মোহাম্মদ নিসার
শেখ মোহাম্মদ নিসার (পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে জন্মগ্রহণকারী প্রথিতযশা ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন। দেশ বিভাজনের পূর্বে স্বাধীন ভারতের পক্ষে ফাস্ট বোলার হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডানহাতে ফাস্ট-মিডিয়াম বোলিংয়ের অধিকারী তিনি। পাশাপাশি ডানহাতে ব্যাটিং করতে পারতেন।[১] ঘরোয়া ক্রিকেটে ভারত ও পাকিস্তানের ক্লাব দলে খেলেন।[২] ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে দ্রুততম বোলাররূপে তাকে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও, ভারতীয় ক্রিকেটের ঊষালগ্নে বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম বোলার হিসেবেও তিনি বিবেচিত হতেন।
; জন্ম: ১ আগস্ট, ১৯১০ - মৃত্যু: ১১ মার্চ, ১৯৬৩)ব্যক্তিগত তথ্য | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
পূর্ণ নাম | মোহাম্মদ নিসার | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
জন্ম | হোশিয়ারপুর, পাঞ্জাব, ভারত | ১ আগস্ট ১৯১০|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মৃত্যু | ১১ মার্চ ১৯৬৩ লাহোর, পাঞ্জাব, পাকিস্তান | (বয়স ৫২)|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ব্যাটিংয়ের ধরন | ডানহাতি | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বোলিংয়ের ধরন | ডানহাতি ফাস্ট | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
আন্তর্জাতিক তথ্য | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
জাতীয় দল |
| |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
টেস্ট অভিষেক (ক্যাপ ৯) | ২৫ জুন ১৯৩২ বনাম ইংল্যান্ড | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
শেষ টেস্ট | ১৫ আগস্ট ১৯৩৬ বনাম ইংল্যান্ড | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
খেলোয়াড়ী জীবনের পরিসংখ্যান | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
উৎস: ইএসপিএনক্রিকইনফো.কম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ |
প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাশৈশবে লাহোরের মিন্টু পার্কে ক্রিকেট খেলায় অনুশীলন করতেন। অনুশীলনীতে ৬/৬৮ লাভ করায় ইংল্যান্ড সফরের জন্য মনোনীত হন। আঘাতপ্রাপ্ত বিনু মানকড়ের বিপক্ষে বাউন্সার মারার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৩৯ সালে পাঁচ দলের খেলায় হিন্দু দলের বিপক্ষে মুসলিম দলের অধিনায়ক ওয়াজির আলী অবশ্য তার এ আচরণে রুষ্ট হন।
জম্মুর প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজ এবং লাহোরের সরকারি কলেজে শুরুর দিকে খেলেছেন। প্রথমদিকে তিনি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। পরবর্তীতে কার্যকরী বোলিংয়ে সিদ্ধহস্তের অধিকারী হন ও নিচেরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন।
খেলোয়াড়ী জীবন
সম্পাদনা১৯৩০-এর দশকে অমর সিংকে নিয়ে ভারতীয় ফাস্ট বোলিংয়ে দূর্দান্ত জুটি গড়েন যা বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং জুটি ছিল। ভারতের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম টেস্টে বোলিং করার বিরল সম্মাননা লাভ করেন।[৩] ডগলাস জারদিনের নেতৃত্বাধীন স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল টসে জয়লাভ করে ব্যাটিংয়ে নামলে দীর্ঘ ছয় ফুট উচ্চতার অধিকারী নিসার তার প্রথম বল ডেলিভারী করেন পার্সি হোমসকে লক্ষ্য করে। প্রাপ্ত ২৫ উইকেটের ১৩টিতেই ব্যাটসম্যানেরা হয় তার বলে বোল্ড নতুবা এলবিডব্লিউর শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। সুইং ও কাটার সহযোগে বোলিং করতেন তিনি। কমপক্ষে ২৫ টেস্ট উইকেটধারী ভারতীয় বোলারদের মধ্যে তিনি সর্বাগ্রে অবস্থান করছেন। তার স্ট্রাইক রেট ৪৮.৪০। কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছেন উমেশ যাদব। স্ট্রাইক রেটের কারণে তিনি ফ্রাঙ্ক টাইসন, ম্যালকম মার্শাল ও ওয়াকার ইউনুসের সমকক্ষ হন।
