রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য বিতর্ক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য বিতর্ক হলো একটি ঘটনা যা বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় সংঘটিত হয়। ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য কিছু ছাত্র সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অস্থায়ী ভাস্কর্য স্থাপন করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীরবে তা সরিয়ে ফেলার পর পূর্বানুমতি না নিয়ে ভাস্কর্যটি স্থাপনের কারণ দেখায়। পরে ভাস্কর্যের ভাঙা টুকরোগুলো ক্যাম্পাসের কাছে একটি আস্তাকুঁড়ের নিকটে পাওয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমালোচনার শিকার হয়।
তারিখ | ১৪–২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ |
---|---|
ঘটনাস্থল | ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
অবস্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ |
স্থানাঙ্ক | ২৩°৪৩′৫৭″ উত্তর ৯০°২৩′৪৪″ পূর্ব / ২৩.৭৩২৪০৯° উত্তর ৯০.৩৯৫৫২২° পূর্ব |
কারণ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অস্থায়ী ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা |
পটভূমি
সম্পাদনা১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালীন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো[১] এই ভাস্কর্য নির্মাণে তাদের সাহায্য করে। শিক্ষার্থীরা পুরো মাস ধরে ভাস্কর্যটি প্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলো। রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ ছিলো। এছাড়া তার হাতে থাকা গীতাঞ্জলি বইতে একটি পেরেক আটকানো ছিলো। একই বছর বইমেলায় তিনটি বইয়ের জন্য এক প্রকাশককে বাংলা একাডেমি তাদের স্টল খুলতে দেয়নি। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড শনিবার বিকেল চলচ্চিত্রের ছাড়পত্র দিতে বিলম্ব করছিলো।[২] অন্যদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ব্যবহার করে দেশে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। এসকল কারণে প্রতিবাদ হিসেবে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়।[৩] তারা এই ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলেন যে জনসাধারণের জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।[৪] কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সংসদের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা কিংবা সৃজনশীলতার প্রবাদপ্রতীম পুরুষ। আমরা তাকে আইডল বলতে পারি। যেহেতু মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সে কারণেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছি।"[৩]
ঘটনা
সম্পাদনা১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শিমুল কুম্ভকার ক্যাম্পাসে এসে দেখেন ভাস্কর্যটি নেই। ভাস্কর্যটি স্থাপনকারী শিক্ষার্থীরা সন্দেহ করতে শুরু করে যে কেউ ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলেছে। ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে তারা সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মৃতি ভাস্কর্যের সামনে একটি ব্যানার উত্তোলন করে। ব্যানারে লেখা ছিলো "গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!"।[১] ভাস্কর্যটি অপসারণের ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পরে ও তাদের কাজের সমালোচনা হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায় যে তারা ভাস্কর্য সরিয়ে নিয়েছে।[৫]
ভাস্কর্যটি অপসারণের পরদিন কয়েকজন পথচারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে ভাস্কর্যটির ভাঙা টুকরো দেখতে পান। ভাঙা টুকরোগুলোর ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার পর শিক্ষার্থীরা জানতে পেরে ভাঙা অংশগুলো উদ্ধার করে।[৬] তারা ভাস্কর্যটির ভাঙা অংশ জোড়া লাগিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এটিকে মূল স্থানে স্থাপন করে এবং এর দুই পাশে দুটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়। একটি ব্যানারে "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং সব ধরনের সেন্সরশিপ বন্ধ কর" লেখা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবীন্দ্রনাথের মতো পূজনীয় ব্যক্তিত্বের বিকৃত মূর্তি স্থাপনকে "অপসংস্কৃতি" বলে অভিহিত করেছেন, তাই আরেকটি ব্যানারে লেখা ছিলো "তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি"।[৭]
তবে ভাস্কর্যের টুকরোগুলো আবার একত্রিত করা হলেও এর মাথা হেলানো ছিল ও এর বেহাল দশা দৃশ্যমান ছিলো। ফলস্বরূপ, ২২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা এটি সরিয়ে ফেলে।[৮]
প্রতিক্রিয়া
সম্পাদনাভাস্কর্য স্থাপনের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী।[১] রাজুর পাশে আরেকটি ভাস্কর্য স্থাপনকে ‘অপসংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অপমান করেছে।[৯] তার মতে, শিক্ষার্থীরা গভীর অন্ধকারে ভাস্কর্যটি তৈরি করেছে যা সন্দেহজনক। ভাস্কর্যের পাশে টাঙানো ব্যানারকে তিনি ‘ব্যানার সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছেন।[১০] বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মতে, যে শিক্ষার্থীরা ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছে তাদের অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা মনে করে যে সরকারকে খুশি করতে কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্যটি অপসারণ করেছে।[১১]
