মাহতাব আলী সরকার যিনি এম এ সরকার নামে পরিচিত (১৯৪২ – ১৯৭৭) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।[১] তিনি গংগাচড়া উপজেলার একমাত্র বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন।

মাহতাব আলী সরকার
জন্ম১৯৪২
মৃত্যু১৯৭৭
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণবীর প্রতীক

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

মাহতাব আলী সরকারের জন্ম রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের বাংলাপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম বশিরউদ্দিন সরকার এবং মায়ের নাম সখিমননেছা। তার স্ত্রীর নাম মঞ্জুয়ারা বেগম। তার এক ছেলে।[২] কিশোরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পাশ করার পর পাকিস্তান আমলে নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি করাচীতে নৌবাহিনীর সদস্য থাকাকালীন জাতীয় ফুটবল দলের দলনায়ক ছিলেন। ১৯৬৮ সালের পিতার মৃত্যুর পর, তিনি নৌবাহিনীর চাকরী ছেড়ে বাড়িতে আসেন এবং ৬৯-এর গণ অভ্যুথান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৭১ সালে এইচএসসি ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিলেন মাহতাব আলী সরকার। পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষি কাজও করতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার পর ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে যুদ্ধ করেন সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে। পরে পাটগ্রাম সাব-সেক্টরে। হাতীবান্ধা, কাকিনা, বড়খাতাসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি দলের দলনেতা ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পাদনা

১৯৭১ সালে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত তুষভান্ডার এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে পাটগ্রাম, বড়খাতা ও হাতীবান্ধা মুক্ত করার পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকেন লালমনিরহাটের দিকে। মিত্রবাহিনীর সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশ অগ্রসর হয় লালমনিরহাটের উদ্দেশে। ছোট অংশ যায় তুষভান্ডার মুক্ত করতে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে তুষভান্ডার আক্রমণ করার জন্য রওনা হন। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহতাব আলী সরকার। তিনি তার দল নিয়ে সবার আগে গিয়ে সেখানে আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দল তখনো বেশ দূরে ছিল। মাহতাব আলী সরকারসহ তার দলের মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। তার দলের মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুদ্ধবিদ্যায় তারা তেমন পারদর্শী ছিলেন না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের গুলিতে তারা একে একে শহীদ হতে থাকেন। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তার দলের একমাত্র তিনিই বেঁচে থাকেন। এ অবস্থায়ও তিনি মনোবল না হারিয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। তখন তিনি একটি কৌশল প্রয়োগ করেন। বারবার স্থান পরিবর্তন করে গুলি করতে থাকেন। এতে পাকিস্তানি সেনারা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দল সেখানে এসে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। তাদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীও লাঠিসোঁটা নিয়ে যোগ দেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদেরও গোলাগুলি প্রায় শেষ হয়ে যায়। তখন তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এরপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।[৩] তাঁর এই বীরত্বের জন্য সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নং ৩৬৩। গেজেটে নাম এম.এ. সরকার।

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

স্বাধীনতা পরবর্তী ও মৃত্যু সম্পাদনা

বাংলাদেশের স্বাধীনের পর তিনি রংপুর মেডিকেল পূনর্গঠনে বিভিন্ন কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি আলমবিদিতর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে নীলফামারী কিশোরগঞ্জ জেলার মৌ. মুহম্মদ হোসেনের কন্যা মঞ্জুয়ারা বেগমকে বিবাহ করেন।

১৯৭৫ সালে তিনি জন্ডিসে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করালেও তা ভালো হচ্ছিল না। এ দিকে লিভারেও অসুখ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে লিভার অকেজো হয়ে যায়। ৩ আগস্ট ১৯৭৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না" | তারিখ: ০১-১২-২০১১"। ২০১৮-১১-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৪-২৩ 
  2. একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রহন্থ। জনতা ব্যাংক লিমিটেড। জুন ২০১২। পৃষ্ঠা ১৪০। আইএসবিএন 9789843351449 
  3. একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। এপ্রিল ২০১২। পৃষ্ঠা ১৭১। আইএসবিএন 9789843338884 

পাদটীকা সম্পাদনা