ইংল্যান্ড সফর
সম্পাদনা১৯৩২ সালে পর্বনগরের মহারাজার নেতৃত্বে ভারতীয় দলের সদস্যরূপে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তাদের উদ্বোধনী টেস্ট খেলার জন্য ইংল্যান্ড সফরে যান। ঐ দলে সি. কে নায়ড়ু, ওয়াজির আলী ও নাজির আলী ভ্রাতৃদ্বয় ছাড়াও জনপ্রিয় বোলিং সহযোগী অমর সিং ছিলেন। ঐ সফরে অমর সিং ও মোহাম্মদ নিসার উদ্বোধনী বোলার হিসেবে যথেষ্ট সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। অমর সিং ২০.৩৭ গড়ে ১১১ উইকেট ও মোহাম্মদ নিসার ১৮.০৯ গড়ে ৭১ উইকেট পান।[৪]
নিসারের প্রধান সফলতা ছিল প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট প্রথম উইকেট পাওয়া। প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই স্ট্যাম্প ওপড়ে হার্বার্ট সাটক্লিফকে ৩ রানে বিদায় করেন। একই ওভারের পঞ্চম বলে অপর উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান পার্সি হোমসকেও বোল্ড করেন তিনি।[৫] এর মাত্র ১০ দিন পূর্বে ইয়র্কশায়ারের পক্ষে হোমস-সাটক্লিফের উদ্বোধনী জুটি ৫৫৫ রানের বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন।[৬] ২৬ ওভারের স্পেলে নিসার ৯৩ রান দিয়ে অভিষেক টেস্টেই পাঁচ-উইকেট লাভ করেন।[৭] দুইজন একুশ বছর বয়সী তরুণদের হাতে নাকানি-চুবানি খায় ইংরেজ দল। ইংল্যান্ড ২৫৯ রানে গুটিয়ে কাগজে-কলমে শক্তিধর ব্যাটিং লাইন-আপে পরিণত হয়। প্রথম ইনিংসের ন্যায় দ্বিতীয় ইনিংসেও ওয়াল্টার রবিন্সের একমাত্র উইকেট পান ১৮ ওভার বোলিং করে। ৪৪ স্ট্রাইক রেট নিয়ে খেলায় তিনি ৬/১৩৫ পান। অবশ্য তৃতীয় দিন বিকেলেই ১৫৮ রানের জয় পায় ইংল্যান্ড দল।[৮] ঐ বছরে ভারত একমাত্র টেস্টে অংশ নিলেও সফরে অনেকগুলো প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নেন তিনি। ১৮.০৯ গড়ে ৭১ উইকেট নেন। পরবর্তী চার বছরে তিনি মাত্র পাঁচটি টেস্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন।[৯]
অস্ট্রেলিয়ার মোকাবেলা
সম্পাদনা১৯৩৫ সালের শীতে জ্যাক রাইডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া একাদশ ভারত সফরে মহারাজা ভিজ্জি ভিজিয়ানাগ্রামের ভারতীয় দলের বিপক্ষে খেলে। সেখানেও তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ৪টি অনানুষ্ঠানিক টেস্টে ৩২ উইকেট এবং ৩ টেস্টে ১২ উইকেট নেন।
আগস্ট, ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষবারের মতো টেস্টে অংশ নেন। ওভাল টেস্টে ছয় উইকেট সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে একবার পাঁচ-উইকেটও পান। কিন্তু তার দল খেলায় পরাজিত হয়।[১০] ওয়ালি হ্যামন্ড-স্টান ওর্থিংটন জুটি ভারতীয় বোলারদেরকে কুচিকাটি করে তুলে দলকে এক পর্যায়ে ৪২২/৩ করেন। এ অবস্থায় পাঁচ ওভারের ব্যবধানে চার উইকেট পান ও ইংল্যান্ডকে ৪৬৮/৮-এ পরিণত করেন। ঐ ইনিংসে তার বোলিং পরিসংখ্যান ছিল ৫/১২০। কিন্তু তার দল খুব সহজেই খেলায় পরাজিত হয়।
অবসর
সম্পাদনাশারীরিক সামর্থ্য না থাকায় ১৯৩৬ সালের পর তাকে আর টেস্টে নেয়া হয়নি।[১১] ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে দক্ষিণ পাঞ্জাবে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাকে আর কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা যায়নি। এছাড়াও অমর সিংয়ের আকস্মিক দেহাবসান তাকে স্তব্ধ করে দেয়। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তানে অভিবাসিত হন ও লাহোরে বসবাস করতে থাকেন। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড গঠনে সহায়তা করেন ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। মৃত্যু পূর্ব-পর্যন্ত তিনি পিসিবি’র প্রশাসক ও দল নির্বাচক মনোনীত হন।
মূল্যায়ন
সম্পাদনাভারতীয় ব্যাটসম্যান সি. কে. নায়ডু লিখিতভাবে উল্লেখ করেন যে, নিসার তার প্রথম স্পেলে ১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজে ত্রাস সৃষ্টিকারী ইংরেজ বোলার হ্যারল্ড লারউডের চেয়েও দ্রুতগতিতে বোলিং করতে পারতেন।
