রাজকুমার বিজয়

খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর কিংবদন্তি রাজা

রাজকুমার বিজয় সিংহ (সিংহলি: විජය කුමරු) ছিলেন  শ্রীলঙ্কার এক রাজা। পালি ক্রনিকলস ও মহাবংশতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ক্রনিকলস অনুযায়ী, তিনি শ্রীলঙ্কার প্রথম রেকর্ডিত রাজা । তার রাজত্বের কাল ঐতিহ্যগতভাবে  ৫৪৩-৫০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। কিংবদন্তি অনুযায়ী, তিনি এবং  তার কয়েকশত অনুগামী শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন প্রাচীন বাংলা সংলগ্ন কোনো এক রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হবার পর। শ্রীলঙ্কায় তারা দ্বীপের মূল অধিবাসী যক্ষদের(Yakkhas) প্রতিষ্ঠিত রাজ্য জয় করে রাজত্ব করতে শুরু করে এবং হয়ে ওঠে  আধুনিক সিংহলি জাতির পূর্বপূরুষ ।

বিজয় সিংহ
বিজয় সিংহ
রাজকুমার বিজয় সিংহের রাজ্যাভিষেক ( অজান্তা গুহাসমূহের ১৭ নম্বর গুহার মুরালের থেকে বিস্তারিত)।নাম="সিংহল অবদান, ১৭ নম্বর গুহা"Simhala Avadana, Cave 17
রাজত্বআনু. ৫৪৩ – আনু. ৫০৫ খ্রিঃপূ
উত্তরসূরিউপাতিস্স্য
জন্মসিংহপুর
মৃত্যু৫০৫ খ্রিঃপূ
তাম্রপাণি, শ্রীলঙ্কা
দাম্পত্য সঙ্গীকুবেনি
বংশধরজীবহত
দিশালা
পিতাসিংহবাহু
মাতাসিহাসিভালি

সূত্র এবং কিংবদন্তির মধ্যে বৈচিত্র্য  সম্পাদনা

বিস্তৃত  ভাবে কিংবদন্তির চারটি স্বতন্ত্র সংস্করণের মধ্যে  ব্যাখ্যা করা হয়েছে  সিংহলি জাতির উৎপত্তি ।এই সবে এক রাজকুমার শ্রীলঙ্কায় আসেন। মহাবংস এবং দ্বীপবংস অনুযায়ী এই রাজকুমারের নাম  বিজয়, যখন অন্য দুই কিংবদন্তি অনুযায়ী রাজকুমারের অন্য নাম।

