আবু আল মূগিরা যিয়াদ ইবনে আবিহি (আরবি: أبو المغيرة زياد بن أبيه, প্রতিবর্ণীকৃত: Abū al-Mughīra Ziyād ibn Abīhi; আনু. ৬২২ – ৬৭৩), আরও পরিচিত যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান (আরবি: زياد بن أبي سفيان, প্রতিবর্ণীকৃত: Ziyād ibn Abī Sufyān) ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ক্রমান্বয়ে রাশিদুন এবং উমাইয়া খিলাফতের একজন প্রশাসক ও দক্ষ কূটনৈতিক। তিনি ৬৬৫-৬৭০ সাল পর্যন্ত বসরা ও ইরাকের (প্রথম) গভর্নর এবং ৬৭০ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কার্যতভাবে পূর্ব খিলাফতের ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

যিয়াদ ইবনে আবিহি
শাসানীয় শৈলীতে তৈরী "যিয়াদ ইবনে আবি সুফিয়ান" নাম খচিত রুপার দিরহাম
বসরায় উমাইয়া গভর্নর
কাজের মেয়াদ
জুন/জুলাই ৬৬৫–৬৭০
সার্বভৌম শাসকপ্রথম মুয়াবিয়া
পূর্বসূরীআল হারিস ইবনে আব্দুল্লাহ আল আজদি[ক]
ইরাকে উমাইয়া গভর্নর
কাজের মেয়াদ
৬৭০–৬৭৩
সার্বভৌম শাসকপ্রথম মুয়াবিয়া
পূর্বসূরীপদ প্রতিষ্ঠিত
উত্তরসূরীআব্দুল্লাহ ইবনে খালিদ ইবনে আসিদ (কুফায়)
সামুরা ইবনে জুন্দুব আল ফজরি (বসরায়)
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম৬২২
মৃত্যু৬৭৩
দাম্পত্য সঙ্গী
  • মু'ধা বিনতে শাখর আল উকাইলিয়া
  • মারজানা
  • বিনতে মুহাকির ইবনে হাকিম ইবনে তালিক
  • বিনতে কা'কা ইবনে মা'বূদ ইবনে জুরারা আল দারিমিয়া
  • লুবাবা বিনতে আওফ আল হারাশিইয়া
সন্তান
  • মুহাম্মাদ
  • আব্দুল রহমান
  • উবায়েদুল্লাহ
  • সালম্
  • আব্বাস
  • ইয়াজিদ
  • আবু উবায়দা
  • উসমান[২]
  • উম্মে হাবিব (কন্যা)[৩]
  • রামলা (কন্যা)
  • শাখরা (কন্যা)
পিতামাতাসুমাইয়া (মা)

যিয়াদের পিতা সম্পর্কে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও জানা যায় তিনি তায়েফে বনু সাকিফ গোত্রে বড় হন এবং তাকে দত্তক নেওয়া এক জ্ঞাতীর সাথে ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে বসরা শহরে এসেছিলেন। এটি মুসলিমদের পারস্য অভিযানে আরবদের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বসরার প্রথম গভর্নর উতবাহ ইবনে ঘাযওয়ান প্রাথমিকভাবে তাকে কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তার উত্তরসূরীরা যিয়াদকে লিপিকার অথবা কেরাণী হিসেবে নিযুক্ত করে। এরপর খলিফা আলী (শা. ৬৫৬–৬৬১) তাকে ফারসে একটি বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠান। ৬৬১ সালে আলী নিহত হওয়ার পর যিয়াদ প্রথমদিকে তার খিলাফতের প্রতি অনুগত থাকলেও পরে আলীর বিরোধী প্রথম মুয়াবিয়ার (শা. ৬৬১–৬৮০) আনুগত্য করা শুরু করেন। মুয়াবিয়া যিয়াদের সমর্থন আদায়ের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে নিজের সৎভাইয়ের স্বীকৃতি দিয়ে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর শহরের অশান্ত জনগনের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি তার গাজর-এবং-লাঠি নীতির কথা তুলে ধরেছিলেন। তার বাগ্মীতার জন্য আরবের ইতিহাসে এই ভাষণটিকে গুরুত্বের সাথে স্মরণ করা হয়। যিয়াদকে পরামর্শদাতা ও কুফার গভর্নর আল মুগিরা ইবনে শু'বার মৃত্যু হলে মুয়াবিয়া সমন্বিত ইরাকের প্রথম গভর্নর হিসাবে যিয়াদকে নিযুক্ত করেন। এখানে দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি প্রশাসনিকভাবে আমসারকে স্বীকৃতি দেন এবং শাসানীয় শৈলীতে নিজের নামখচিত রুপার দিরহাম তৈরী করান। তিনি দৃঢ়ভাবে আরব শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ইরাক থেকে খিলাফতের পূর্বপ্রান্তের প্রদেশ খোরাসানে ৫০,০০০ আরব সৈন্য ও তাদের পরিবারকে স্থানান্তরের মাধ্যমে সেখানে পুনরায় বিজয়াভিজান শুরু এবং তুর্কিস্তান, বাল্‌খ ও কুহিস্তানের দিকে তথ্য সংগ্রহকারী সেনা প্রেরণ করেন। গণিমতের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি ও ঘনবসতিপূর্ণ সেনাছাউনি থেকে সৈন্য স্থানান্তরের এই বিপুল পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ইরাকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করলেও পরবর্তীতে এই পদক্ষেপ খিলাফতের জন্য নেতিবাচক পরিণতিও ডেকে এনেছিল। এসব খোরাসানী আরব সৈন্যদের বংশধরেরা একটি নতুন বাহিনী তৈরী করে ৭৫০ সালে উমাইয়াদের অস্থিতিশীল করে তোলে।

