পদাবলীই ব্যবহার করতেন। শোনা যায়, বর্ধমান রাজবাড়িতে তিনি বছরে পাঁচ হাজার টাকা পেতেন। কথকতা ব্যবসায়ে তিনি এত অর্থ উপার্জন করেছিলেন যে, প্রচুর ব্যয় ও দান করেও মৃত্যুকালে তিনি লক্ষাধিক টাকা রেখে গিয়েছিলেন।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২১০-২১২