মহাবংস সংস্করণ
এই সংস্করণে, বিজয় এর দিদা ছিল এক রাজকুমারী ।যার রাজ্য বঙ্গ এবং কলিঙ্গ রাজ্যের (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা) মধ্যে ছিল। তিনি সিংহের সঙ্গে দুটি সন্তান হয়।সিংহ তাদের একটি বনের মধ্যে বন্দি করে রাখে ।  পরে, রাজকুমারী এবং তার দুটি সন্তান  বন্দিদশা পালিয়ে যায়।তার ছেলে সিংহবাহু, সিংহকে হত্যা করে। রাজকুমার বিজয় হল  সিংহ-হত্যাকারী সিংহবাহুর ছেলে।যিনি  নতুন রাজ্য  সিংহপুরের প্রতিষ্ঠাতা।বিজয় যুবরাজ হন।  কিন্তু  তাঁর ৭০০ অনুসারীদের সাথে শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত হন মন্দ কাজের জন্য।  মহাবংশের (Mahavamsa) সংস্করণে রয়েছে  যে পূর্বে এক সময়, শ্রীলঙ্কায় গিয়ে বুদ্ধ  সব যক্ষদের (Yakshas) শ্রীলঙ্কা থেকে অন্য দ্বীপ গিরিদ্বীপে বহিষ্কার করেন। যাইহোক, পরে এটা বলা হয়েছে যে বিজয়  শ্রীলঙ্কায় অবতরণের সময় যক্ষদের  সম্মুখীন হন এবং    (Kuveni )কুবেনি নামে এক যক্ষিনী তার রানী হন। কুবেনির সাহায্য নিয়ে বিজয় যক্ষ নগরী শিরিশাবাটথু  ধ্বংস করেন।কুবেনির সঙ্গে তার দুটি সন্তান হয়। তবে বিজয়কে যোগ্য শাসক হতে  বিয়ে করতে হত এক ক্ষত্রিয় রাজকুমারীকে।  অতএব, তিনি  পাণ্দু রাজার মেয়েকে বিয়ে করেন । পান্দু রাজা বিজয়ের  অনুসারীদের জন্য ও কনে পাঠান । কুবেনি এবং তার দুই সন্তান  নিজ নগর ছেড়ে যক্ষ নগরী লঙ্কাপুর (Lankapura) যান। যেখানে যক্ষরা কুবিনিকে যক্ষরা হত্যা করে   তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য। বিজয় কোনো উত্তরাধিকারীছাড়া মারা যান ।ভারত থেকে তার যমজ ভাই সুমিত্তের ছেলে পান্দুভাসদেব আসে এবং ভার নেয় বিজয়ের রাজ্যের। বিজয়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয় সিংহলি জাতির।
দ্বীপবংস  সংস্করণ
এই সংস্করণ মহাবংশ সংস্করণের থেকেও পুরনো। এটা মহাবংস সংস্করণের অনুরূপ, কিন্তু এতে কুবেনি (এবং অন্যান্য যক্ষ) বা দক্ষিণ ভারতীয় রাজকুমারীর উল্লেখ নেই।
হিউয়েন সাঙ এর বিবরণ
হিউয়েন সাঙ( সুয়ানচাং)র বিবরণ থেকে জানা যায় এক সিংহ(পশু) এক রাজকুমারিকে অপহরণ করে নিয়ে  আসে দক্ষিণ ভারত থেকে। এতে বঙ্গ,কলিঙ্গ বা বাংলার কোনো উল্লেখ নেই। সে এবং তার দুটি সন্তান  বন্দিদশা থেকে পালিয়ে তাদের  দক্ষিণ ভারতের রাজ্যে ফিরে যায়। তার ছেলে চিহ্-সি-টিসিউ (Chih-sse-tseu )("সিংহ-ধরা" অর্থাৎ সিংহবাহু)।পরে  তার পিতা সিংহকে বধ করে।তাকে একটি পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু বহিষ্কার করা হয় পিতাকে হত্যার জন্য।তিনি রত্নদ্বীপে(শ্রীলঙ্কার "দ্বীপ রত্ন")আসেন।  সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি আক্রমণ  করা শুরু করেন নৌ ব্যবসায়ীদের, যারা  দ্বীপে রত্ন  খুঁজতে  আসতেন। তিনি এই  ব্যবসায়ীদের শিশুদের বন্দি করেন এবং  তাদের জীবন ভিক্ষা দিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন।তার নিজের সন্তান ছিল (যদিও তাদের মায়ের নাম বলা হয় নি) এবং তার বংশধররা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায় ,তাদের   মধ্যে বর্ণপ্রথা বৃদ্ধি পায়। তারা যুদ্ধ  করে করে শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে দেয় তাদের গোষ্ঠীকে। চিহ্-সি-টিসিউ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর থেকে সিংহলি জাতির উৎপত্তি হয়। যক্ষের কোনো উল্লেখ এই সংস্করণে নেই।[১]
বালহাস্য জাতক সংস্করণ
এই জাতক সংস্করণ দেখা যায়  ভারতের অজন্তা গুহা চিত্র  এ(১৭ নম্বর গুহার মধ্যে সিংহ ল অবদান /Simhala Avadana    )।এই সংস্করণে , সিংহল নামে এক সদাগর রাজকুমার এই দ্বীপে নামে, যিনি সিংহ ("পশু") পুত্র। তিনি এবং তার ৫০০ জন অনুগামী রত্নদ্বীপের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়েন।যেখানে তারা রত্নের আশায় শিরিশাবাটথু শহরে যায়। তাদের জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়,কিন্তু যক্ষিনীদের দ্বারা আশ্রিত হন। যারা আগে দ্বীপ পরিদর্শনে আসা ব্যবসায়ীদের বিধবা পত্নী বলে নিজেদের পরিচয় দেয়।সিংহল প্রধান যক্ষিনীকে বিয়ে করে কিন্তু পরে আবিষ্কার করেন, তাদের প্রকৃত পরিচয়।তিনি এবং ২৫০ জন তাঁর অনুগামীরা দ্বীপ থেকে এক ঐন্দ্রজালিক উড়ন্ত ঘোড়া ভালাহাসসায়(Valahassa) চড়ে নিজের রাজ্যে পালিয়ে যায়। প্রধান যক্ষিনী তাদের অনুসরণ করে তার পৈতৃক রাজ্যে গিয়ে পৌছায় এবং নিজেকে তার বাবা সিংহের কাছে রাজকুমার দ্বারা লাঞ্ছিত নারী হিসেবে।রাজা তাকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু সে রাজকুমার ছাড়া রাজাকে এবং তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে । তারপর সে রত্নদ্বীপে ফিরে যায়, যেখানে সে অবশিষ্ট ২৫০ জন সিংহলের অনুসারীদের হত্যা করে। এরপর সিংহল তার বাবার সিংহাসনে বসেন এবং বিশালাকার একটি সামরিক অভিযান করেন রত্নদ্বীপে। তিনি যক্ষিনীদের নগরী ধ্বংস করেন এবং স্থাপন সিংহল রাজ্য স্থাপন করেন।[২]

