মুহাম্মদ আয়েন উদ-দীন

মুহাম্মদ আয়েন উদ-দীন (জানুয়ারি ১, ১৯৩৭ - নভেম্বর ১৬, ২০০৬)[১] ছিলেন একজন বাংলাদেশি বরেণ্য রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক, বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, লেখক, কলামিস্ট এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি।

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

জন্ম সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি রাজশাহী জেলার পবা উপজেলাধীন শ্যামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পাদনা

পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি বাল্যাবস্থায় ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৯৫২ সালে রাজশাহী হাই মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ১৯৬১ সালে রাজশাহী জেলা জজকোর্টে তৎকালীন বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব হরিপদ রায় এর অধীনে আইন পেশায় যোগদান করেন।

ত্রিশ বছরেরও অধিক কাল তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন স্বনামধন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন।

রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর সৎ ও নিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশান তাঁকে তৎকালীন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নিক্ষিপ্ত বর্বরোচিত বোমা হামলার তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন। কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ (আহবায়ক), ডাঃ কামাল হোসেন, ডাঃ এম জহির, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, এবং অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক।

রাজনৈতিক জীবন সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। রাজশাহী জেলার সদর সাব-ডিভিশনের সভাপতি করা হয় তাঁকে। মত পার্থক্যের কারণে একসময় ছাত্র ইউনিয়ন ত্যাগ করে ছাত্র শক্তিতে যোগ দেন এবং সুপ্রীম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ফরমানুল্লাহ খান ও আনসার আলির সংস্পর্শে আসেন। এরা ছিলেন ছাত্র শক্তির কেন্দ্রীয় নেতা। নিরলস পরিশ্রম ও সততার কারণে তিনি রাজশাহী জেলা ছাত্র শক্তির সম্পাদক ও একই সাথে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র শক্তির যুগ্ম সম্পাদক (১৯৫২-১৯৫৮) নির্বাচিত হন। ঐ সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের (১৯৫২) ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। মুহাম্মদ আয়েন উদ-দীন ছিলেন রাজশাহীতে এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। বিরতীহীন আন্দোলনের জন্য তাঁকে এ তাঁর সতীর্থদের সরকার গ্রেফতার করে।

১৯৬২ সালে নির্দলীয় ও সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সংসদে রাজশাহী থেকে তিনি নির্বাচিত হন এবং নির্বাচনের পর তাঁকে কৃষি, বন, মৎস ও পশু সম্পদ বিভাগের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি রাজশাহী সদর থেকে পুনরায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় কৃষি, বন, মৎস ও পশু সম্পদ বিভাগের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারীর দায়িত্ব ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পালন করেন। ঐ সময় একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট অধিবেশনে তিনি যে সুচিন্তিত ভাষণ দেন-তাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়ন ব্যতীত কোন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর ফলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার জনাব মাহতাব উদ্দীন সরকারের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন যা পরবর্তীতে “অধিক খাদ্য ফলাও” অভিযানে পরিণত হয়। এই সংসদেই তিনি যমুনা নদীর উপরে একটি সেতু নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই সেতু নির্মাণের ফলে নদীর উভয় পার্শ্বের জনগণের চলাচল এ মালামাল পরিবহন সহজ, সুলভ ও দ্রুততর হবে।

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন নির্বাচনী এলাকা ৫৪ (রাজশাহী-৪) থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সংসদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলনেতা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করেন। স্বল্প সময়ে জাতীয় সংসদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর- যার মধ্যে ছিল নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ - তাঁর নীতি নির্ধারনী বক্তব্য সুধিমহলে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেন এবং একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তাঁর দক্ষতা আবার প্রমাণিত হয়। মুহাম্মদ আয়েন উদ-দীন ছিলেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ। বিশেষত: সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর উপর তাঁর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেশে বিদেশে সমাদৃত হয় এবং পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় এই ভাষণের রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়। ১৯৮৭/৮৮ সালের বাজেট অধিবেশের বাজেটের উপর তাঁর বক্তৃতা জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৬৩ সালে মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৩-১৯৭০) ও পরবর্তীকালে সভাপতি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৩-১৯৭০)। তিনি প্রথমে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৮ সালে ব্যালটের মাধ্যমে কাউন্সিলারদের সরাসরি ভোটে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসিচব নির্বাচিত হন।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের পরাজয়ের দায়িত্ব স্বীকার করে মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন দলের সভাপতি পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, যা এদেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে একটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে দল পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি কখনও তার রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করেননি।

