যূথিকা রায়

ভারতীয় গায়িকা

যূথিকা রায় (ইংরেজি: Juthika Roy) (২০ এপ্রিল,১৯২০[১] – ৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৪) ভারতের বাঙালি খ্যাতকীর্তি ভজন গায়িকা ছিলেন । চার দশকের সঙ্গীত জীবনে ভক্তিমূলক ভজনগানে হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন । তিনি ২০০ টির বেশি হিন্দি ও ১০০ টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিতা সঙ্গীত শিল্পী ।.[২]

যূথিকা রায়
জন্ম(১৯২০-০৪-২০)২০ এপ্রিল ১৯২০
মৃত্যু৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪(2014-02-05) (বয়স ৯৩)
কলকাতা , পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাসঙ্গীতশিল্পী
কর্মজীবন১৯৩২-১৯৭০
পরিচিতির কারণভজন, (বাংলাহিন্দি)
পুরস্কারপদ্মশ্রী

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

যূথিকা রায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার আমতা'য়। অবশ্য তাঁদের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনার সেনহাটি'তে। ডাক নাম ছিল 'রেণু'। পিতা ছিলেন স্কুল ইনসপেক্টর,বদলির চাকরি । ঘন ঘন বদলির কারণে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটত।সেকারণে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তার মা কলকাতার চিৎপুরে বাসা নেন। বড় বোন বেথুন কলেজে ভর্তি হন। আর যূথিকা ছোটবেলা থেকেই গানে অনুরক্ত ছিলেন বলেই বরানগরে জ্ঞানরঞ্জন সেনের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন ।

সংগীত জীবন সম্পাদনা

ঘটনাক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম তার গান শুনে মুগ্ধ হন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলামের চেষ্টায় প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড হয় 'স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা’ গানটি । কিন্তু এই গানটি প্রকাশিত হয়নি । এরপর কমল দাশগুপ্ত তাঁকে দিয়ে দ্বিতীয়বার গান করান।প্রণব রায়ের রচনায় দুটি গান - রাগ ভৈরবীতে আমি ভোরের যূথিকা আর রাগ ইমনকল্যাণে সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে। গান দুটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তিনি জনপ্রিয় শিল্পীতে পরিণত হন।তার জন্য নতুন গান রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুরোধে নজরুল ইসলাম রচনা করেন 'নীল যমুনার জল' ও 'হে কৃষ্ণ প্রিয়তমা'। হেমন্তকুমার ও মান্না দে'র সমসাময়িক হয়ে,এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। সারা ভারতে গান শুনিয়েছেন, গিয়েছেন সিংহল ও পূর্ব আফ্রিকা । দিল্লি, কলকাতা বোম্বাই মাদ্রাজ এলাহাবাদ লক্ষৌ পাটনা, জলন্ধর সহ বহু বেতারকেন্দ্রে গান করেছেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস -এর জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় ও কমল দাশগুপ্তর সুরে দুটি ভক্তিমূলক গান - 'পরমপুরুষ সিদ্ধযোগী মাতৃভক্ত যুগাবতার' ও 'জয় বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী বীর' গান করেন। তিনি কমল দাশগুপ্তের নির্দেশনায় বহু নজরুলগীতি রেকর্ডে গেয়েছেন। দীর্ঘ চার দশকের সঙ্গীত জীবনে জনপ্রিয় আধুনিক গান সহ বহু ভক্তিমূলক ভজন গেয়েছেন । মোট রেকর্ড সংখ্যা হল ১৭৯ টি। উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল - 'এমনই বরষা ছিল সেদিন', ' 'জানি জানি প্রিয়', 'দোল দিয়ে কে যায় আমারে', 'এই যমুনার তীরে', 'তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম' ইত্যাদি । মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় ভজনসহ হিন্দিতে ভজন গেয়েছেন । মহাত্মা গান্ধী তার ভজন শুনে যূথিকাকে ‘মীরাবাঈ’ উপাধি উপহার দেন। মহাত্মা গান্ধীজওহরলাল নেহরু দুজনেরই প্রিয় ভজন শিল্পী ছিলেন তিনি । [৩]

    • সংগীত জীবনের বড় স্মৃতি -

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। দিল্লির রেডিও স্টেশন থেকে আমন্ত্রণ পেলেন গান গাইবার।