মহাবংস সংস্করণ, সবচেয়ে বিস্তারিত ভাবে নিচে বর্ণিত হয়েছে ।

পূর্বপুরুষগণ সম্পাদনা

বঙ্গের ( Vanga বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এর অংশবিশেষ) রাজা প্রতিবেশী রাজ্য কলিঙ্গ(বর্তমানে ওড়িশা) এর রাজকন্যা মায়াবতী(কিছু সংস্করণে Mayavati) কে বিয়ে করেন ।এই দম্পতির সুপ্পাদেবী( Suppadevi ) নামে এক মেয়ে ছিল ।যার পশু দের রাজার সাথে মিলন হবে ভবিষ্যবাণী হয়েছিল। একজন পূর্ণবয়স্ক হিসাবে রাজকুমারী চাইতেন এক স্বাধীন জীবন এজন্য তিনি বঙ্গ ত্যাগ করেন। তিনি মগধ এর এক কাফেলার নেতৃত্বে যোগদান করেন। কিন্তু সিংহ ("পশু") দ্বারা আক্রান্ত হন লালা (বা Lada) অঞ্চল এর জঙ্গলে। মহাবংশে "সিংহ" হিসাবে একটি প্রাণী কে বোঝানো হয়েছে, কিন্তু কিছু আধুনিক দোভাষীর মতে সিংহ ছিল এক বিশ্রী ডাকাত, যে জঙ্গলের মধ্যে বাস করত।লালা বলতে সাধারণত বঙ্গ-কলিঙ্গ এর একটি অঞ্চল বোঝায় [৩][৪]

রাজকুমারী হামলার সময় পালিয়ে যান, কিন্তু আবার সিংহএর সম্মুখীন হন। সিংহ ছিল তার প্রতি আকৃষ্ট এবং রাজকুমারী ও ভবিষ্যবাণীর কথা মনে করে তার সাথে যায়। সিংহ রাজকুমারীকে একটি গুহার মধ্যে বন্দি করে রাখে এবং তাদের দুটি সন্তান হয় ।যার একটি ছেলে ,নাম সিংহবাহু (বা Sihabahu; ) এবং একটি মেয়ে ,নাম সিহাসিভালি (বা Sihasivali)।যখন শিশুরা বড় হয় তখন সিংহবাহু তার মাকে জিজ্ঞাসা করে কেন তিনি এবং সিংহ দেখতে এত ভিন্ন। পরে তার মা তাকে বলে, তার রাজকীয় পূর্বপুরুষগণ সম্পর্কে বলে, সিংহবাহু যাবার সিদ্ধান্ত নেন।একদিন যখন সিংহ বাইরে গেছে,তখন সিংহবাহু গুহা থেকে পালিয়ে যান সুপ্পাদেবী এবংসিহাসিভালিকে নিয়ে। তিনজন পৌঁছেছেন একটি গ্রামে, যেখানে তাদের সাথে বঙ্গের এক সেনানায়কের দেখা হয়। জানা যায় ঐ সেনানায়ক সুপ্পাদেবীর এক পিসতুতো ভাই এবং পরে তাদের বিয়ে হয়। এদিকে সিংহ শুরু করে গ্রাম ছারখার করা ,তার অনুপস্থিত পরিবারকে পাওয়ার জন্য প্রয়াসে। বঙ্গের রাজা ঘোষণা করেন যে সিংহকে হত্যা করতে পারবে সে পুরস্কার পাবে । সিংহবাহু তার নিজের পিতাকে হত্যা পুরস্কার দাবি করে।যখন সিংহবাহু রাজধানী ফিরে আসে, তখন বঙ্গের রাজা মারা গিয়েছিল। সিংহবাহু নতুন রাজা হন, কিন্তু তিনি পরে ক্ষমতা তিনি হস্তান্তর করে তার মায়ের স্বামী, সেনানায়ককে।তিনি ফিরে যান তার জন্মস্থান লালাতে এবং সিংহপুর নামে একটি শহর (বা Sihapura). প্রতিষ্ঠা করেন ,বিবাহ করেন তার বোনকে এবং এই দম্পতির ছিল ৩২ পুত্র ।যার মধ্যে ১৬ জোড়া যুগল।বিজয় ("victor") ছিল তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ,আর দ্বিতীয় পুত্র তার যমজ সুমিত্ত ।[৫]