শিক্ষাখাতে অবদান সম্পাদনা

তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি ১৯৬২ সালে মেয়েদের জন্য রাজশাহী শহরে একটি পৃথক মহিলা কলেজ স্থাপন করেন (বর্তমানে রাজশাহী সরকারী মহিলা কলেজ) এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঐ কলেজের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। এছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বানেশ্বর ডিগ্রী কলেজ (১৯৬৪-১৯৭০) ও আড়ানী ডিগ্রী কলেজ (১৯৬৫-১৯৭০) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাতে অসংখ্য স্কুল, মাদ্রাসা এবং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দরিদ্র ও কর্মজীবী জনগণের শিক্ষার জন্য তিনি রাজশাহী শহরে নৈশ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৬৪-১৯৭০)।

রাজশাহী আইন কলেজ এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাহিরপুর ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন তিনি। তিনি এই কলেজের সদস্য (১৯৬৬-১৯৭০), রাজশাহী নৈশ কলেজেরও সদস্য ছিলেন (১৯৬৩-১৯৬৮)। সাত বছর রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের তিনি সদস্য ছিলেন (১৯৬৩-১৯৬৯) এবং দীর্ঘ আট বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য (১৯৬৩-১৯৬৯) হিসেবে সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ স্থাপনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজশাহীকে শিক্ষা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আয়েন উদ-দীনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনন্য।

ষাটের দশকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভা কর্তৃক “শিক্ষা উপকমিটির” চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হন। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা দেওয়ার জন্য সস্তা নোট বইয়ের প্রয়োজন আছে কি না এই বিষয়ে তিনি জনগণের মতামত গ্রহণ করেন। শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছ থেকে এই বিষয়ে মতামত জানাতে তিনি পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সফর করেন। প্রায় ৯০%  আদর্শ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নোট বই নিষিদ্ধ করার জোরালো সুপারিশ করেন এবং তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি তৎকালীন সংসদে একটি প্রতিবেদন জমা দেন তবে দুর্ভাগ্যক্রমে উক্ত প্রতিবেদনটি এক অজানা কারণে ধামাচাপা দেওয়া হয়।

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকার গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। উক্ত কমিশন সাফল্যের সাথে শিক্ষা বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন সম্পন্ন করে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করে।

তিনি তৎকালীন “রাজশাহী বিভাগীয় কাউন্সিল” এর সদস্য এবং রাজশাহী সরকারী কলেজের পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন।

পেশাদারী সম্পৃক্ততা সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে “ড্রেনেজ, ফ্লাড কন্ট্রোল এন্ড ওয়াটার রিসার্চ কাউন্সিল অফ পাকিস্তান” এর একমাত্র বেসরকারী সদস্য ছিলেন। বিশ্বের বিশিষ্ট জল-বিশেষজ্ঞ মরহুম জনাব এ বি এম এম আব্বাস ছিলেন এই কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জনাব মুহাম্মদ আইয়ুব খান ছিলেন এই কাউন্সিল এর চেয়ারম্যান।

তিনি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অনারারি ট্রেজারার ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী শিশু ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

জনাব মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন আশির দশকে বাংলাদেশ সৌদি আরব ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তাঁর আমলে তিনি “মাহে রমজানের গুরুত্ব”, “ইসলাম: জীবনের একটি সম্পূর্ণ আচরণবিধি” ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে প্রচুর সেমিনার আয়োজন করেছিলেন। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এফ কে এম এ মুনিম ও প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকতেন। বই ও পুস্তিকা প্রকাশেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং বিনা মূল্যে সেসব বই ও পুস্তিকা বিতরণ করেছিলেন। তাঁর আমলে আল্লামা ইউসুফের অনুবাদকৃত বিপুল সংখ্যক পবিত্র কোরআন অনেককে বিতরণ করা হয়েছিল।

তিনি জাতীয় মাদক বিরোধী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি মাদকবিরোধী আইন সংস্কার সংক্রান্ত সাব কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সহকর্মীদের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন।

১৯৮৫ সাল থেকে কয়েক বছর তিনি বাংলাদেশ জমিয়তে আহলে হাদিসের সহ-সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। পরে তিনি ঐ সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন।

বিদেশ ভ্রমণ সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন ১৯৬৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর বিপ্লব দিবস উপলক্ষে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সফর করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের সাথে দুই দেশের পারস্পরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মিঃ মাও-সে-তুংয়ের সাথে তিনি নানা দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৭ সালে ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত “গ্লোবাল পার্লামেন্টারিয়ান কনফারেন্স অন অ্যাপার্টহেড” সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি এবং বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। সম্মেলনের সময় তিনি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জনাব ভেঙ্কাট রামায়ণ এবং ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব রাজীব গান্ধীর সাথে বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

তিনি ১৯৮৯-এর পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সহ-পৃষ্ঠপোষকতায় “আইনের শাসন” শীর্ষক সেমিনারে অংশ নেন।

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন তিন বার পবিত্র হজ পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। একবার সৌদি আরবের প্রয়াত বাদশাহ খালেদ এর বিশেষ অতিথি হিসেবে, একবার রবিতা-আল-আলমের অতিথি হিসাবে এবং একবার তাঁর পরিবারের সাথে।

