রফিক আজাদ
রফিক আজাদ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ - ১২ মার্চ ২০১৬) ছিলেন একজন বাংলাদেশী আধুনিক কবি। ২০১৩ সালে তিনি সাহিত্যে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বিভিন্ন সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা করেছেন এবং জীবিকাসূত্রে সরকারি চাকরিও করেছেন।
রফিক আজাদ | |
---|---|
জন্ম | রফিক আজাদ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ |
মৃত্যু | মার্চ ১২, ২০১৬[১] ঢাকা | (বয়স ৭৪)
পেশা | সাংবাদিক, সম্পাদক |
পরিচিতির কারণ | কবি, মুক্তিযোদ্ধা |
পুরস্কার | একুশে পদক |
জন্ম
সম্পাদনারফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণগ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। প্রকৃতার্থে তারা ছিলেন তিন ভাই-দুই বোন। কিন্তু তার জন্মের আগে মারা যায় সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলা ও তৎপরবর্তী বোন খুকি। রফিক আজাদ যখন মায়ের গর্ভে তখন অকাল প্রয়াত বড় বোন অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘জীবন’। রফিক আজাদ ‘জীবনের’ই আরেক নাম।
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনা১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রফিক ভাষা শহিদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে, আদর্শ মানুষ হিসেবে।[২] ১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় একবার বাবার হাতে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য, পি.সি সরকারের কাছে জাদু শেখা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠান। কৈশোরে লাঠি খেলা শিখতেন নিকটাত্মীয় দেলু নামক একজনের কাছে। তিনি সম্পর্কে রফিক আজাদের দাদা। দেলু দাদা ছিলেন পাক্কা লাঠিয়াল। গ্রামে নানা কিংবদন্তির প্রচলন ছিল তার নামে। সলিম উদ্দিনের চেয়ে তিনি বয়সে বড় হলেও গা-গতর দেখলে পালোয়ান বলেই মনে হতো। দেলু দাদা খুব আদর করতেন রফিক আজাদকে। বার-বাড়িতে শিক্ষা দিতেন লাঠি খেলা। এছাড়া গুণী গ্রামের পাশেই মনিদহ গ্রাম। এখানকার ষাট শতাংশ অধিবাসী ছিল নিম্নশ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা ইত্যাদি। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই ছিল রফিক আজাদের শৈশব-কৈশোরের বন্ধু। সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হলেন কালিহাতি রামগতি শ্রীগোবিন্দ হাই ইংলিশ স্কুলের নবম শ্রেণিতে। বাড়ি থেকে প্রায় তিন-চার মাইল দূরত্বে স্কুল। কালিহাতি সংলগ্ন গ্রাম হামিদপুরের এক দরিদ্র গেরস্থের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে থেকে তিনি পড়াশোনা করেন। হামিদপুরে আগের মতো আর সেই বিধিনিষেধ নেই। কালিহাতি হাই স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সতীর্থ মাঈন উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। সে ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং অত্যন্ত মেধাবী। সাহিত্যপাঠে আগ্রহ ছিল তার। এই মাঈনই রফিক আজাদের আড্ডার প্রথম গুরু। হামিদপুরে তার সঙ্গে শুরু হয় তুখোড় আড্ডা। তার মুখেই প্রথম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনেন। দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি প্রভৃতি উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হন। মাঈন একদিন সন্ধ্যাবেলা ফটিকজানি নদীর তীর ঘেঁষা ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পুরো আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল তাকে। সেই কবিতা শুনে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কিশোর রফিক আজাদ। অবাধ স্বাধীনতা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে নবম শ্রেণিতে ভালোভাবে পাস করতে পারলেন না আড্ডাপ্রিয় রফিক আজাদ। মাঈনও প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানে চলে আসে। আড্ডার অন্য বন্ধুদের অনেকেই একাধিক বিষয়ে ফেল করে বসল। সারা বছর অহেতুক আড্ডা দিয়ে পরীক্ষায় এই দশা। অবশেষে ব্রাহ্মণশাসন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।[২]
কর্মজীবন
সম্পাদনারফিক আজাদ ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার এর সম্পাদক ছিলেন। রোববার পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।[৩] রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।[৪]
মুক্তিযুদ্ধ
সম্পাদনারফিক আজাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি।
প্রকাশিত গ্রন্থ
সম্পাদনা- অসম্ভবের পায়ে
- সীমাবদ্ধ জলে` সীমিত সবুজে
- চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
- এক জীবনে
- পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি
- প্রেমের কবিতাসমগ্র
- বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে
- বিরিশিরি পর্ব
- রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা
- রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র
- হৃদয়ের কী বা দোষ
- কোনো খেদ নেই
- সশস্ত্র সুন্দর
- হাতুড়ির নিচে জীবন
- পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ
- প্রিয় শাড়িগুলো[৫]
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭)
- কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯)
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২)
- সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯)
- কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১)
- কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬)
- বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭)[৬]
- একুশে পদক (২০১৩)[৭]
মৃত্যু
সম্পাদনাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ রফিক আজাদ মৃত্যুবরণ করেন।[১][৮]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "কবি রফিক আজাদ আর নেই"। নয়াদিগন্ত। ১২ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০১৬।
- ↑ ক খ সেই সময় জীবনেরই আরেক নাম[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1118639.bdnews ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে চলে গেলেন কবি রফিক আজাদ
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০১১।
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১২।
- ↑ লেখক অভিধান, বাংলা একাডেমী, ২০০৭, ঢাকা।
- ↑ "দৈনিক প্রথম আলো"। ২০১৬-১০-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৩।
- ↑ "চলে গেলেন কবি রফিক আজাদ"। প্রথম আলো। ১২ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০১৬।