সিংহপুরের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ এর সিঙ্গুরে ।[৬]

 শ্রীলঙ্কায় আগমন সম্পাদনা

 
 অজন্তা গুহা 17 এর মুরাল  থেকে একটি অধ্যায় , "সিংহল আসছে" বিষয়ের উপর রচিত।   উভয় দলের হাতি এবং সওয়ারিদের মধ্যে রাজকুমার বিজয়কে দেখা যায়

বিজয় তার বাবার দ্বারা যুবরাজ হন , কিন্তু তিনি এবং তার অনুসারীরা হয়ে কুখ্যাত হয়ে ওঠে জন্য সহিংসতার জন্য। পরে বার বার প্রজাদের অভিযোগ থামাতে বিজয় ব্যর্থ হলে বিশিষ্ট নাগরিকেরা দাবি করে যে তার শাস্তি হবে মৃত্যু। রাজা সিংহবাহু তারপর বিজয় এবং তার ৭00 অনুগামীদের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরুষদের মাথা অর্ধেক কামানো হয় এবং তাদের একটি জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল সমুদ্রে । এই ৭০০ লোকের স্ত্রী এবং শিশুদের পাঠানো হয় পৃথক জাহাজে।বিজয়ের অনুগামীরা অবতরণ সুপ্পারকা( Supparaka)তে; নারীরা অবতরণ করে মহিলাদীপে (Mahiladipaka) এবং শিশুদের অবতরণ হয় নাগাদ্বীপে (Naggadipa)। বিজয়ের জাহাজ পরে পৌঁছেছিল শ্রীলঙ্কার তাম্রপাণিতে (Tambapanni)।একই দিনে গৌতম বুদ্ধ মারা যান উত্তর ভারতে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, আজকের সোপরা (Sopara)হল সেই সুপ্পারাকা( Supparaka)।[৭] যারা বিশ্বাস করেন যে; বিজয় সিংহের সিংহপুর বঙ্গের অঞ্চল তাদের মতে জায়গাগুলি অবস্থিত ভারতের পূর্ব উপকূলে । উদাহরণস্বরূপ, এস কৃষ্ণস্বামী আইঙ্গার(S. Krishnaswami Aiyangar) ধারণা করছেন যে সুপ্পারকা (Supparaka) হতে পারে সুমাত্রা।[৮]

 মহাবংশ অনুযায়ী  স্বর্গে পৌঁছনোর পর,  গৌতম বুদ্ধ  দেবরাজ ইন্দ্রকে অনুরোধ করেন বিজয়কে  শ্রীলঙ্কায় রক্ষার জন্য, যাতে সে সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করতে পারে। ইন্দ্র শ্রীলঙ্কার অভিভাবকত্ব হস্তান্তর করেন বিষ্ণু (পদ্ম -রঙ্গিন ঈশ্বর Upulvan)কে। যিনি শ্রীলঙ্কা আসেন, তপস্বী বেশে বিজয়কে রক্ষা করার জন্য। [৯][১০] উইলহেম গেইজার পদ্ম রঙের ভগবান বিষ্ণুর সাথে তুলনা করেন বিষ্ণুর; uppala মানে হচ্ছে নীল পদ্ম।সেনারাথ পারানাভিথানা( Senarath Paranavithana)  তাকে বরুণদেবের এর সাথে তুলনা করেছেন।[১১]