তিনি ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে লিবিয়া সফর করেছিলেন। এছাড়াও তিনি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যও সফর করেছিলেন।

সমাজকর্ম সম্পাদনা

স্কুল ছাত্র থাকা অবস্থায় মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন নিজ গ্রামে “চকবেলঘরিয়া ইয়ুথ ক্লাব” (১৯৫১-১৯৫৭) নামে একটি যুব সংগঠন গড়ে তোলেন এবং স্বল্পকালের মধ্যে “চকবেলঘরিয়া চাষীক্লাব” (১৯৫২-১৯৫৭) নামে আরো একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উভয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং এলাকার দারিদ্র পীড়িত জনগণের জন্য কাজ করেন। এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে তিনি এলাকার গরীব মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন।

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন রাজশাহী সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে “উত্তরবঙ্গ আখচাষী সমিতি” গঠন করেন (১৯৫৮-১৯৬৭) এবং তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে আখচাষীদের দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের সুফল হিসেবে পরবর্তীতে রাজশাহী সুগার মিল প্রতিষ্ঠিত হয়।

ছাত্রনেতা থাকাকালীন সময়ে তিনি “রাজশাহী জেলা রিকশা চালক ইউনিয়ন” গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। দরিদ্র রিকশা চালকদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য তিনি একটি প্রকল্প চালু করেন যার মাধ্যমে সংগঠনটি দরিদ্র রিকশা চালকদের বিনামূল্যে রিকশা বিতরণ শুরু করে।

তার অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার রাজশাহীর জনগণের কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবনধারণের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী চিনি মিল এবং রাজশাহী জুট মিল প্রতিষ্ঠা করে এবং আখ ও পাট চাষীদের দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য রাজশাহী সুগার মিল ও রাজশাহী জুট মিল প্রতিষ্ঠা করে।

তিনি “সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল ফর ইসলাম অ্যান্ড মডার্ন এজ” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন। উক্ত সংগঠনটি একটি ত্রৈমাসিক জার্নাল প্রকাশ করত। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ শিক্ষাবিদ ড. শরফুদ্দিন ছিলেন সেই জার্নালের সম্পাদক। নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. এম এ সালাম জার্নালটির অত্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন।

তিনি রাজশাহীতে তাঁর নিজের গ্রাম শ্যামপুরে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান "সাধনপুর পাঙ্গু শিশু নিকেতন" এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

লেখালেখি সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি কয়েকটি বই এবং কয়েকটি জার্নাল লিখছেন। তাঁর প্রকাশিত দুটি প্রসিদ্ধ বই হল “স্বদেশ, সময় রজনীতি” এবং “মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ”। এই বই দুটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে।

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

মুহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনা করতেন। তিনি বহু ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য সহায়তা করেছেন।

নৈতিক বিষয় তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি কখনও তাঁর সততা, মর্যাদাবোধ এবং অবস্থানের সাথে আপোষ করেননি। তিনি এমন একটি জীবনযাপন করেছেন যা অনেকের জন্য উদাহরণ স্বরূপ।

বিপুল প্রাণশক্তির এই মানুষটি ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। একই সঙ্গে এত ভিন্নধর্মী কাজ তিনি কীভাবে করতেন সেটা ভেবে তাঁর আপনজনেরা বিস্মিত হত। বক্তা হিসেবেও তিনি ছিলেন অগ্নিবর্ষী। যে কোনো বিষয়ের উপর অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন তিনি।

মৃত্যু সম্পাদনা

শেষ জীবনে তিনি ডায়াবেটিস ও কিডনী সংত্রান্ত জটিল রোগে ভূগছিলেন। ২০০৬ সালের ১৬ই নভেম্বর, ২ রা অগ্রহায়ণ ১৪১৩ বঙ্গাব্দ, ২৩ শে শাওয়াল ১৪২৭ হিজরী বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় ভোর পাঁচটায় ফজরের আজানের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। এই জানাজায় অংশগ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সহ অন্যান্য সব বিচারপতি, সব দল ও মতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সরকারী পদস্থ কর্মকর্তা সহ সাধারণ জনগণ। তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় তাঁর নিজ গ্রাম শ্যামপুরে, যেখানে অংশগ্রহণ করেন রাজশাহীর তৎকালীন সংসদ সদস্যগণ, রাজশাহীর তৎকালীন মেয়র, সকল দলের ও মতের নেতারা সহ ১০ হাজারেরও অধিক জনগণ। এরপর তাকে নিজ গ্রাম শ্যামপুরে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Ahmod, Tanvir। "beggarly - Bengali Meaning - beggarly Meaning in Bengali at sobdartho.com | beggarly শব্দের বাংলা অর্থ"sobdartho.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-১৬