যিয়াদ ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে কুফার নিকট মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার পুত্র উবায়েদুল্লাহ, আব্দুল রহমান, সালম্, আব্বাস এবং ইয়াজিদ পালাক্রমে ইরাক, খোরাসান এবং সিজিস্তানে গভর্নর ও সহকারী গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। যিয়াদের জীবনী প্রথমিক আরবি জীবনিগ্রন্থগুলোর বিষয়বস্তু ছিলো। এছাড়া আরব ইতিহাসে তাকে তার সময়ের চারজন অন্যতম মহাজ্ঞানীর একজন এবং অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ও বাগ্মী হিসেবে স্মরণ করা হয়। ইরাকে যিয়াদের প্রশাসন তার উত্তরসূরীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে কাজ করেছিল।

বংশ পরিচয় সম্পাদনা

যিয়াদ সম্ভবত ৬২২ অথবা ৬২৩/২৪ খ্রিষ্টাব্দে তায়েফে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[৪] তার পিতৃপরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন উৎসে তাকে যিয়াদ ইবনে আবিহি ("নিজের পিতার সন্তান যিয়াদ") বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৫][৬] তার পিতার পরিচয় অজানা হলেও তিনি সুমাইয়া নামের এক জনৈক মহিলার বৈধ সন্তান। সুমাইয়ার বংশ বা গোত্র পরিচয়ও অস্পষ্ট। ৯ম শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল বালাদুরি এবং আওয়ানা ইবনে আল হাকিম উভয়ের মতে তিনি ছিলেন কাসকরে বসবাসরত একজন ক্রীতদাসী। যদিও পূর্বে দাবী করা হতো তিনি বনু বকরের একটি শাখা বনু ইয়াসকুর গোত্রের সদস্য ছিলেন। ইবনে আল হাকিম উল্লেখ করেন তিনি একজন পারস্যিক দেহকানের (প্রচুর জমির মালিক ধনশালী ব্যক্তি) অধীনস্থ ছিলেন। আল বালাদুরির বর্ণনা অনুসারে, সুমাইয়ার ইয়াসকুরি মালিক নিজের রোগের চিকিৎসার সন্ধানে মক্কা গমন করে সেখানে হজ্জ্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বনু সাকিফ গোত্রের এক চিকিৎসক আল হারিস ইবনে কালাদা তায়েফে তার চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। তাই পুরস্কারস্বরুপ ইবনে কালাদার নিকট সুমাইয়াকে হস্তান্তর করা হয়। আওয়ানাও বর্ণনা করেন, পারস্যিক দেহকানকে চিকিৎসার পর সুমাইয়াকে ইবনে কালাদাকে প্রদান করা হয়। উভয় বর্ণনাতেই পরবর্তীকালে সুমাইয়াকে ইবনে কালাদার স্ত্রীর অধীনস্থ উবায়েদ নামে এক গ্রীক অথবা সিরিয় ক্রীতদাসকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। একটি কবিতায় যিয়াদকে পারস্যিক বংশোদ্ভূত বলে উল্লেখ করা হলেও যিয়াদের পরিবারের দাবী করেছিল সুমাইয়া কোন কৃতদাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আরবের বনু তামিম গোত্রের যাইদ মানাত গোষ্ঠীর জনৈক ব্যক্তি আল আ'ওয়ারের কন্যা।[৪]

বসরায় প্রাথমিক কর্মজীবন সম্পাদনা

 
বিশ শতকের শুরুর দিকে বসরার একটি খাঁড়ি। ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় যিয়াদের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল এবং ৬৬৫ থেকে ৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এখানকার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