বিজয় তার সব অনুগামী দের হাতে একটি প্রতিরক্ষামূলক সুতা বেঁধে দেয়।পরে এক যক্ষিনী(একটি মহিলা যক্ষ) বিজয়ের অনুগামীদের সামনে একটি কুকুরের আকারে উপস্থিত হয়। অনুগামীরা চিন্তা করে যে একটি কুকুরের উপস্থিতি নির্দেশিত করে সেখানে মানুষের বাসস্থান আছে এবং কুকুরটিকে তাড়া করে। পরে তাকে তাড়া করতে গিয়ে দেখলেন এক কুবেনি নামের(বা Kuvanna) যক্ষিনীকে চরকা কাটতে।

কুবেনি চেষ্টা করে তাকে গ্রাস করার , কিন্তু বিজয় এর ঐন্দ্রজালিক সুতা তাকে সুরক্ষিত রাখে।কুবেনি তাকে হত্যা করতে অক্ষম হয়ে তাকে নিক্ষেপ করে গভীর খাদে। সে একই জিনিস করে সব ৭00 অনুগামীদের সাথে। এদিকে, বিজয়া তার অনুগামীদের খোঁজ করতে গিয়ে কুবেনির জায়গায় আসে।বিজয় তাকে পরাভূত করে এবং তাকে বাধ্য করে তার অনুগামীদের মুক্ত করতে ।কুবেনি বিজয়ের কাছে প্রাণভিক্ষা চায় এবং বিনিময়ে তার প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ নেয়।সে বিজয় ও তার অনুসারীদের জন্য খাদ্য এবং পণ্য নিয়ে আসে সেই সব ব্যবসায়ীদের জাহাজ থেকে যাদেরকে সে গ্রাস করেছিল।বিজয় কুবেনিকে তার রাণী হিসেবে গ্রহণ করে।

তাম্রপাণি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় বিজয় এবং কুবেনি ঘুমিয়ে ছিল।তাদের ঘুম ভাঙে গান শুনে।কুবেনি তাকে অবগত করে যে দ্বীপ যক্ষদের বাসস্থান।যারা তাকে হত্যা করবে, তাকে ও তার অনুগামীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। কুবেনি ব্যাখ্যা করে যে গোলমালের শব্দ হল বিবাহ উৎসবের যা যক্ষদের শহর শিরিশাবাটথু থেকে আসছে।কুবেনি এর সাহায্য বিজয় যক্ষদের পরাজিত করে।বিজয়া এবং কুবেনির দুটি সন্তান হয়: জীবহত এবং দিশালা।বিজয় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম তাম্রপাণি বা তাম্বপান্নি ("তামা-লাল হাত"), কারণ পুরুষদের হাত লাল হয়ে ছিল এলাকার লাল মাটি দিয়ে।এই গোষ্ঠীর সদস্য যারা বিজয় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং সিংহলী নামে পরিচিত।[১২]

বিজয় এর মন্ত্রী ও অন্যান্য অনুসারীরা বেশ কিছু নতুন গ্রাম তৈরি করে।উদাহরণস্বরূপ, উপাতিস্স্য বা উপাতিস্স্যগামা গম্ভীরা নদীর তীরে অনুরাধাগামার উত্তরে।শিরিশাবাটথুর অনুগামীরা তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজা করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু এই জন্য তার প্রয়োজন এক আর্য (উন্নতচরিত্র) বংশদ্ভুত রাণী।বিজয় এর মন্ত্রী,প্রতিনিধিদের সঙ্গে মূল্যবান উপহার দিয়ে পাঠান মাধুরা শহরে, যা এক পান্দু রাজা দ্বারা শাসিত হত। (Madhura হল দক্ষিণ ভারতের মাদুরাই শহর; পান্দু হল পান্ড্য রাজবংশ)।রাজা সম্মত হন তার কন্যার সাথে বিজয় এর বিয়ে দিতে।তিনি অনুরোধ করেন অন্যান্য পরিবারদের তাদের কন্যাদের বিজয় এর অনুসারীদের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য।বেশ কিছু পরিবার রাজি হয় এবং তারা পর্যাপ্তরূপে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাজার দ্বারা উপহার পায়। পান্দু রাজা তার কন্যাকে শ্রীলঙ্কা পাঠান, অন্যান্য নারী (এক শত উন্নতচরিত্র বংশদ্ভু্ত কুমারী সহ), কারিগর,আঠারো সমবায় সংঘের এক হাজার পরিবার, হাতি, ঘোড়া,মালবাহী গাড়ি এবং অন্যান্য উপহার।তারা শ্রীলঙ্কার Mahatittha বা মহাতিত্থা বন্দরে।