“১৫ আগস্ট ১৯৪৭ – প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আমাকে দিল্লির রেডিও থেকে ওঁরা ডাকলেন – ওনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। এটা ঠিক সেই স্বাধীনতা দিবস বলে আমাকে জানাননি, এটা মানে এমনিই প্রতি বছর আমাকে ডাকতেন – যেমন গান্ধীজির জন্মদিন, বড়ো একটা ফেস্টিভাল, কিছু এসেছে – এরকম হলেই আমাকে ডাকেন। তখন ছিল তিনটি করে সিটিং – তিনটে করে সিটিং থাকতো। প্রথমে সকালে একটা সিটিং থাকতো, সেটা পনেরো মিনিট। তারপরে সন্ধের দিকে একটা সিটিং থাকতো, সেটাও পনেরো মিনিট। তারপর রাত্তিরে – শেষের দিকে একটা থাকতো, সেটাও পনেরো মিনিট। কী গাইবো সেটা ওখানে লেখা থাকতো, যে এই গান তোমাকে গাইতে হবে – পনেরো মিনিট সময়। বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন দিল্লি স্টেশনে সকালবেলা – এই ছটা-সাতটা এরকম – রেকর্ডিং শেষ করে আমি সবে বাইরে এসেছি, তখন দেখি যে অফিসরুম থেকে একটা অফিসার ছুটতে ছুটতে এসে হন্তদন্ত হয়ে বাবাকে বলছেন, ‘যাবেন না, যাবেন না, দাঁড়ান আমাদের বিশেষ কথা আছে।’ বাবা দাঁড়াতেই তখন বললেন যে, ‘এইমাত্র আমি ত্রিমূর্তি হাউস থেকে ফোন পেয়েছি। আমাকে ফোন দিয়েছে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর তরফ থেকে – তিনি জানিয়েছেন যে, আমাদের প্রসেশন এখন লালকেল্লায় যাচ্ছে, ওখানে ভাষণ দেওয়া হবে এবং ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে আমাদের জাতীয় পতাকা তোলা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন যূথিকা গান গেয়ে যায়। ওদের তখন প্রসেশন বেরিয়ে গেছে। আমাকে তখন অফিসার বললেন, ‘আপনি শিগগিরই স্টুডিওতে ঢুকে পড়ুন, ঢুকে গান শুরু করুন।’ আমি তখন খুব মুশকিলে পড়েছি। কী গান গাইবো – এত বড়ো একটা অকেশন! তারপরে যেমন আনন্দ হয়েছে, তেমন ভয়ও হচ্ছে যে, কোন গান দিয়ে শুরু করবো! ওই অফিসার বলছেন যে, ‘হ্যাঁ, মহাত্মা গান্ধীজি তোমার ভজন ভালোবাসেন, তোমার ভজন রোজ শোনেন রেকর্ড বাজিয়ে, তুমি সেই ভজন দিয়ে শুরু করো। পরপর তুমি গেয়ে যাবে, থামবে না। পরপর গেয়ে যাবে – যতক্ষণ না আমরা তোমায় ইশারায় জানাবো – এখন থামো – ততক্ষণ পর্যন্ত গাইবে।’ আমি তো ঢুকে পড়লুম – ঢুকে পড়ে, এটা ঠাকুরেরই আশীর্বাদ, আমার মনে পড়লো একটা স্বাধীনতার গান – ‘সোনেকা হিন্দুস্তান মেরা – সোনেকা হিন্দুস্তান মেরা’, এটা দিয়েই আমি আরম্ভ করেছিলাম। তখন তো রেকর্ড হতো – রেকর্ডে দুটো গান থাকতো, ‘হিন্দুস্তান মেরা’র অপর পিঠে ছিল – ‘ভারত মেরি জন্মভূমি হ্যায়’। তা আমি ‘হিন্দুস্তান মেরা’ দিয়ে আরম্ভ করলাম এবং তারপরে গান্ধীজি যে সমস্ত ভজন ভালোবাসতেন, যেমন – ‘ম্যায় তো গিরধর্ আগে নাচুঙ্গি’ – তারপর এই ভজন যতো ছিল আমার সেই গানগুলো দিয়ে আমি প্রায় একঘণ্টার মতো গেয়ে তারপর ওখান থেকে সংকেত পেলাম যে – ‘বন্ধ করো’। বন্ধ করে আমি বেরিয়ে এলাম। তা সেটা আমার সংগীতজীবনের একটা খুব বড়ো স্মৃতি। “

সম্মাননা সম্পাদনা

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত করে ।

মৃত্যু সম্পাদনা

আজীবন ব্রহ্মচর্যের জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে দীর্ঘরোগভোগের পর ৯৩ বৎসর বয়সে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Legendary bhajan singer Juthika Roy dead", firstpost.com; retrieved 7 February 2014.
  2. Juthika Roy dies ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৪-০২-০৭ তারিখে, hindustantimes.com; accessed 31 March 2014.
  3. "Gandhi and Nehru's Favorite Bhajan Singer Juthika Roy is dead"IANS। news.biharprabha.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