খলিফা আবু বকরের(শা. ৬৩২–৬৩৪) শাসনামলে যিয়াদ ইসলাম গ্রহণ করেন।[৪] জুলিয়াস ওয়েলহাউসেনের মতে এর ফলে "বিশ্ব তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল"।[৭] পরে তিনি আরব আমসার শহর বসরার প্রথম বাসিন্দাদের একজন হিসেবে বসবাস শুরু করেন।[৪][৮] ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শহরটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইরাকি রণক্ষেত্রে যুদ্ধরত মুসলিম সৈন্যরা একে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতো।[৯] যিয়াদ সেখানে ইবনে কালাদার সন্তান নাফি ইবনে আল হারিস এবং নুফাই ইবনে আল হারিসকে নিয়ে পৌঁছান।[৪] এই দুইজনের পরিবার প্রচুর জমির মালিক হওয়ার মাধ্যমে শহরে প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল।[৭] আবু বকরের শ্যালক উতবা ইবনে ঘাজওয়ান ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিকভাবে বসরায় শিবির স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে সেখানে শহর প্রতিষ্ঠা করে এর প্রথম গভর্নর হন৷[৪][৯] বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই যিয়াদের প্রশাসনিক দক্ষতা দৃষ্টগোচর হওয়া শুরু করে। খলিফা উমরের (শা. ৬৩৪–৬৪৪) শাসনামলে উতবা তাকে বসরার দিওয়ানে (আমলাতন্ত্র) ছোটখাটো কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন।[৪] ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে উতবা যিয়াদকে বসরার উত্তরের শহর আল উবুল্লা (অ্যাপোলোগোস) থেকে পাওয়া গণিমত সৈন্যদের মধ্যে বণ্টনের দায়িত্ব দেন।[৪][১০] আধুনিক ঐতিহাসিক আইজ্যাক হাসনের মতে, যিয়াদ "একজন মেধাবী এবং খোলা মনের কেরাণী হিসাবে নিজেকে স্বতন্ত্র করেছিলেন, যিনি নিজের মালিক ও জনগনের সেবার প্রতি নিবেদিত ছিলেন ... তিনি হিসাবরক্ষণে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং আলঙ্কার শাস্ত্রের উপর তার অসামান্য দখল ছিল।[৪] নিজের দক্ষতা এবং বসরার সামরিক গভর্নর আলী মূসা আল-আশ'আরি এক সামরিক অভিযানে যাওয়ায় যিয়াদকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দেওয়া কাজগুলো সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করে যিয়াদ খলিফা উমরের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেম।[৪] তিনি যিয়াদকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র মদিনায় নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি তার দক্ষতাকে আরও পরোখ করে দেখেন। যিয়াদের কাজে খুশি হয়ে উমর তাকে ১,০০০ রুপার দিরহাম পুরস্কার দেন। এগুলো তিনি তার মা অথবা তার সৎবাবা উবায়েদকে মুক্ত করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।[৪] বসরায় ফিরে আসার স্বল্প সময়ের পর তাকে উতবার কাতিব (লিপিকার বা কেরাণী) নিযুক্ত করা হয়।[৪]

উতবার মৃত্যুর পর যিয়াদ তার উত্তসূরী আবু মুসা আল আশ'আরী এবং আল মুগিরা ইবনে শু'বার অধীনেও কাতিব হিসেবে কাজ করেছিলেন। আল মুগিরা ইবনে শু'বা ছিলেন বনু সাকিফ গোত্রের সদস্য এবং পরবর্তীতে তিনি যিয়াদের পরামর্শদাতা হন। [৪][৫][১০][৮] ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে যিয়াদের মায়ের দিক থেকে দুই সৎ ভাই আবু বকর নুফাই এবং শিবলি ইবনে মা'বাদসহ তিনজন আল মুগিরার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ করলে উমর তাকে মদিনয়া ডেকে পাঠান। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যিয়াদকেও ডাকা হয়।[৪] তিনি আল মুগিরার পক্ষে সাক্ষ্য দিলে আল মুগিরাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়ে অভিযোগকারীদেরকে চাবুক মারা হয়।[৪] খলিফা উসমানের শাসনামলে (শা. ৬৪৪–৬৫৬) যিয়াদ বসরায় খলিফার নিযুক্ত করা গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমিরের অধিনে কাজ করেছিলেন।[৪]

উসমানের উত্তরসূরী আলী (শা. ৬৫৬–৬৬১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন আর যিয়াদকে এই প্রদেশের খারাজ (ভূমি কর) আদায় এবং কোষাগার তদারকীর দায়িত্ব দেন।[১১][১২] হাসনের মতে, "আলী যিয়াদের প্রতিভার এতই গুণগ্রাহী ছিলেন" যে তিনি ইবনে আব্বাসকে যিয়াদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন।[১১] ৬৫৭ সালে সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে সিফফিনের যুদ্ধে আলীর সাথে যোগ দিতে বসরা ছাড়ার সময় ইবনে আব্বাস যিয়াদকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব দিয়ে যান।[১৩] এই সময়ে তিনি আজদ্ গোষ্ঠীর সহযোগীতায় শহরের সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন গোত্র বনু তামিমের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।[১৪]

আলী সিফফিন থেকে ফেরার পর ফারসে তার নিযুক্ত করা গভর্নর শাহল ইবনে হুনাইফকে সেই এলাকার বাসিন্দারা বিতাড়িত করলে আলী সেখানে যিয়াদকে প্রেরণ করেন।[১১] যিয়াদ ফারসে খারাজ আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেখানকার লোকজন তার নেতৃত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট হয়।[১১] ৬৬১ সালে আলী নিহত হওয়া ও মুয়াবিয়া উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর যিয়াদ ফারসে আলীর শাসনামলের শেষ প্রশাসনিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বে থেকে যান।[১১] পরবর্তীতে তিনি ইশতাখরের নিকট একটি দূর্গের দায়িত্বে থেকে যান। আলীর নিযুক্ত করা গভর্নরদের মধ্যে মুয়াবিয়ার খিলাফতকে স্বীকৃতি দিতে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় নিয়েছিলেন।[৭][১৫] মুয়াবিয়ার প্রতিনিধি বুশর ইবনে আবু আরতাত বসরায় যিয়াদের তিন পুত্রকে আটক ও তাদেরকে হত্যার হুমকি দিয়ে যিয়াদকে চাপে ফেলে।[৭][১৫] যিয়াদের সৎ-ভাই আবু বকরা মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতা করে যিয়াদের সন্তানদের মুক্ত করান।[১৬] ইরাকে অন্যতম সেনা শহর কুফায় মুয়াবিয়ার নিযুক্ত করা গভর্নর আল মুগিরার মধ্যস্থতায় ৬৬২/৬৩ খ্রিষ্টাব্দে যিয়াদ অবশেষে মুয়াবিয়ার শাসনকে স্বীকৃতি দেন।[৫][১৭] সমঝোতা হয় যে, খিলাফতের ফারস্ থেকে প্রাপ্য রাজস্ব যিয়াদ ও আল-মুগিরার মধ্যে বন্টিত হবে, যা মুয়াবিয়া উপেক্ষা করেছিলেন।[১৭] যিয়াদ কুফায় চলে আসেন এবং আল-মুগিরা ও তার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন।[১৮]

বসরার গভর্নর সম্পাদনা

 
আব্দুল কায়েস, বনু তামিম, আহলে আলিয়া, বনু বকর ও আযদ্ গোত্রের মধ্যে যিয়াদের করা পাঁচভাগে বিভক্ত মধ্যযুগীয় বসরার মানচিত্র

মুবাবিয়া তার পিতা আবু সুফিয়ানের সন্তান হিসাবে যিয়াদকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়, যিয়াদ যখন আবু সুফিয়ানের সন্তান হওয়ার বিষয়ে তাকে নিয়ে ছড়ানো গুজব সম্পর্কে খলিফার নিকট জানতে চান।[১১] ওয়েল হাউসেনের মতে, মুয়াবিয়া নিজের সৎভাই হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যিয়াদকে দামেস্কে ডেকে পাঠান, "যাতে করে যিয়াদের সাথে তার ও তার পরিবারের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা যায়"[১৯] উমাইয়া রাজপরিবার এই সিদ্ধান্তকে নিজেদের জন্য অপমানজনক হিসেবে বিবেচনা করেছিল।[১৭] মুয়াবিয়ার সন্তান ইয়াজিদ এবং এই বংশের অন্যান্য শাখা যেমন মদিনায় মারওয়ান ইবনে আল হাকামের বংশধররা, বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমির এর প্রতিবাদ করেন অথবা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দেন।[১১] ইবনে আমির এবং মারওয়ানিরা ঘুষ অথবা চাপ প্রয়োগের ফলে নিশ্চুপ ছিল।[১১] যিয়াদের সাথে ইয়াজিদের সম্পর্ক ছিল আন্তরিকতাশূণ্য। মুয়াবিয়ার যিয়াদকে নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘটনা নিয়ে মারওয়নের ভাই আব্দুল রহমান ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা প্রচার করে।[১৯] মুসলিম পন্ডিতগণ সাধারণত এই ঘটনাকে মুয়াবিয়ার নেওয়া সবচেয়ে অসম্মানজনক পদক্ষেপগুলোর একটি বলে বিবেচনা করেন।[২০]

ঐতিহাসিক হিউ এন. কেনেডির মতে, দক্ষতা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় লোকদের সাথে যোগাযোগ থাকার ফলে বসরায় তার ডান হাত হিসেবে কাজ করার জন্য মুয়াবিয়া যিয়াদকে এই প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।[৫] তিনি ৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন অথবা জুলাইয়ে বসরার অশান্ত জনগনের উদ্দেশ্যে তার গাজর-ও-লাঠি বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[৫]

হাসনের মতে "বক্তৃতাটিকে বাগ্মীতার একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।"[১১] ওয়েলহাউসেন এটিকে "বিখ্যাত" এবং "ভূমিকাহীন [বক্তব্য]" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[১৮] কারণ বক্তব্যটি চিরাচরিতভাবে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি দরূদ পাঠ না করেই শুরু করা হয়েছিল।[৫] নিচে বক্তৃতাটির অনুবাদ করা হলো:

তোমরা ধর্মের চেয়ে পারস্পরিক সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছ, তোমরা অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছ আর তাদের ক্ষমা করছ এবং ইসলামের পবিত্র আইনকে ধ্বংস করছ। রাতে অসৎ উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়ে সতর্ক হও। যাদের রাতের বেলায় রাস্তায় দেখা যাবে, তাদের প্রত্যেককে আমি হত্যা করবো। অবৈধ সম্পর্কে স্থাপনের আহ্বানের বিষয়ে তোমরা সতর্ক হও। যারা এধরনের আহ্বান করবে, আমি তাদের প্রত্যকের জিভ কেটে নেব। যেকেউ অন্যকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে, যেকেউ অন্যের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, যেকেউ অপরের বাড়িতে হামলা করে এবং যেকেউ কবর খুঁড়ে লাশ তোলে তাকেই আমি শাস্তি দেব। এদের জন্য আমি এদের পরিবারকেও দায়বদ্ধ করছি। আমার প্রতি ঘৃণাপোষনকারীদের আমি কোন শাস্তি দেবনা, কিন্তু অপরাধীরা তাদের নিজের অপরাধের শাস্তি পাবে। যারা আমার আগমনে ভীত-সন্ত্রস্ত তাদের অনেকেই আমার উপস্থিতিতে খুশি হবে। আর এখন যারা আশান্বিত হচ্ছে, তাদের অনেকেরই এই ভ্রান্ত আশা ভঙ্গ হবে। আমি আল্লাহর এখতিয়ারে তোমাদের শাসন করবো এবং আল্লাহর সম্পদ দিয়ে তোমাদের রক্ষনাবেক্ষণ করবো। আমি তোমাদের কাছে আনুগত্য প্রত্যাশা করি, আর তোমরা আমার কাছ থেকে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পার। আর যা-ই হোক আমার মধ্যে তিনটি জিনিসের ঘাটতি তোমরা কখনই দেখবে না: আমি তোমাদের মধ্যে যেকারও যোকোন কথা শুনতে প্রস্তুত, আমি তোমাদেরকে তোমাদের ভাতা যথাসময়ে পরিশোধ করবো এবং তোমাদের বহুদূরে দীর্ঘসময়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করবো না। আমার প্রতি ক্ষোভ এবং ঘৃণা যেন তোমাদের আত্মহারা না করে। যদি তা হয় তাহলে সেটা তোমাদেরই জন্য ক্ষতিকারক হবে। আমি অনেকগুলো মাথাকে নিচু হতে দেখছি।Many heads do I see tottering; let each man see to it that his own remains on his shoulders![২১]

যিয়াদ ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই বক্তৃতায় বলা তার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করেছিল এবং কূফাবাসীদের কাছ থেকে ব্যাপক সম্মান অর্জন করে।[২২] তিনি বসরা এবং পূর্ব দিকের ফারস ও কেরমান এবং দক্ষিণে আরব মরুভূমির মত ইরানীয় উপনিবেশগুলোতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। বসরায় রাজনীতি থেকেও রাহাজানী নিয়ে বেশি উদ্বীগ্ন থাকা খারিজিদের অনেকেই তার কর্তৃত্ব মেনে নেয়।[২৩] যিয়াদের অধীনে বসরা একটি যথার্থ ইসলামি শহরের রূপ নিতে শুরু করে।[৯] যিয়াদ তার শাসনামলে শহরে কাঁচা মাটির ইটের ইটের তৈরী বাড়র পরিববর্তে আরও বেশি টেকসই পোড়া মাটির ইটের ব্যবহার প্রচলণ করেন। তিনি একটি প্রশাসনিক মসজিদ এবং বসবাসের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।[৯] ঐতিহাসিক চার্লস প্যালেটের মতে, "একটি নির্দিষ্ট সীমায় যিয়াদ ছিলেন শহরটির উন্নয়নের কারিগর"।[৯] তার কার্যকরী শাসনব্যবস্থা তার প্রতি মুয়াবিয়ার আস্থা তৈরী করতে পেরেছিল।[৫] যে বছর যিয়াদকে বসরায় নিয়োগ দেওয়া হয় ঐ একই বছর তাকে বাহরাইন প্রদেশ (পূর্ব আরব) এবং এর অধীন ইয়ামামার (মধ্য আরব) দায়িত্বও প্রধান করার হয়।[২৪]

যিয়াদ কূফা ও বসরার আমসারে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে প্রশাসনিকভাবে পুণঃগঠন করেন।[১১] খলিফা উমরের শাসনামল থেকে সেনা ছাউনিগুলোতে বিভিন্ন গোত্রের লোক একত্রে বসবাস করতো৷ ভাতা প্রধানের জন্য এদেরকে বিভিন্ন দলভূক্ত করা হয়।[২৫] কুফা ও বসরায় এধরনের সাতটি দল ছিল। আর প্রত্যেক দলের সদস্যরা নিজেদের জন্য একজন প্রধান নির্বাচন করতো। তিনি সরকারের নিকট তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতেন।[২৬][২৭] এই ব্যবস্থাটি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর ও রাজনৈতিক সমস্যার কারণ হয়ে পড়ে।[২৬] আবসারগুলোতে আরব অভিবাসনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা। ফলে এগুলোর লোকসংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যায় এবং সেখানে কয়েকটি দ্রব্য নিয়ে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।[২৮] তাই যিয়াদ জড়িত গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে কয়েকটি বৃহত্তর বিভাগ গড়ে তোলেন এবং তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে তাদের জন্য নেতা নিযুক্ত করেন। আর এর মাধ্যমে কূফা ৩ ও বসরা ৫ বিভাগে পুণঃবিন্যস্ত হয়।[২৫] এই পদক্ষেপের ফলে এই দুই শহরের বাসিন্দাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হয়ে যায়।[২৫] Ziyad undertook further reforms in Kufa and Basra, including regularizing the timely payment of stipends, embarking on agricultural development schemes, including canal digging, and minting Sasanian-style dirhams that bore his name as "Ziyad ibn Abi Sufyan".[২৫]

ইরাক ও পূর্বের ভাইসরয় সম্পাদনা

৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে আল মূগিরার মৃত্যূর পর কূফা এবং এর উবনিবেশ যিয়াদের শাসনাধীন করা হয়। ফলে তিনি কার্যতভাবে ইরাক এবং খিলাফতের পূর্বার্ধের ভাইসরয় হয়ে যান।[৫][২৯] তিন কূফা এবং বসরার প্রথম দ্বৈত গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তার আবাস এই দুই শহররের মধ্যে ভাগ করে নেন।[১১] শীতে তিনি তার সহকারী হিসেবে আমর ইবনে হুরাইজকে কূফার দায়িত্ব দিয়ে বসরায় চলে যেতেন এবং গ্রীষ্মে সামূরা ইবনে জুন্দুবকে বসরার দায়িত্ব দিয়ে কূফায় থাকতেন।[১১] His strong grip in Kufa marked a shift from al-Mughira's hands-off approach.[৫] যদিও কূফায় খলিফা আলীর সমর্থক আলীয়দের আন্দোলন তার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল।[১১] এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হুজর ইবনে আলী আল কিন্দি। তিনি উমাইয়াদের শাসন প্রত্যাখ্যান করেন and led the first open calls for the caliphate to be held by Ali's progeny.[২৯] যদিও আল মুগিরা হুজরের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, কিন্তু যিয়াদ তাকে কয়েকবার তার এই খোলাখুলি বিরোধিতা বন্ধের জন্য সতর্ক করেন। [১১] তিনি হুজরের অধিকাংশ সমর্থককে কূফার সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে তাদের হুজরেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।[১১][৩০] ৬৭১ খ্রিষ্টাব্দে হুজরকে তার ১৩জন অনুগতের সাথে গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের জন্য দামেস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আলাীয়দের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে হুজরসহ ৬ জনকে আদরায় নিয়ে হত্যা করা হয়।[৩১] ঐ দলের আব্দুল রহমান ইবনে হাসান আল আনজি নামে একজনকে মুয়াবিয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু পরে তিনি আলীর নিন্দ করতে খলিফার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে খলিফাকে অপমান করলে তাকে পুনরায় যিয়াদের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে শাস্তি হিসেবে যিয়াদ তাকে জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে দেয়।[৩২]