বিজয় তারপর তার যক্ষিনী রাণীকে অনুরোধ করেন চলে যেতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে তার নাগরিকেরা ভয় করে তার মত অতিপ্রাকৃত মানুষকে।তিনি তাকে টাকা দেয় এবং তাদের দুই শিশুকে রেখে যেতে বলে। কিন্তু কুবেনি শিশুদের সঙ্গে নেন যক্ষদের শহর লঙ্কাপুরে যাওয়ার সময়।কিন্তু সে সেখানে প্রবেশ করার পূর্বে তার সন্তানদের বলল ফিরে যেতে।এরপর সে সেই শহরে প্রবেশ করল যেখানে অন্যান্য যক্ষরা তাকে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখে।তারা তাকে গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করে এবং এক যক্ষ তাকে হত্যা করে। তার মাতৃ সম্পর্কীয় মামা শিশুদের পালিয়ে সুমানাটায়( Sumanakuta )(আদম চূড়া)যেতে বলে।শ্রীলঙ্কার মালয় অঞ্চলের মধ্যে, তারা হয়ে ওঠে স্বামী-স্ত্রী এবং জন্ম দেয় পুলিন্দ জাতির(বেদ্দা বা Vedda জাতি)।

এদিকে, বিজয় রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন।পান্দু রাজার কন্যা হয়ে ওঠে তার রানী এবং অন্যান্য নারীরা বিয়ে করে তার অনুসারীদের পদ মর্যাদা অনুসারে। তিনি তার মন্ত্রী ও তার শ্বশুরকে উপহার দেন।তিনি ভাল মানুষ হয়ে উঠেন ।শান্তি ও ধার্মিকতার সাথে লঙ্কা শাসন করেন।

শেষ দিনগুলি সম্পাদনা

বিজয়ের পরে আর সন্তান হয় নি কুবেনির প্রস্থানের পর। যখন তিনি বৃদ্ধ হন , তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, তিনি বংশধর ছাড়া মারা যাবেন । তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তার যমজ ভাই সুমিত্তকে থেকে ভারত থেকে আনতে তার রাজ্য শাসন করার জন্য। তিনি একটি চিঠি পাঠান সুনিত্তকে, কিন্তু উত্তর পাবার পূর্বে তিনি মারা যান।তার উপাতিস্স্যগামার মন্ত্রী এক বছরের জন্য জন্য রাজ্য শাসন করেন। এদিকে সিংহপুরে সুমিত্ত রাজা হন এবং তার ছিল তিন ছেলে।তার রানী ছিল মাদ্দা বা Madda (সম্ভবত মদ্র) রাজার কন্যা।যখন বিজয় এর বার্তা এসে পৌছায়, তিনি খুব বৃদ্ধ। তাই তিনি অনুরোধ করেন তার ছেলেদের মধ্যে কাউকে লঙ্কার জন্য প্রস্থান করতে। তার কনিষ্ঠ পুত্র পান্দুভাসদেব স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হয়।রাজপুত্র এবং সুমিত্ত এর মন্ত্রীদের ৩২ জন পুত্র পৌছেন শ্রীলঙ্কায়, যেখানে পান্দুভাসদেব বা Panduvasdeva হয়ে ওঠেন নতুন শাসক।[১৩]