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি আ. স. ম. আবদুর রব এক দলীয় বিবৃতিতে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে বলেন যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্যের ভাঙ্গা মাথা ময়লার স্তূপে ফেলে দেওয়া কবির প্রতি শ্রদ্ধার পরিচায়ক নয়। তিনি ও দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ঘটনাটিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, নেতাকর্মীরা প্রতিবাদের জন্য আইন মেনে চললে আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি হতো না। সে সময় কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিলেও পরে তারা পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা হারিয়েছিলো।[১২] বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এক প্রকাশিত বিবৃতিতে বলে যে ভাস্কর্যটি সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।[১০]
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এই পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলেন,[১০]
"রবীন্দ্রনাথ একমাত্র কবি, যিনি বিশ্বকবি। তিনি পৃথিবীর সব মানুষের কথা বলেছেন। সেই রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানো হয় তাহলে আমি বলতে বাধ্য- বাংলাদেশ পাকিস্তানি আমলে ফিরে গেছে। আমি দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছি খবরটি শুনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যেসব অঙ্গীকার ছিল তার কোনোটিই এখন আর অবশিষ্ট নেই। এর প্রমাণ রবীন্দ্র ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমেই হয়েছে।"[১০]
মুম রহমান বলেন, অনুমতি ছাড়া তিনি কারো জায়গায় ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার মতে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এই ঘটনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রক্টরের জবাবের প্রতি দ্বিমত পোষণ করে রাজু আলাউদ্দিন প্রশ্ন তুলে বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিবাদের জায়গা, তাই ন্যায্য প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে ভাস্কর্যটি স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে তিনি মনে করেন এই ঘটনার জন্য রবীন্দ্রনাথ বিদ্বেষীরা দায়ী হতে পারে।[১৩] হামিদুজ্জামান খান মনে করেন, ভাস্কর্যটি অপসারণ না করে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতো।[১০]
সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফের মতে, প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ভাস্কর্যটি সফল হয়নি, কারণ প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই যুগে বেমানান। মাহবুব মোর্শেদের মতে, ভাস্কর্যটিতে রবীন্দ্র ভক্তদের জন্য একটি বার্তা ছিলো ও ভাস্কর্যটি নিখোঁজ হওয়ার পেছনে একটি তাৎপর্য রয়েছে।[১৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ "'গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ'"। প্রথম আলো। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "পেরেকবিদ্ধ 'গীতাঞ্জলি' হাতে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যে বিধিনিষেধের প্রতিবাদ"। প্রথম আলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ ক খ "টিএসসিতে রবিঠাকুরের মুখ বাঁধা ভাস্কর্য"। বিডিনিউজ২৪.কম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। ২ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "সেন্সরশিপ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে ঢাবিতে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য"। আরটিভিঅনলাইন.কম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "'সৌন্দর্যহানি': রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য সরিয়ে বলল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন"। আজকের পত্রিকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "'গুম হওয়া' রবীন্দ্র-ভাস্কর্য মিলল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে"। বিডিনিউজ২৪.কম। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "'গুমের' ২ দিন পর ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "'মাথা হেলে পড়ায়' সরানো হলো রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য"। সমকাল। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "রবীন্দ্রনাথের মুখবাঁধা ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলল ঢাবি কর্তৃপক্ষ"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ সোহাগ, মামুন; আলম, রেজাউল (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী ভাস্কর্য ও গুম বিতর্ক"। সময়ের আলো। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মতানৈক্য"। দৈনিক ইত্তেফাক। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "ভাস্কর্য সরানো রাষ্ট্রের অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াবহতার প্রমাণ: রব"। বাংলানিউজ২৪.কম। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ লাহিড়ী, অমর্ত্য (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "Tagore Sculpture Controversy: 'লজ্জায়' হেঁট রবির মস্তক! চুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গর্জে উঠলেন ওপার বাংলার বুদ্ধিজীবীরা"। টিভি৯ বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "'রবীন্দ্রনাথের গুম হওয়া' তাৎপর্যপূর্ণ-ইঙ্গিতবহ"। ঢাকা ট্রিবিউন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০২৩।