যিয়াদ বসরা এবং কুফার আমসারগুলোতে (সেনাছাউনি) বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে প্রশাসনিকভাবে শহরদুইটিকে পুণঃগঠন করেন।[১১] খলিফা উমরের শাসনকাল থেকে এই সেনাছাউনগুলোতে বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা একসাথে থাকত। সামরিক ভাতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন দলে ভাগ থাকত।[২৫] কুফা ও বসরায় এইরকম সাতটি দল ছিল এবং দলের সদস্যরা নিজেদের একজন নেতা নির্বাচন করত, যিনি সরকারের কাছে নিজের দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।[২৬][২৭] তবে এই ব্যবস্থাটি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।[২৬] এই আমসারগুলোতে আরব অভিবাসনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা।ফলে এগুলোর জনসংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যায় এবং কয়েকটি দ্রব্য নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।[২৮] যিয়াদ এসব সমস্যার সমাধানে সম্পৃক্ত গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে কুফাকে তিন ও বসরাকে পাঁচটি বৃহত্তর বিভাগে বিভক্ত করেন এবং তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এদের নেতা নিযুক্ত করেন।[২৫] এই পদক্ষেপের ফলে শহর দুইটির বাসিন্দাদের নিয়ন্ত্রণ করা আরও বেশি সহজ হয়ে যায়। [২৫] এছাড়াও যিয়াদ সময়মত ভাতা প্রদান তাদারকি করা, কৃষি উন্নয়নের জন্য খাল খননসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ, নিজের নাম "যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান" খচিত শাসানীয় রীতিতে তৈরী মুদ্রার প্রচলসহ কুফা ও বসরায় বেশ পুণঃগঠনমুলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।[২৫]

কার্যমূল্যায়ন ও উত্তরসূরী সম্পাদনা

যিয়াদ আল-থাওইয়া গ্রামে ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।[৪][৩৩] তাকে সেখানকারই একটি সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, যেখানে বেশ কয়েকজন কুরাইশেরও সমাধি ছিল। মৃত্যুর সময় তিনি ১০,০০০ রুপার দিরহাম রেখে গিয়েছিলেন।[৩৪] ৬৭৫-৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে কূফার গভর্নর থাকাকালীন সময়ে আল-দাহ্হাক ইবনে কাইস আল-ফিহরি যিয়াদের সমাধিতে গিয়ে এক শোকগাঁথা আবৃত্তি করেন:

যদি ইসলাম আর উচ্চপদমর্যাদা কোন মানুষকে অমর করে থাকে,
তাহলে সেটা আপনাকেই করেছে।[৩৫]

তার মৃত্যুর এক বছর পর মুয়াবিয়া যিয়াদের সন্তান উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে প্রথমে খুরাসান এবং পরে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন।[৩৬] মুয়াবিয়ার সন্তান ও উত্তরসূরী খলিফা প্রথম ইয়াজিদের (শা. ৬৮০–৬৮৩) অধীনে কূফার গভর্নরের দায়িত্বও উবাইদুল্লাহকে দেওয়া হয়েছিল।[৩৬] যিয়াদের সন্তান আব্দুল রহমান এবং সালম্ একজনের পর আরেকজন যথাক্রমে ৬৭৮-৬৮০ এবং ৬৮০-৬৮৩/৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খুরাসানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[৩৭][৩৮] তার অপর দুই সন্তান আব্বাস এবং ইয়াজিদ একজনের পর আরেকজন যথাক্রমে ৬৭৩-৬৮০/৮১ ও ৬৮০/৬৮১ খ্রিস্টাব্দে সিজিস্তানের গভর্নর ছিলেন।[৩৯][৪০] প্রাক-ইসলামী যুগ থেকেই বনু সাকিফ গোত্র উমাইয়াদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং মুসলিমদের ইরাক অভিযানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই গোত্রের আল-মুগিরা, যিয়াদ, উবাইদুল্লাহ এবং আল হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (শা. ৬৯৪–৭১৪) ইরাকে বেশ কিছু বিজয় অর্জনে উমাইয়াদের সাহায্য করেছিল। আর তারা যেসব খলিফার হয়ে তারা শাসন করতেন তাদের বেশি চিরাচরিত মুসলিম উৎসগুলো এই ব্যক্তিদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছে।[৪১] কেনেডির মতে, তার পরামর্শদাতা আল-মুগিরার সাথে যিয়াদ ও তার পরিবার "অনেকের দৃষ্টিতে সাকিফি মাফিয়া" হিসেবে ইরাক এবং খিলাফতের পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতেন।[৪২]

হাসনের মতে, "উমাইয়া যুগের সবচেয়ে দক্ষ গভর্নরদের একজন" যিয়াদের "গভর্নর হিসেবে তার প্রতি অর্পিত দায়িত্বের সাথে যথেষ্ট ভালো বোঝাপড়া ছিল এবং শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি তার উত্তরসূরীদের উপর ব্যাপক প্রভাব রেখেছিলেন"।[১১] কেনেডির মতে, খুরাসানে ইরাকি আরব সেনাদের বসতি স্থাপনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ " ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল"। এসব বসতিস্থাপনকারীদের আহলে খুরাসান নামে পরিচিতি পাওয়া উত্তরসূরীরা [২৫][৪২] ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে যুদ্ধ করে উমাইয়া খিলাফতকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।[৪২] স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হুজর্ ও তার ছয় পক্ষাবলম্বীর হত্যাকান্ড কুফায় তাদের জ্ঞাতীগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর অসন্তোষের জন্ম দেয়।[৩০] এই ঘটনা আসন্ন আলীয়পন্থী অভ্যূল্থানের সংকেত দিচ্ছিল[২৯] হুজরের মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড[১১] এবং শিয়া মুসলিমরা হুজর ও তার সঙ্গীদের শহীদ হিসেবে গণ্য করে।[২৭] যিয়াদের বিরুদ্ধ তথাকথিত অভিযোগ ছিল তিনি আলীয় সমর্থকদের ক্রশবিদ্ধ করে হত্যাসহ তাদের বিরুদ্ধে নানা নিষ্ঠুর উপায় অবলম্বন করেছিলেন।[১১]

আবু মিখনাফ (মৃত্যু ৭৭৪), হিশাম ইবনে আল কালবি (মৃত্যু ৮১৯) এবং আব্দুল আজিজ ইবনে ইয়াহিয়া আল জালুদি (মৃত্যু ৯৪৩)-সহ প্রাথাগত মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে যিয়াদের জীবনি রচনার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল।[২৫] আরবদের মধ্যে তাকে একজন অত্যন্ত দক্ষ বাগ্মী হিসেবে গণ্য করা হতো। তার অভিষেক বক্তৃতা, উক্তি এবং অন্যান্য বক্তৃতার খন্ডাংশ ইসলামী সাহিত্য ও আরব অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র এবং ইতিহাসে ব্যবহৃত হয়েছে।[২৫] তার যুগের আরব রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে মুয়াবিয়া, আল মুগিরা এবং মিশর বিজেতা ও এর গভর্নর আমর ইবনুল আসের পাশাপাশি যিয়াদ চারজন দুহাত (বিচক্ষণ)-এর একজন বলে বিবেচনা করা হতো।[২৫] মধ্যযুগীয় সিরিয় ঐতিহাসিক ইবনে আসাকিরের (মৃত্যু ১১৭৬) মতে যিয়াদের কুরআন এবং ফিকহশাস্ত্রের উপর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।[২৫] মধ্যযুগীয় বসরার ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইমরান আল-আবদির মতে যিয়াদ উমরের বিষয়ে হাদিস শুনতে পছন্দ করতেন এবং এই হাদিসগুলোকে সম্মান করতেন। এগুলোর ব্যাপারে তিনি বলতেন: এটাই আমাদের শোনা সত্য! এটাই সুন্নাহ!"[৪৩] বেশ কিছু উৎসে যিয়াদকে নবী মুহাম্মাদের বাণী উমরের মাধ্যমে মূল বর্ণনাকারী হিসেবে বর্ণনার কৃতিত্ব দেওয়া হয়।[২৫] ৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসীয় কর্তৃপক্ষ দিওয়ান তালিকা থেকে কুরাইশ (আব্বাসীয় ও উমাইয়ারা এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত) সদস্য হিসেবে যিয়াদের উত্তরসূরীদের বাদ দিয়ে তাদের সাকিফ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করে। কুরাইশ গোত্রের সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকাকালীন তারা সাকিফ গোত্র থেকে তুলনামুলকভাবে বেশী ভাতা পেত।[৪৪] পরবর্তীতে তারা সরকারী কর্মচারীদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের পুনরায় কুরাইশ গোত্রীয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করায়।[৪৪]