মজিদ খানের বাবা, ইমরান খানের চাচা ও ভারতীয় অল-রাউন্ডার জাহাঙ্গীর খান দলীয় সঙ্গী মোহাম্মদ নিসার সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, তার সময়কালে যে-কোন দলের জন্যেই নিসার দূর্দান্ত বোলার ও বড়মাপের ক্রীড়াবিদ ছিলেন। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও নিজ শরীরের তুলনায় বিস্ময়কর ক্যাচ নিতে পারতেন। আমি এই উপমহাদেশের তার ন্যায় দ্রুতগতিসম্পন্ন বোলার আর দেখিনি।[১২]
ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকারী ব্যাটসম্যান লালা অমরনাথও নিসারের খেলোয়াড়ী জীবনের কাছে ঋণী হয়ে আছেন। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে নিসারের সহযোগিতার কথা কখনও ভুলতে পারবেন না। তরুণ অমরনাথ নিখিল ভারতের অনুশীলনী খেলায় অংশগ্রহণের জন্যে বোম্বে আসেন। কিন্তু ইনিংসের ব্যাটিং উদ্বোধনীতে প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হন। নিসার তা বুঝতে পেরে দল নির্বাচকমণ্ডলীকে বুঝান। নিসারের অনুরোধে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় অমরনাথকে ৩ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামানো হলে তিনি ৪৯ ও অপরাজিত ৭৯* তোলেন। এ প্রসঙ্গে অমরনাথ মন্তব্য করেন যে, যদি ঐদিন তিনি আমাকে সহযোগিতা না করতেন, তাহলে হয়তো আমি ভারতের পক্ষে খেলতে পারতাম না।
২০০৬ সালে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড যৌথভাবে তার সম্মানার্থে নিসার ট্রফি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করে। সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসে সাংবার্ষিকভিত্তিতে রঞ্জী ট্রফি ও কায়েদ-ই-আজম ট্রফির শিরোপা বিজয়ী দলের মধ্যে চারদিনের এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।[১৩][১৪]
ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাক্রিকেটের বাইরে তিনি বৃহৎ পশতু উপজাতির নেতৃত্ব দেন ও প্রাক-পাকিস্তানি নেতা ছিলেন। তার আত্মজীবনী অনূদিত হয়েছে যাতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বার্মার লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও গান্ধীজি’র পত্র ঠাঁই পায়।
৫২ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে লাহোরে তার দেহাবসান ঘটে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে নিসার-অমর সিংয়ের গড়ে ওঠা জুটি খুব অল্প বয়সেই থেমে যায়। অমর সিং মাত্র ২৯ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ধরাধাম ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Mohammad Nissar, a cricketer is from India."। ১৯ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৬।
- ↑ Cricinfo player profile
- ↑ Mohammad Nissar: Eight things to know about India's first great pace bowler
- ↑ Indian bowling records 1932
- ↑ http://www.espncricinfo.com/wisdenalmanack/content/story/151765.html
- ↑ http://www.cricketnetwork.co.uk/main/s119/st26334.php
- ↑ "Only Test: England v India at Lord's, Jun 25-28, 1932"। espncricinfo। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১২-১৮।
- ↑ First Test match, Lord's, Wisden home Almanack archive home, England v India 1932
- ↑ India's Greatest Test XI: fast-bowlers, 18 September 2016
- ↑ Statsguru, bowling innings list
- ↑ Fast bowling legacy: Nissar and Amar Singh
- ↑ Mohammad Nissar: India's fastest pre-partition bowler
- ↑ Of pace and gallantry: Mohammad Nissar’s story in pre-partition India as country’s first fast bowler
- ↑ "Virat Kohli hits maiden double century, in any format and at any level".
আরও দেখুন
সম্পাদনাবহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- ইএসপিএনক্রিকইনফোতে মোহাম্মদ নিসার (ইংরেজি)
- ক্রিকেটআর্কাইভে মোহাম্মদ নিসার (সদস্যতা প্রয়োজনীয়) (ইংরেজি)
- ক্রিকেটনেটওয়ার্কে মোহাম্মদ নিসার