ম্যাগনেটোহাইড্রোডায়নামিক্স

ম্যাগনেটো-হাইড্রোডায়নামিক্স (ইংরেজি: Magneto-hydrodynamics (MHD); অথবা চৌম্বক-প্রবাহী গতিবিদ্যা অথবা হাইড্রোম্যাগনেটিক্স বা জলচৌম্বকত্ব) হচ্ছে তড়িৎ পরিবাহী প্রবাহীসমূহের চৌম্বক ধর্মাবলি এবং আচরণ সংক্রান্ত অধ্যয়ন। এমন চৌম্বক-প্রবাহীর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে প্লাজমা, তরল ধাতুসমূহ, লবণ পানি, এবং তড়িৎবিশ্লেষ্যসমূহ। ইংরেজি "magneto­-hydro­dynamics" শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে magneto­- যার অর্থ চৌম্বক ক্ষেত্র, hydro­- যার অর্থ পানি, এবং dynamics- যার অর্থ গতিবিধি; এর সমন্বয়ে। MHD শাস্ত্রের সূচনা হয়েছিল হ্যান্স আলভেইন (Hannes Alfvén)[১] এর মাধ্যমে, যার জন্য তিনি ১৯৭০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

সূর্য একটি MHD ব্যবস্থা যা এখনো আমাদের ভালোমত বোধগম্য নয়।

MHD এর মৌলিক ধারণার নেপথ্যে রয়েছে চৌম্বকক্ষেত্র যা কোন গতিশীল প্রবাহীর মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ আবিষ্ট করতে সক্ষম, যা আবার ক্রমান্বয়ে প্রবাহীকে সমাবর্তিত করে এবং বিপরীতক্রমে চৌম্বকক্ষেত্রটিকে পরিবর্তিৎ করে। যে সমীকরণ জোট দ্বারা MHD এর বর্ণনা করা হয় তা প্রবাহী গতিবিদ্যার নেভিয়ার-স্টোকস সমীকরণ এবং তড়িৎচৌম্বকত্বের ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সমন্বয়। এই ব্যবকলনী সমীকরণগুলো অবশ্যই যুগপৎভাবে সমাধান করতে হবে, হয় বিশ্লেষণমূলকভাবে নয়তো সাংখ্যিকভাবে।

ইতিহাস সম্পাদনা

 
মাইকেল ফ্যারাডে

১৯৪২ সালে হ্যান্স অ্যালভেইন ম্যাগনেটো-হাইড্রোডায়নামিক্স শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন:[২]

 
হ্যান্স অ্যালভেইন

"পরিশেষে সূর্য থেকে গ্রহসমূহের মধ্যে ভরবেগের স্থানান্তর সম্বন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, যা এই তত্ত্বের জন্য মূলভিত্তিস্বরূপ (§১১)। এই প্রসঙ্গে ম্যাগনেটো-হাইড্রোডায়নামিক তরঙ্গের গুরুত্ব প্রদর্শন করা হয়েছে।"

লন্ডনের ওয়াটারলু সেতু পেরিয়ে ভাটায় আগত লবণাক্ত পানি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের মিথষ্ক্রিয়ায় দুই নদীতীরের মধ্যে বিভব পার্থক্যের উদ্ভব ঘটে। মাইকেল ফ্যারাডে এই ঘটনাকে "চৌম্বক-তাড়িতিক আবেশ" বলে আখ্যা দেন এবং ১৮৩২ সালে এই পরীক্ষাটি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ঐ সময়কার যন্ত্রপাতি দিয়ে অত ক্ষুদ্র মানের তড়িৎ প্রবাহ মাপা সম্ভব ছিল না[৩], এবং নদীগর্ভের কারণে সংকেতের শর্ট-সার্কিট হত।[৪] তবুও, একই রকমের একটি প্রক্রিয়ায় ১৮৫১ সালে স্রোত কর্তৃক আবিষ্ট প্রবাহ পরিমাপ করা সম্ভব হয়।

আদর্শ ও প্রতিরোধক্ষম MHD সম্পাদনা

 
সৌর বায়ুর কৃত্রিম MHD প্রতিরূপ (simulation)

MHD এর সরলতম রূপ, আদর্শ MHD-তে ধরে নেওয়া হয় যে, প্রবাহীর প্রতিরোধক্ষমতা এতই নগণ্য যে তাকে নিখুঁত পরিবাহী হিসেবে গণ্য করা যায়। এটাই অসীম চৌম্বক রেনল্ড সংখ্যার সীমা। আদর্শ MHD-তে, লেঞ্জের সূত্র বলে যে, প্রবাহী এক অর্থে চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে বাঁধা থাকে। এটা ব্যাখ্যা করার জন্য বলা যায়, কোন আদর্শ MHD-তে, কোন প্রবাহীর প্রবাহ দ্বারা একটি চৌম্বক ক্ষেত্ররেখা (বা বলরেখা) আবর্তিত বা বিকৃত করা হলেও, ক্ষুদ্র রজ্জুর ন্যায় আয়তনের প্রবাহী ঐ রেখাকে ঘিরেই অবস্থান করবে। একে কখনো কখনো চৌম্বক ক্ষেত্ররেখা প্রবাহীর মধ্যে "জমাটবদ্ধ" হয়ে গেছে বলে অভিহিত করা হয়।[৫] চৌম্বক ক্ষেত্ররেখা এবং আদর্শ MHD এর প্রবাহীর মধ্যকার সম্পর্ক, কোন প্রবাহীতে চৌম্বক ক্ষেত্রের টপোলজির ত্রুটি দূর করে, যেমন- কোন চৌম্বক ক্ষেত্ররেখার সেট গ্রন্থিবদ্ধ অবস্থায় থাকলে, তা ঐ অবস্থাতেই থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রবাহী/ প্লাজমার প্রতিরোধ-ক্ষমতা নগণ্য থাকে। চৌম্বক ক্ষেত্ররেখাসমূহকে পুনঃসংযুক্ত করার সমস্যার কারণেই, কোন প্রবাহীকে অথবা চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎসকে গতিশীল করে শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব হয়। আদর্শ MHD এর শর্ত লংঘিত হলে এই শক্তি ব্যবহারযোগ্য হয়, যা চৌম্বক পুনঃসংযোগ ঘটায় যার মাধ্যমে চৌম্বক ক্ষেত্রে সঞ্চিত শক্তি বিমুক্ত হয়।

আদর্শ MHD সমীকরণ সম্পাদনা

 
ম্যাগনেটো-হাইড্রোডায়নামিক প্রবাহের কৃত্রিম প্রতিরূপ যেখানে চৌম্বকীয় প্রবাহ ঘনত্ব প্রদর্শিত হয়েছে।

আদর্শ MHD সমীকরণ গঠিত হয় অবিচ্ছিন্নতার সমীকরণ, কোশি'র ভরবেগ সমীকরণ, সরণ প্রবাহ অগ্রাহ্য করে অ্যাম্পিয়ারের সূত্র, এবং তাপমাত্রা বিবর্তন সমীকরণ নিয়ে। যে কোন গতিশীল প্রবাহী ব্যবস্থার বিবরণের ন্যায় এক্ষেত্রেও, কণা বণ্টন সমীকরণের সর্বোচ্চ মুহূর্তে আবদ্ধতা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রুদ্ধতাপীয় অথবা সমোষ্ণ অবস্থায় তাপীয় প্রবাহ ধরে নেওয়ার মাধ্যমে এই শর্ত পূরণ করা হয়।

তড়িৎ পরিবাহী প্রবাহীর বর্ণনায় প্রধান রাশিগুলো হচ্ছে প্লাজমা অংশের গতিবেগ ক্ষেত্র  , প্রবাহ ঘনত্ব  , ভর ঘনত্ব  , এবং প্লাজমা চাপ  । প্লাজমার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ আধান হলো চৌম্বক ক্ষেত্র   এবং তড়িৎ ক্ষেত্র   এর উৎস। সকল রাশিই সচরাচর সময়   এর সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। এক্ষেত্রে ভেক্টর অপারেটরের চিহ্নলিপি ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে   হচ্ছে নতি/ঢাল,   হচ্ছে অপসরণ (ডাইভারজেন্স), এবং   হচ্ছে কার্ল।

ভরের অবিচ্ছিন্নতার সমীকরণটি হচ্ছে-

 

কোশি'র ভরবেগ সমীকরণটি হচ্ছে-

 

অ্যাম্পিয়ারের সূত্র ও ভেক্টর ক্যালকুলাসের অভেদ ব্যবহার করে লরেঞ্জ বলসূচক পদ   বিস্তার করা যায়।

 

অতএব,

 

যেখানে ডানপক্ষের প্রথম পদটি দ্বারা চৌম্বক টান বল এবং দ্বিতীয় পদটি দ্বারা চৌম্বক চাপ বল নির্দেশ করা হয়।

প্লাজমার জন্য আদর্শ ও'মের সূত্র হচ্ছে-

 

ফ্যারাডে'র সূত্রটি হচ্ছে

 

নিম্ন-কম্পাংকের ক্ষেত্রে অ্যাম্পিয়ারের সূত্র সরণ-প্রবাহ অগ্রাহ্য করে, এবং সূত্রটি হলো-

 

চৌম্বক অপসরণ শর্ত হচ্ছে-

 

শক্তি সমীকরণটি হলো-

 

যেখানে  , হচ্ছে রুদ্ধতাপীয় দশা সমীকরণের জন্য আপেক্ষিক তাপের অনুপাত। আবশ্যকভাবেই, এই শক্তি সমীকরণ কেবলমাত্র কোন ধরনের সংঘর্ষ বা তাপ পরিবহনের অনুপস্থিতিতেই প্রযোজ্য, কেননা এতে ধরে নেওয়া হয় যে, কোন প্রবাহী উপাদানের এনট্রপি অপরিবর্তিত থাকে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Alfvén, H. (অক্টোবর ১৯৪২)। "Existence of Electromagnetic-Hydrodynamic Waves"Nature (ইংরেজি ভাষায়)। ১৫০ (৩৮০৫): ৪০৫–৪০৬। আইএসএসএন 0028-0836ডিওআই:10.1038/150405d0 
  2. Alfvén, Hannes (১৯৪৬)। "On the cosmogony of the solar system III"Stockholms Observatoriums Annaler১৪: ৯.১–৯.২৯। 
  3. "Teaching about the Earth's Magnetism in Earth Sciences--Part 3"www.phy6.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৪ 
  4. McKetta J McKetta, "Encyclopedia of Chemical Processing and Design: খণ্ড ৬৬ (১৯৬৬)"।[অকার্যকর সংযোগ]
  5. Priest, Eric; Forbes, Terry (২০০০)। Magnetic Reconnection: MHD Theory and Applications (১ম সংস্করণ)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা ২৫।