পরিবার সম্পাদনা

যিয়াদের বেশ কয়েজন স্ত্রী ও উম্মাহাত আওলাদ (ক্রীতদাসী যারা তাদের মনিবের সন্তান গর্ভধারণ করত; একবচন: উম্মে ওয়ালাদ) ছিল।[৪৫] তার বিশজন পুত্র ও তেইশজন কন্যার অধিকাংশই উম্মাহাত আওলাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন।[৪৫] তার প্রথম স্ত্রী বনু উকাইল গোত্রের মু'ধা বিনতে শাখর মুহাম্মদ এবং আব্দুল রহমানসহ যিয়াদের চারজন পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ ও আব্দুল রহমান যথাক্রমে প্রথম মুয়াবিয়া ও তার ভাই উতবার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।[৪৫] তার আরব স্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন বসরার এক অভিজাত ব্যক্তির কন্যা লুবাবা বিনতে আওফুল হারাশিয়া৷ লুবাবার চাচা জুরারা ছিলেন একজন গণ্যমান্য মুসলিম বিচারক এবং যিয়াদের নিয়োগ দেওয়া বসরার এককালীন প্রধান বিচারপতি। তার আরেকজন স্ত্রী আল কা'কা' ইবনে মা'বাদ ইবনে জুরারার নাম না জানা এক কন্যা। আল কা'কা ছিলেন বনু তামিম গোত্রের দারিম গোষ্ঠির প্রধান। তাকে তার গোত্রের প্রথম প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নবী মুহাম্মাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। অপর দুই স্ত্রী হলেন উমাইয়া গোষ্ঠীর আদিপুরুষ উমাইয়া ইবনে আবদে শামসের পঞ্চম প্রজন্ম মুহাজির ইবনে হাকিম ইবনে সালিক ইবনে সুফিয়ানের নাম না জনা এক কন্যা এবং বনু খুজা'আ গোত্রের নাম না জানা এক মহিলা।[৪৫] এছাড়াও যিয়াদ এক সময় শাসানীয় পারস্যিক রাজকন্যা মারজানাকে (বা মানজানা) বিয়ে করেছিলেন। তিনি যিয়াদের পুত্র উবাইদুল্লাহর মা। মারজানা পরবর্তীতে শিরুয়া আল-উশওয়ারি নামে যিয়াদের এক পারস্যিক কমান্ডারকে বিয়ে করেছিলেন।[৪৬]

যিয়াদের কন্যা রামলা উমাইয়া রাজপুত্র এবং ফারস প্রদেশ অথবা এর আরদাশির-খুর্রাহ অঞ্চলে যিয়াদের উপঃগভর্নর ও পরবর্তীতে কুফায় তার উপঃগভর্নরের পুত্র উমাইয়ার স্ত্রী ছিলেন। উমাইয়ার পিতা যিয়াদের জানাজার নামাজের ইমামতি করেছিলেন এবং ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুফার গভর্নর ছিলেন।[৪৭] যিয়াদ উমাইয়াকে খুজিস্তান এবং আল-উবুল্লার উপঃগভর্নরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।[৪৭] যিয়াদের কন্যা শাখরা কুরাইশি মাখজুম গোত্রের উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল রহমান ইবনুল হারিসকে বিয়ে করেছিলেন। ইবনুল হারিস ছিলেন হিসাম ইবনুল মুগিরার প্রপৌত্র।[৪৭]

মন্তব্য সম্পাদনা

  1. Al-Harith ibn Abd Allah al-Azdi served four months as governor of Basra and had been appointed effectively as a placeholder in between the dismissal of Abd Allah ibn Amir and the appointment of Ziyad.[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Morony 1987, পৃ. 76।
  2. Howard 1990, পৃ. 33, note 153।
  3. Morony 1976, পৃ. 57।
  4. Hasson 2002, পৃ. 519।
  5. Kennedy 2004, পৃ. 85।
  6. Lynch 2018, পৃ. 1662।
  7. Wellhausen 1927, পৃ. 120।
  8. Wellhausen 1927, পৃ. 119।
  9. Pellat 1960, পৃ. 1085।
  10. Donner 1981, পৃ. 415।
  11. Hasson 2002, পৃ. 520।
  12. Madelung 1997, পৃ. 220, 271।
  13. Madelung 1997, পৃ. 277, 280।
  14. Madelung 1997, পৃ. 280–282।
  15. Madelung 1997, পৃ. 325।
  16. Madelung 1997, পৃ. 326।
  17. Wellhausen 1927, পৃ. 121।
  18. Wellhausen 1927, পৃ. 122।
  19. Wellhausen 1927, পৃ. 121–122।
  20. Madelung 1997, পৃ. 332, note 55।
  21. Wellhausen 1927, পৃ. 122–123।
  22. Wellhausen 1927, পৃ. 123।
  23. Wellhausen 1927, পৃ. 123–124।
  24. Baloch 1946, পৃ. 258।
  25. Hasson 2002, পৃ. 521।
  26. Hasson 2002, পৃ. 520–521।
  27. Wellhausen 1927, পৃ. 125।
  28. Hinds 1993, পৃ. 266।
  29. Hawting 2000, পৃ. 41।
  30. Wellhausen 1927, পৃ. 124–125।
  31. Madelung 1997, পৃ. 337।
  32. Madelung 1997, পৃ. 338।
  33. Wellhausen 1927, পৃ. 126।
  34. Fariq 1966, পৃ. 128।
  35. Boullata 2011, পৃ. 164।
  36. Robinson 2000, পৃ. 763।
  37. Morony 1987, পৃ. 199, 207।
  38. Bosworth 1995, পৃ. 169।
  39. Zetterstéen 1960, পৃ. 5।
  40. Bosworth 1968, পৃ. 44।
  41. Wellhausen 1927, পৃ. 113–114।
  42. Kennedy 2004, পৃ. 86।
  43. Hakim 2008, পৃ. 23।
  44. Tritton 1954, পৃ. 171।
  45. Fariq 1966, পৃ. 121।
  46. Zakeri 1995, পৃ. 116।
  47. Fariq 1966, পৃ. 123।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

পূর্বসূরী
আব্দুল্লাহ ইবনে আমির
বসরার গভর্নর
৬৬৫–৬৭০
উত্তরসূরী
ইরাকের সাথে ক্ষমতা একত্রিত করা হয়
পূর্বসূরী
পদ প্রতিষ্ঠিত
ইরাকের গভর্নর
৬৭০–৬৭৩
উত্তরসূরী
সামূরা ইবনে জুন্দুব (বসরা)
আব্দুল্লাহ ইবনে খালিদ ইবনে আসিদ (কূফা)