তাৎপর্য সম্পাদনা

শ্রীলঙ্কা বিজয়ের কিংবদন্ততি এর মধ্যে একটি হল সাধারণ রাজনৈতিক অলঙ্কারশাস্ত্র যা ব্যবহার করা হয় সিংহলিদের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে এবং প্রায়ই গণ্য করা হয় ঐতিহাসিক ঘটনার একটি প্রকৃত বিবরণ হিসেবে । সিংহলি পণ্ডিতেরা যেমন কে. এম. ডি সিলভা ব্যবহার করেছেন কিংবদন্তিকে ইন্দো-আর্য উৎপত্তি প্রমাণিত করার জন্য, এইভাবে, তারা নিজেদের দ্রাবিড় জাতির অংশ বলেছে এবং তামিলদের থেকে আলাদা করেছে। একই সময়ে, কিছু সিংহলি লেখক আছে,যারা কিংবদন্ততি ব্যবহার করেন তামিল বিচ্ছিনতাবাদের বিরোধিতা করতে।তারা মনে করে যে, সিংহলি ও তামিল এক জাতি, কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা মাদুরাইয়ের রাজা দ্বারা প্রেরিত কুমারীদের অন্তর্ভুক্ত। কিছু তামিল জাতীয়তাবাদীরা অন্যদিকে দাবি করেছেন যে, তাদের পূর্বপুরুষ ছিল বিজয় দ্বারা হত্যাকৃত যক্ষরা। তামিল লেখক যেমন সাতছি পোন্নাবালাম বা Satchi Ponnambalam এই কিংবদন্ততিকে রূপকথা বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন লঙ্কায় সিংহলিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এটি বানানো হয়েছে।[১৪]

সিংহলি জাতি এবং শ্রীলংকার তামিল জাতিদের মধ্যে হওয়া বিভিন্ন জেনেটিক পাঠ ভিন্ন ফল প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ আর. এল. কার্ক (১৯৭৬), এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সিংহলি জাতি জেনেটিকালি নিকটস্থ বাঙালি জাতির। যা মান্যতা পেয়েছে ।[১৫]

স্মৃতি সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Jonathan Spencer (২০০২)। Sri Lanka: History and the Roots of Conflict। Routledge। পৃষ্ঠা 74–77। আইএসবিএন 9781134949793 
  2. S. Devendra (২০১০)। "Our history: Myth upon myth, legend upon legend"। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৫ 
  3. John M. Senaveratna (১৯৯৭)। The story of the Sinhalese from the most ancient times up to the end of "the Mahavansa" or Great dynasty। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 7–22। আইএসবিএন 978-81-206-1271-6 
  4. Mudaliyar C. Rasanayagam (১৯৮৪)। Ancient Jaffna। Asian Educational Services। আইএসবিএন 9788120602106 
  5. "The Coming of Vijaya"The Mahavamsa। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৫ 
  6. Sripali Vaiamon (২০১২)। Pre-historic Lanka to end of Terrorism। Trafford। পৃষ্ঠা 169। আইএসবিএন 978-1-4669-1245-8 
  7. L. E. Blaze (১৯৩৮)। History of Ceylon। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 2। আইএসবিএন 978-81-206-1841-1 
  8. S. Krishnaswami Aiyangar (১ জানুয়ারি ১৯৯৫)। Some Contributions of South India to Indian Culture। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 75। আইএসবিএন 978-81-206-0999-0 
  9. Alf Hiltebeitel (১৯৯০)। The ritual of battle: Krishna in the Mahābhārata। State University of New York Press। পৃষ্ঠা 182। আইএসবিএন 0-7914-0249-5 
  10. "The Consecrating of Vijaya"The Mahavamsa। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৫ 
  11. A. D. T. E. Perera (১৯৭৭)। The Enigma of the Man and Horse at Isurumuniya Temple, Sri Lanka। Sri Lanka Cultural Research। পৃষ্ঠা 39। 
  12. Nanda Pethiyagoda Wanasundera (২০০২)। Sri Lanka। Marshall Cavendish। পৃষ্ঠা 26। আইএসবিএন 978-0-7614-1477-3 
  13. "The Consecrating of Panduvasudeva"The Mahavamsa। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৫ 
  14. Legends of People, Myths of State. Violence, Intolerance, and Political Culture in Sri Lanka and Australia। Berghahn। ২০১২। পৃষ্ঠা 34–40। আইএসবিএন 978-0-85745-436-2 
  15. Genomic Diversity। Springer। ২০০০। পৃষ্ঠা 18–20। আইএসবিএন 9781461542636 
  16. "ফেনী জেলা"feni.gov.bd (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৭-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৪ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা